ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৫ মিনিট আগে
শিরোনাম

গির্জার প্রার্থনা সভা থেকে যেভাবে ছড়িয়েছে করোনা

গির্জার প্রার্থনা সভা থেকে যেভাবে ছড়িয়েছে করোনা

ফ্রান্সে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ক্রিশ্চিয়ান ওপেন ডোর গির্জায় প্রার্থনায় মিলিত হয়েছিলেন কয়েকশ মানুষ। সীমান্তবর্তী মিলুজ শহরে আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী ওই প্রার্থনায় যোগ দিতে অনেকে হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়েছিলেন ।

বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই গির্জার অনুসারীদের কাছে বার্ষিক এই উৎসব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আসর হিসাবে বিবেচিত।

কিন্তু এবারের সমাবেশে অংশ নেয়া কারও একজন বহন কিরছিলেন প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস জীবাণু। ফলে ওই ধর্মীয় সভা ফ্রান্সে কোভিড-১৯ সংক্রমণের সবচেয়ে বড় বিস্তার হয়েছে। প্রার্থনায় অংশ নেয়া আড়াই হাজারের মত মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

চার্চে প্রার্থনায় যোগ দেওয়া ব্যক্তিরা নিদের অজ্ঞাতেই ভাইরাসটি বয়ে নিয়ে গেছেন পশ্চিম আফ্রিকার বুরকিনা ফাসো, ভূমধ্যসাগরের দ্বীপ কোরসিকা, লাতিন আমেরিকার গায়ানা, সুইজারল্যান্ড, একটি ফরাসি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ইউরোপের সবচেয়ে বড় গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ওয়ার্কশপে।

এর কয়েক সপ্তাহ পরে জার্মানি আংশিকভাবে ফ্রান্সের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। স্থগিত করে ২৫ বছরের অবাধ চলাচল চুক্তি।

জার্মানির ওই সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঙ্গে যুক্ত দুইজন ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম রয়টার্সকে বলেন, করোনাভাইরাস ছড়ানোর ক্ষেত্রে ওই চার্চকেন্দ্রিক গোষ্ঠীটি একটি ‘প্রধান ফ্যাক্টর’হিসেবে কাজ করেছে।

সমাবেশে উপস্থিতদের মধ্যে ১৭ জন এরইমধ্যে করোনায় মারা গেছেন। ওই চার্চের কর্মকর্তারাই রয়টার্সকে এ তথ্য দিয়েছেন।

বিশ্বে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসের বিস্তারের পেছনে অন্যান্য ধর্মীয় সমাবেশেরও ভূমিকা রয়েছে। যেমন দক্ষিণ কোরিয়ায় খ্রিস্টানদের একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের গির্জা থেকেই সংক্রমিত হয়েছেন ৫ হাজারের বেশি মানুষ।

ফ্রান্সের ক্রিশ্চিয়ান ওপেন ডোর চার্চের প্রার্থনাসভায় উপস্থিত ব্যক্তি এবং দেশটিতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা রয়টার্সকে যে কাহিনী শুনিয়েছেন তা এই ভাইরাস সংক্রমণের গতি ও ভয়াবহতার বড় প্রমাণ।

সেদিন ছিল মঙ্গলবার, বিকালের আবহাওয়াও ছিল চমৎকার। পুরনো একটি শপিং সেন্টারকে আড়াই হাজার আসনের অডিটোরিয়ামে পরিণত করে শুরু হয় ওপেন ডোর চার্চের প্রার্থনাসভা। করোনাভাইরাসকে তখন দূর দেশের ঘটনা বলেই মনে হচ্ছিল।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, সে সময় ফ্রান্সে মাত্র ১২ জনের করোনাভাইরাস ধরা পড়েছিল। মিলুজ এলাকায় কেউ তখনও সংক্রমিত হননি।

তাই উত্তর ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো ফ্রান্সেও তখন বড় সমাবেশের ওপর কোনো বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়নি। ফলে ওই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আগতদের জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজার ছিল না। করমর্দনেও ছিল না কোনা নিষেধাজ্ঞা।

২৯ ফেব্রুয়ারি চার্চের সমাবেশকেন্দ্রিক প্রথম করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হওয়ার পর স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা সাধারণ প্রটোকল অনুযায়ী কার কাছ সংস্পর্শে এসে তার ভাইরাস সংক্রমণ ঘটেছে তা শনাক্ত করার চেষ্টা করেন।

তখন চার্চের দেওয়া একটি তালিকা ধরে স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা প্রথমে সমাবেশের সময় শিশু সেবা কেন্দ্রে দায়িত্বরতদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু ততোক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

চার্চে সমবেতদের মধ্যে ছিলেন স্থানীয় ৩৭ বছরের যুবক এলি উইডমার। তিনি একটি আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার।

উইডমার জানান, কৈশোরে চার্চ থেকে দূরে সরে গেলেও আবার ফিরে এসেছেন। বার্ষিক এই সমাবেশের জন্য এখন সারা বছর অপেক্ষা করেন। চার্চের বাদক দলের ড্রামার হিসেবে এবারের বার্ষিক সমাবেশের পুরো সপ্তাহই ব্যস্ত ছিলেন উইডমার।

ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ করসিকা থেকে এসেছিলেন ৭০ বছর বয়সী আন্তোইনেত্তে। তিনি গত ২৫ বছর ধরে ফ্রান্সের এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমাবেশে যোগ দিয়ে আসছেন। ফরে এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। এবার তার সঙ্গে ছিলেন আরও পাঁচ নারী, সবাই মিলে এই সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন।

ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে উইডমারের অসুস্থতা শুরু হয়। তার স্ত্রী, তিন সন্তান এবং শাশুড়িও অসুস্থ হন।

৩ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ফ্রান্সে নতুন করে ৯১ জনের কভিড-১৯ শনাক্ত হওয়ার তথ্য দেয়, তাদের নিয়ে দেশটিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯১ জনে।

এক নারী ও তার দুই সন্তানের করোনাভাইরাস ধরা পড়ার পর মিলুজ শহরের ওই চার্চের ফেইসবুক পেইজে বার্তা দেওয়া হয়, যারা এই চার্চে এসেছিলেন তাদের চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিৎ।

ফ্রান্সে জরুরি মেডিকেল কেয়ারের জন্য দেওয়া নম্বর ১৫ এ ডায়াল করেন উইডমার। তার পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট টেস্ট কিট তখন ছিল না। তবে চিকিৎসকরা করোনাভাইরাস হওয়ার কথা জানিয়ে তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলেন।

তিন দিন ধরে তার জ্বর ও মাথাব্যথা ছিল, স্বাদ ও ঘ্রাণশক্তিও হারিয়েছিলেন। উইডমার জানান, তিনি খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন না, তার পরিবারের সদস্যদের উপসর্গ ছিল মৃদু। সুস্থ হয়ে এখন তিনি সেলফ আইসোলেশনে রয়েছেন।

চার্চের প্রতিষ্ঠাতার পরিবারেও এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। ওই পরিবারের প্রায় এক ডজন মানুষ আক্রান্ত হন, যারা এখন সেরে উঠছেন।

কয়েক মাইল দূরে সীমান্তের ওপারের জার্মান কর্মকর্তারা ওই এলাকার ওপর নজর রাখছিলেন।

রবার্ট কোচ ইনস্টিটিউট থেকে তারা একটি প্রতিবেদন পান যে, ফ্রান্সের পূর্বাঞ্চল তাদের জন্য করোনাভাইরাসের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর একটি। চীনের হুবেই প্রদেশ, ইরান, ইতালি ও দক্ষিণ কোরিয়ার গায়েনসং প্রদেশের মতই ঝুঁকিপূর্ণ মিলুজ শহর। তবে তখনও ফ্রান্সে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হয়নি।

ফ্রান্স থেকে প্রতিদিন প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ জার্মানিতে যায় কাজের জন্য, তাদের এক পঞ্চমাংশই মিলুজ এলাকার। তাদের অধিকাংশই কাজ করেন জার্মানির সম্পদশালী শিল্পাঞ্চল বাডেন-ভুটেমবার্গে, যেখানে গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি পোরশে ও মার্সিডিজ-বেঞ্জের প্রধান অফিস।

চার্চের ওই প্রার্থনায় যোগ দেওয়ার পর ফ্রান্সের ফেসেনহেইমে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এক কর্মীর করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অপারেটর আরও ২০ জনকে হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠায়।

বাডেন-ভুটেমবার্গের কর্মকর্তারা দেশের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণ রোধে সীমান্তে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেয়। পরে এ নিয়ে দুই দেশের কর্মকর্তাদের আলোচনায় মিলুজ এলাকা থেকে ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়টি উঠে আসে।

মিলুজে প্রার্থনা করে যাওয়া একজনের মাধ্যমে সুইজারল্যান্ডের লুসানের কাছে ইভানজেলিক খ্রিস্টানদের একটি সম্প্রদায়ের মধ্যেও ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।

এছাড়া ফ্রান্সে প্রার্থনায় যোগ দেয়া দক্ষিণ আমেরিকার ফ্রেঞ্চ গায়ানা দ্বীপের পাঁচজনও ইতিমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত