ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

থাই রাজসঙ্গী সিনিনাতের পতন যেভাবে

থাই রাজসঙ্গী সিনিনাতের পতন যেভাবে

থাইল্যান্ডের রাজা ভাজিরালংকর্ণ তার রাজসঙ্গী সিনিনাত ওংভাজিরাপাকদি’র পদবী ও মর্যাদা কেড়ে নিয়েছেন। যদিও মাত্র কয়েক মাস আগেই তাকে ওই পদ ও উপাধি দেয়া হয়েছিল। জানা যায়, অসদাচরণ ও রাজতন্ত্রের প্রতি আনুগত্যহীনতার অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেন রাজা। অনেকেই মনে করছেন, রানির সমপর্যায়ের মর্যাদা চাওয়ায এত বড় শাস্তি পেলেন সিনিনাত।

থাই রাজার ঘটনাটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে হঠাৎ করে কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন থাই রাজা ভাজিরালংকর্ণ ? কতটা গুরুতর ছিলো ওই রাজসঙ্গীর অপরাধ? এই পদবি হাানোর পর কি ঘটতে চলেছে তার ভাগ্যে? এসব প্রশ্নের উত্তরে খোঁজার আগে জেনে নেই রাজসঙ্গী বলতে আসলে কি বোঝায়।

থাইল্যান্ডে রাজসঙ্গী কি?

রাজসঙ্গী বলতে সাধারণত ক্ষমতায় থাকা রাজার একজন স্ত্রী, স্বামী কিংবা সহচরকে বোঝায়। কিন্তু থাইল্যান্ডে এ ক্ষেত্রে কনসোর্ট বা রাজসঙ্গী বলতে রাজার স্ত্রীর পাশাপাশি আরেকজন সঙ্গিনী বা অংশীদারকে বোঝানো হয়ে থাকে। গত প্রায় একশ বছরের মধ্যে থাইল্যান্ডে প্রথমবারের মতো রাজসঙ্গীর খেতাব পেয়েছিলেন ৩৪ বছর বয়সী সিনিনাত।

গত জুলাই মাসে যখন তাকে এই উপাধি দেয়া হয়েছিল তখন থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি রাজার সঙ্গী হিসেবে গণ্য হন। তবে এই উপাধি অনুযায়ী তিনি অবশ্যই রানী নন। ওই সময়ে রাজা তার চতুর্থ স্ত্রী হিসাবে রানী সুথিদাকে বিয়ে করেন। ৪১ বছর বয়সী রানি সুথিদা রাজার সাবেক ফ্লাইট এটেনডেন্ট এবং তার দেহরক্ষী ইউনিটের প্রধান ছিলেন। রাজা ভাজিরালংকর্ণের দীর্ঘদিনের সহযোগী তিনি এবং বহু বছর ধরে রাজার সঙ্গে জনসম্মুখেও সুথিদাকে দেখা গেছে।

ঐতিহাসিকভাবে, থাইল্যান্ডে বহুগামিতার প্রচলন ছিল। সাধারণত রাজ্যের বড় বড় প্রদেশের প্রভাবশালী পরিবারগুলোর সাথে মিত্রতা বজায় রাখতে ওইসব পরিবারের কন্যাদের স্ত্রী বা সঙ্গী হিসাবে গ্রহণ করতেন রাজারা। থাই রাজারা কয়েক শতাব্দী ধরে বহু বিবাহ বা একাধিক সঙ্গী গ্রহণ করে আসছেন।

সবশেষ ১৯২০ সালে একজন থাই রাজা আনুষ্ঠানিকভাবে একজন সঙ্গী গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৩২ সালে দেশটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে পরিণত হওয়ার পর থেকে কোনো রাজা আর এমন সঙ্গী গ্রহণ করেননি।

কে এই সিনিনাথ?

রাজসভার মাধ্যমে প্রকাশিত কিছু বায়োলজিক্যাল তথ্য ছাড়া তার সম্পর্কে আর বিস্তারিত তেমন কিছু জানা যায় না। ১৯৮৫ সালে থাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে জন্মেছিলেন তিনি এবং শুরুতে নার্স হিসেবে কাজ করেছেন। তৎকালীন ক্রাউন প্রিন্স ভাজিরালংকর্নের সাথে সম্পর্কের পর তিনি রয়্যাল সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন।

তিনি একাধারে একজন দেহরক্ষী, পাইলট, প্যারাসুটিস্ট এবং রয়্যাল গার্ডের সদস্য। চলতি বছরের শুরুর দিকে তাকে মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়।

তার সম্মান আরো বাড়ে যখন এক শতাব্দী পর গত জুলাই মাসে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজার সঙ্গীর মর্যাদা দেয়া হয়। এর পরপরই, রাজপ্রাসাদ থেকে তার দাপ্তরিক জীবন বৃত্তান্ত প্রকাশ করা হয় যেখানে তার ফাইটার জেট চালানোর ছবিসহ বেশ কিছু অ্যাকশন ইমেজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তবে দাপ্তরিক ওয়েবসাইট থেকে এখন সেগুলো সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

এখন কী আছে সিনিনাতের ভাগ্যে?

সোমবার রয়্যাল গেজেটে সিনিনাতের পদ ও মর্যাদা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, রাজতন্ত্রকে কোনোরকম সমস্যা এবং চাপ থেকে মুক্ত রাখার আশায় রাজা সিনিনাথকে রাজসঙ্গীর মর্যাদা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সিনিনাথই এখন রাজা এবং রানির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছেন এবং রাজার পক্ষ থেকে আদেশ দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন।

এতে আরো বলা হয়, রাজা জানতে পেরেছেন যে, তাকে যে উপাধি দেয়া হয়েছিল সে তার জন্য কৃতজ্ঞ ছিল না এবং তার মর্যাদা অনুযায়ী সে যথোচিত ব্যবহার করেনি।

করনেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস এবং থাই অধ্যাপনা বিভাগের অধ্যাপক তামারা লুস বলেন, পুরো বিষয়টি বুঝতে হলে আসলে কি ঘটেছে সে বিষয়ে স্বচ্ছতা প্রয়োজন।

রাজ দরবারের গ্রুপিংয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘এ ধরণের যেকোন পরিস্থিতিতে ঘটনার পেছনে এক ধরণের পৃষ্ঠপোষক ব্যবস্থা থাকে। সিনিনাত হয়তো এ ধরণেরই কোন পৃষ্ঠপোষক ব্যবস্থায় পড়েছে এবং সে হয়তো এমন এক পথ অনুসরণ করেছে যা আসলে তার পক্ষে কাজ করেনি।’

তিনি আরো বলেন, ‘তার পতন সম্পর্কে দেয়া ঘোষণাপত্রের ভাষা এমন এক যুগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যেখানে নারীরা সরাসরি রাজনৈতিক ক্ষমতা পেতে পারে না। আর তাই আপনি যাকে নারীর প্রভাব বলে উল্লেখ করবেন সেখানে তাকে নারীর উচ্চাকাঙ্ক্ষা বলে উল্লেখ করা হয়।’

এখন পর্যন্ত সিনিনাতের পদ এবং উপাধি বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু তার জন্য ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে সে বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়। তবে তার অতীত যেহেতু রাজ দরবার নিয়ন্ত্রণ করেছে তাই তার ভবিষ্যতও নির্ভর করবে রাজ দরবারের উপরই।

সিনিনাতের এই পতনের পর সহজেই ধারণা করা যায় রাজা ভাজিরালংকর্নের অন্য দুই স্ত্রীর সাথে কী ঘটনা ঘটেছিল।

১৯৯৬ সালে তিনি তার দ্বিতীয় স্ত্রী সুজারিনে ভিভাচারাঅংসের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রকাশ করেন- যিনি পরে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। একইসাথে ওই স্ত্রীর সাথে তার চার ছেলেকেও ত্যাগ করেন তিনি।

২০১৪ সালে তার তৃতীয় স্ত্রী শ্রিরাসমি সুয়াওদের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পর তার সম্পর্কে আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তারও সব পদ এবং উপাধি বাতিল করা হয়েছিল এবং তাকে রাজদরবারে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর গ্রেপ্তার করা হয় তার বাবা-মাকেও। অবশ্য তাদের একমাত্র ছেলে যার বয়স এখন ১৪ বছর সে রাজা ভাজিরালংকর্নের কাছেই রয়েছে।

এর আগে তার স্ত্রীরা তাদের অবস্থা সম্পর্কে কখনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি।

সিনিনাথের ঘটনা কিসের ইঙ্গিত দেয়?

রাজা হওয়ার পর থেকেই নিজের বাবার তুলনা ক্ষমতাকে অনেক সরাসরিভাবেই ব্যবহার করছেন রাজা ভাজিরালংকর্ন।

চলতি বছরের শুরুতে, রাজধানী ব্যাংককের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সেনাবাহিনীকে তার অধীনে ন্যস্ত করা হয়। যা সামরিক ক্ষমতা রাজার হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়াকে নির্দেশ করে যদিও আধুনিক থাইল্যান্ডে এটা নজিরবিহীন। সিনিনাতের সমালোচনায় রাজদরবার যে নির্মম ও কট্টর ভাষা ব্যবহার করেছে তা থেকেই আভাস পাওয়া যায় যে, কিভাবে রাজা তার শাস্তিকে বৈধতা দিতে চান।

অধ্যাপক তামারা লুস মনে করেন, রাজা আসলে একটি বার্তা দিচ্ছেন, যেটি শুধু তার সঙ্গীর পতন নয় বরং আরো বেশি অর্থবহ। রাজা এক ধরনের সংকেত দিচ্ছেন যে, কেউ একবার রাজার বিপক্ষে গেলে তার ভবিষ্যতের উপর আর তার নিজের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তার যেকোন সিদ্ধান্ত তা সে অর্থনৈতিক, সামরিক কিংবা পারিবারিক যাই হোক না কেন, তার ক্ষমতার অবাধ অপব্যবহারকেই নির্দেশ করে।

দেশটির প্রচলিত আইন অনুযায়ী, বিতর্কিত এই পদাবনতি সম্পর্কে প্রকাশ্যে আলোচনা করা যাবে না, কিন্তু পর্যবেক্ষকরা বিশ্বাস করেন যে, নাটকীয় এই ঘটনা অনেক মানুষের মনেই নাড়া দেবে।

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত