ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪১ মিনিট আগে
শিরোনাম

সহকারী শিক্ষকরা যেন শুভংকরের ফাঁকিতে না পড়ে

  জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশ : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১১:০০

সহকারী শিক্ষকরা যেন শুভংকরের ফাঁকিতে না পড়ে
ফাইল ফটো

প্রাথমিক শিক্ষায় বিশাল বিনিয়োগ ও অর্জনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে শিক্ষাবান্ধব সরকার। তারপরও প্রাথমিক শিক্ষা কেন যন্ত্রণায় কাতর? স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি নিয়ে কারও কারও মনে প্রশ্নের উদয় হয়।

আজও প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকরা নানা বৈষম্যে জর্জরিত। দীর্ঘসময় আর্তনাদের পর প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতনবৈষম্য দূরীকরণের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজর কেড়েছে।

বিষয়টি যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে। বৈষম্য দূর করার দৃঢ়প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন।

প্রত্যাশা করি বৈষম্যদূরীকরণ যেন শুভংকরের ফাঁকি না হয়। সহকারী শিক্ষকরা প্রধান শিক্ষকদের পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষার বিশাল কর্মযজ্ঞ পালনে ভূমিকা রেখে আসছেন।

এ প্রেক্ষাপটে সহকারী শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষকের পরের স্কেল প্রত্যাশা মোটেই অযৌক্তিক নয়। সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে অধিকতর মানসম্মত করার লক্ষ্যে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ সৃষ্টি করার একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে।

এ মহৎ উদ্যোগকে ম্লান করে দেয়ার জন্য একটি মহল সহকারী শিক্ষকদের বেতনবৈষম্যের ষড়যন্ত্র করছে। সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে স্কেলের পরিবর্তে ভাতা প্রদান করে বিষয়টি নিরসন করা হলে সহকারী শিক্ষকদের মাঝে কোনো ক্ষোভ সৃষ্টি হবে না।

প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির দশম গ্রেড না দেয়ায় তাদের মাঝেও ক্ষোভ বিরাজ করছে। পদোন্নতিপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকরা দীর্ঘসময় শিক্ষকতা করে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের চেয়ে বেতন কম পাচ্ছেন।

এ বৈষম্য নিয়ে অযথা দীর্ঘসময় ফাইল চালাচালি বা বৈষম্য নিরসনের নামে কমিটি করে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে বলে শিক্ষকরা মনে করেন। ডিজিটাল পদ্ধতিতে দ্রুত সমাধান হোক শিক্ষকদের বেতনবৈষম্য।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩৬ হাজার ১৬৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারীকরণ করে প্রাথমিক শিক্ষকদের সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা দিয়েছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় তারই সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৬ হাজার ১৯৩টি বিদ্যালয় সরকারীকরণ করে প্রাথমিক শিক্ষকদের সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা দিয়েছেন।

অথচ সরকারি মর্যাদা পেয়ে প্রাথমিক শিক্ষকরা সরকারি কর্মচারীদের চেয়ে কম ছুটি ভোগ করেও নন-ভোকেশনাল সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কেন প্রাথমিক শিক্ষকরা সরকারি কর্মচারীদের মতো দুটি অর্জিত ছুটি, লাম্পগ্রান্ড, পিআরএল পূর্ণ বেতন পান না? সরকারি কর্মচারীরা শ্রান্তি বিনোদন ভাতা পান ৩ বছর পরপর।

প্রাথমিক শিক্ষকরা পান ৪ থেকে ৫ বছর পরপর। বার্ষিক ছুটির তালিকায় গ্রীষ্মের ছুটি ১৫ দিন রাখা হলে প্রাথমিক শিক্ষকদেরও ৩ বছর পরপর শ্রান্তি বিনোদনের ভাতাপ্রাপ্তি নিশ্চিত হবে।

সরকারি কর্মচারীরা স্বাভাবিক পদোন্নতি না পেয়ে চলতি দায়িত্বে কাজ করলে দায়িত্বভাতা ১০ শতাংশ বা অনূর্ধ্ব ১৫০০ টাকা পেয়ে থাকেন, ২০১৫ সালের বেতন স্কেলের বইয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে যার নির্দেশনা দেয়া আছে।

অথচ সরকারি প্রজ্ঞাপনকে তোয়াক্কা না করে প্রাথমিকের চলতি দায়িত্বে কর্মরত প্রধান শিক্ষকদের চলতি দায়িত্ব ভাতা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। যে যন্ত্রণায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সুনাম তথা অস্তিত্ব বিলীন হচ্ছে তা হল, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীর অভিন্ন সময়সূচি ও পাঠ্যপুস্তক। বর্তমানে শিক্ষার্থী সংকটের কারণে দেশে ৬৫০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন।

সারা দেশে উপবৃত্তি, দুপুরের খাবার, অবৈতনিক শিক্ষাসহ উচ্চশিক্ষিত, ট্রেনিংপ্রাপ্ত শিক্ষকের সমাহার। তবুও কেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থী ভর্তি কমছে? ৬২৫টি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০-এর নিচে।

২৫টির শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০-এর নিচে। বিএনপি সরকারের সময়ে কিছু বিদ্যালয় বিলুপ্ত বা একীভূত করা হয়েছে। কিন্তু একীভূত করার পরও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়েনি, বরং কমেছে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা মহানগরীর কতিপয় বিদ্যালয়কে (যেমন শান্তিবাগের টিএন্ডটি ও খিলগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়) একীভূত করেও দীর্ঘসময়ে শিক্ষার্থী বৃদ্ধির পরিবর্তে দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।

উচ্চশিক্ষিত, ট্রেনিংপ্রাপ্ত শিক্ষক, উপবৃত্তি, টিফিনসহ আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা এবং শিক্ষকদের আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও সফলতা আসেনি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে বেসরকারি ও সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখা এবং কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়ের সময়সূচির বিশাল ব্যবধান।

দিনের বেশির ভাগ সময়ে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে অবস্থান করতে হয় বিধায় তারা বিকালে খেলাধুলা ও বিনোদনের সুযোগ পায় না।

অভিভাবকরা সরকারের সব সুযোগ-সুবিধা পরিহার করে তাদের সন্তানদের বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করান। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিন্ন সময়সূচি চালু করা জরুরি। বিনামূল্যে সরকারি বই বিতরণ দেশ-বিদেশে সমাদৃত হয়েছে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক চার রঙের আকর্ষণীয় ও টেকসই পরিমার্জিত কারিকুলাম অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করে সরবরাহ করা হয়। কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়সহ বেসরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখায় শিশুর মেধা বিনাশকারী পুস্তকের সমাহার।

এই বই তারা বাণিজ্য করার অভিপ্রায়ে শিশু শিক্ষার্থীর ওপর চাপিয়ে দেয়। আমাদের বেশির ভাগ অভিভাক মহাখুশি। তাদের সন্তান অনেক বই পড়ে, কঠিন কঠিন শব্দ, বাক্য মুখস্থ করে, একগাদা খাতায় লেখে।

তাদের ধারণা, বেশি বই-খাতায় তাদের সন্তান অনেক শিক্ষিত হবে। এসব বই যে জ্ঞান অর্জনের পরিবর্তে মেধা বিনাশ করে, শিশুর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নষ্ট করে, এই উপলব্ধি তাদের মাঝে নেই। এ প্রেক্ষাপটে সব শিশুর অভিন্ন বই পড়ানোর ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা প্রয়োজন। বেশি বেশি বই-খাতার মাধ্যমে বড় পাসের জন্য সবাই ছুটছে কিন্ডারগার্টেনের দিকে।

অপরদিকে প্রাথমিকের শিক্ষকদের বহুমুখী কাজে ব্যস্ত রাখায় তাদের দুর্নামের দায় নিতে হচ্ছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। বছরের পর বছর শিক্ষক সংকট চলছে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয়। প্রাথমিক শিক্ষা চলছে অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে।

কোনো অবস্থাতেই বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট কাম্য নয়। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত শিক্ষার্থী পাবে শিক্ষকের সান্নিধ্য এটাই কাম্য। কিছু ফাঁকিবাজ শিক্ষক বিদ্যালয়ে শিক্ষাপ্রদানের দায়িত্ব পালন না করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেও শিক্ষক সমাজকে কলঙ্কিত করে, যা মোটেই সহ্য করা উচিত নয়।

প্রাথমিক শিক্ষার সব বৈষম্য দূর করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলাই হোক মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের লক্ষ্য। এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

মো. সিদ্দিকুর রহমান: আহ্বায়ক,

বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ

প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম

  • সর্বশেষ
  • পঠিত