ঢাকা, বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৭ মিনিট আগে
শিরোনাম

যেভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণে সফল ভারতের কেরালা

  আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২০, ১২:২০  
আপডেট :
 ১৭ এপ্রিল ২০২০, ১৪:১২

যেভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণে সফল ভারতের কেরালা

ভারতে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল দক্ষিণের ছোট রাজ্য কেরালাতে, চীনের উহান থেকে আসা এক ছাত্রের দেহে।

তারপর থেকে দেশটিতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে বুধবার তা ১১ হাজার ছাড়িয়েছে। কিন্তু কেরালায় সংখ্যাটি আটকে আছে ৩৮৭ তে, মারা গেছে মাত্র তিনজন।

কেরালা যেভাবে করোনা মহামারির মোকাবেলা করছে, তা এখন শুধু ভারতে নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও স্বীকৃতি পাচ্ছে 'কেরালা মডেল' নামে।

কীভাবে মহামারির মোকাবেলা করল কেরালা?

রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মিসেস কে কে শৈলজা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘যখনই এই ভাইরাসের কথা শোনা যায়, তখন থেকেই আমরা প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। ২০১৮ সালে আরেক ভাইরাস 'নিপাহ' আমাদের রাজ্যে ছড়িয়েছিল। ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল তখন। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এবার আমরা অনেক আগে থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলাম যে কীভাবে করোনার মোকাবিলা করা হবে। তাই জানুয়ারির শেষদিকে যখন প্রথম বিমানটি উহানে আটকে পড়া কেরালাবাসীদের নিয়ে এখানে নামল, তখন তো আমরা প্রস্তুত হয়েই ছিলাম।’

বিমানবন্দরেই প্রত্যেকের তাপমাত্রা মাপা হয়। যাদের সামান্য উপসর্গও দেখা গেছে, তাদেরই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওই বিমানেই এসেছিলেন উহানে মেডিকেলে পড়তে যাওয়া এক ছাত্র। তিনিই ছিলেন ভারতে শনাক্ত হওয়া প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি।

আলেপ্পেই শহরের বাসিন্দা পন্নুমোন চন্দ্রশেখর কুডুপ বলছিলেন, ‘সরকার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটা করেছে, তা হল বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের পরীক্ষা। খুবই জোর দেওয়া হয়েছিল ওই ব্যাপারটায়। কেরালায় বহু মানুষ মধ্যপ্রাচ্যে থাকে। আবার বহু ছাত্রছাত্রী চীনেও পড়াশোনা করে। এদের সবার পরীক্ষা হয়েছে। যাদেরই অসুস্থতার লক্ষণ দেখা গেছে, তাদেরই কোয়ারেন্টিনে রেখে চিকিৎসা করা হয়েছে।’

কেউ কেউ নিজেদের সফরের ইতিহাস লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শেষমেশ যখন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আর লালারস পরীক্ষায় করোনা ধরা পড়েছে, তখনই সরকার প্রচুর লোকবল লাগিয়ে খুঁজে বার করেছে, তারা দেশে আসার পরে কোথায় গিয়েছিল, কোন কোন মানুষের সঙ্গে দেখা করেছে, সব কিছু।

পন্নুমোন কুডুপ আরও বলেন, ‘এটা সত্যিই অসাধ্য সাধন করেছে। যে জন্য রাজ্যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা এত কম রাখা গেছে।’

'কন্টাক্ট ট্রেসিং' বা করোনা আক্রান্ত কোনও ব্যক্তি অন্য যাদের সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের খুঁজে বার করা রীতিমতো খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার মতো ঘটনা।

কিন্তু রাজ্য স্তরে সেই দায়িত্ব একজন অফিসারকে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল রুমটি চালু হয়েছে ২৪ জানুয়ারি থেকেই।

‘সেখানে কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের জন্য যেমন একজন দায়িত্বে আছেন, তেমনই আরও ১৭ জন বিশেষজ্ঞও নানা কাজের দায়িত্বে আছেন। কারও কাজ লজিস্টিক সার্পের্ট দেয়া। অর্থাৎ ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক যোগাড়, কোনও বিশেষজ্ঞর দায়িত্ব মানসিক চাপে যারা পড়েছেন, তাদের সামলানো। এভাবেই আমরা সংক্রমণ মোকাবিলার প্রত্যেকটা কাজ ভাগ করে দিয়েছি। প্রতিদিন দুপুরে পর্যালোচনা হয় এবং পরের দিনের পরিকল্পনা তৈরি হয়। এসব ব্যবস্থাই নিপা ভাইরাস সংক্রমণের সময়েই করে রাখা হয়েছিল।’ বলছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী শৈলজা।

কোচি শহরের বাসিন্দা শান্তি পিল্লাই দীর্ঘদিন কলকাতায় থেকেছেন। তিনিও বলেন, নিপা ভাইরাস সংক্রমণের অভিজ্ঞতা এবার খুব কাজে এসেছে।

শান্তি পিল্লাইয়ের কথায়, ‘নিপা ভাইরাস সংক্রমণের সময় থেকেই রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটা প্রস্তুতি ছিল। হাসপাতালগুলিতে আইসোলেশন ওয়ার্ড বা শহরে লকডাউন, এসব জানাই ছিল। মানুষও সচেতন হয়ে গিয়েছিল সেই সময় থেকেই - তাই এবারের করোনা ভাইরাস আক্রমণের আগেই একটা রিহার্সাল তখনই দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। দেশে আনুষ্ঠানিক লকডাউনের আগে থেকেই কিন্তু কেরালায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, রাস্তায় মানুষ কম বেরনো, প্রতিটা বাসস্ট্যান্ডে সাবান আর জলের ব্যবস্থা করা-যাতে সবাই হাত ধুয়ে নিতে পারে, এসব শুরু হয়ে গিয়েছিল।’

মন্ত্রী শৈলজা বলেন, ‘তবে নিপা সংক্রমণের থেকে করোনা সংক্রমণ মোকাবিলা করাটা আরও কঠিন চ্যালেঞ্জ। কারণ নিপা সংক্রমিত ব্যক্তিদের উপসর্গগুলো স্পষ্ট বোঝা যায়, কিন্তু করোনা আক্রান্তদের লক্ষণ অনেক পরে দেখা যায়। তাই উপসর্গ নেই এরকম ব্যক্তিরা অনেকের সঙ্গে মেলামেশা করেন। ফলে এ থেকেই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।’

একদিকে ভাইরাস মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ, আর অন্যদিকে চলেছে ব্যাপক প্রচার। সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে গণমাধ্যম বা রাস্তায় বিজ্ঞাপন করা হয়েছে। একটা বিজ্ঞাপনের ভাষা এরকম, ‘ব্রেক দা চেইন’। মাত্র একটি বাক্য, আর এতেই পুরো করোনার ভয়াবহতা আর সতর্কতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

বহু মানুষ চিকিৎসায় সেরেও উঠেছেন। যাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এক প্রবীণ দম্পতি। যাদের একজন ৯২ আর আরেকজন ৮৮ বছর বয়সী।

এ নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রঅ শৈলজা বলেন, ‘এই দুজনকে সারিয়ে তোলা আমাদের চিকিৎসকদের একটা বড় সাফল্য। বয়স্করাই বেশি সংখ্যায় মারা যান করোনায়। কিন্তু এরা দীর্ঘ চিকিৎসার পরে সেরে উঠেছেন। আমাদের রাজ্যে জনসংখ্যার ১৫ শতাংশই বয়স্ক। তাই তাদের মধ্যে যাতে সংক্রমণ না ছড়ায়, সেটাও আমাদের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।’

সমাজের সবার অংশগ্রহণ

কেরালায় যেভাবে মহামারি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, তা ভারতে তো বটেই, বিদেশেও আলোচিত হচ্ছে।

ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলি যখন কেরালার সাফল্যের বিশ্লেষণ করছে, তখন তারা লিখছে, রাজ্যে যেভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে - গ্রামীণ চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে বড় হাসপাতাল পর্যন্ত, তারও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে করোনা মোকাবিলার জন্য।

আরও একটি বিষয় আলোচিত হচ্ছে কেরালার মহামারি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে তা হচ্ছে, ভিন্ন রাজ্য থেকে সেখানে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের যেভাবে সেখানকার সরকার দেখভাল করেছে, সেই বিষয়টি।

নানা জায়গায় যখন অন্য রাজ্য থেকে কাজে যাওয়া শ্রমিকরা কোনওমতে একবেলা খাবার পাচ্ছেন, তখন কেরালায় এই শ্রমিকদের বলা হচ্ছে ‘অতিথি শ্রমিক’।

সরকার চালু করেছে তাদের জন্য গণ রান্নাঘর। ভারতে এধরণের শ্রমিকদের খাবার যোগান দেওয়ার জন্য মোট যত রান্নাঘর চলছে, তার অধিকাংশই কেরালায়।

এ ম্পর্কে শান্তি পিল্লাই বলেন, ‘বাংলা, উড়িষ্যা এসব রাজ্য থেকে বিরাট সংখ্যক শ্রমিক কেরালায় আছেন। তাদের দেখভাল করাটা আমাদের সরকারের কাছে একটা বড় দায়িত্ব ছিল। একটা সময়ে তারা আমাদের জন্য কাজ করেছেন, তাই এখন বিপদের সময়েও আমাদের উচিত তাদের দেখাশোনা করা।’

সরকার নিয়ন্ত্রিত নারী সমিতিগুলিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় গণ রান্নাঘর চালানোর। সেখান থেকেই খাবার দেওয়া হচ্ছে এইসব শ্রমিকদের।

কেরালা মডেল থেকে আমরাও তো শিখতে পারি অনেক কিছু। আর সেটা কেবল করোনায় নয়, যে কোনও মহামারি নিয়ন্ত্রণেই এই মডেল গ্রহণযোগ্য। সূত্র: বিবিসি বাংলা

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত