ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৫ মিনিট আগে
শিরোনাম

নাবিকের হাওরবিলাস

  মো. ইফতেখার উদ্দিন

প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৬:৫৭  
আপডেট :
 ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৭:১৩

নাবিকের হাওরবিলাস

রাধা রমন, বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের চারণভূমি সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর। প্রচলিত আছে দিরাইয়ে শাহ আবদুল করিমের বাড়ির সামনে দিয়ে ময়ুরপঙ্খী নৌকা যাওয়ার সময় হাওরের জলে শেষ বিকেলের সোনালী রোদের ঝলক দেখে এই সাধক লিখেছিলেন তার কালজয়ী দেহত্বত্ত্বের গান, ‘কোন মিস্তিরি নাও বানাইছে কেমন দেখা যায়, ঝিলমিল ঝিলঝিল করেরে ময়ূরপঙ্খী নাও’।

শহুরে ঠাঁসবুনট দালানের ভিড়ে থমকে যাওয়া ঢাকা শহর ছেড়ে ঝিলমিল ঝিলমিল ঢেউ দেখার সুযোগ হয়ে গিয়েছিল আমারও। একদিন বিকেলে আমার প্রিয় ভাই-বন্ধু অভি প্রস্তাব দিলো সুনামগঞ্জ টাঙ্গুয়ার হাওর, যাদুকাটা নদী, সাতারগুল জলাবন, ওয়াচ টাওয়ার, শিমুল বাগানের ভ্রমণ, সেইসাথে রয়েছে নৌকায় রাত কাটানোর সুযোগ। বলাই বাহুল্য, ভ্রমণ খরচ অনুকূলে হওয়ায় এবং ছুটির সাথে সামঞ্জস্য থাকায় এই প্রস্তাব লুফে নিলাম।

যথারীতি রাতের বাসে ঢাকার ফকিরাপুল থেকে আমরা রওয়ানা হলাম সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে। আমাদের নাবিকদলে সদস্য সংখ্যা ১৫। কেউ শিক্ষার্থী, কেউ চাকরিজীবি, কেউবা ব্যবসায়ী। দলের দায়িত্ব অভি ও প্রাঞ্জল ভাইর হাতে। ঢাকা ছেড়ে গাড়ি একটু একটু করে এগিয়ে চলছে সুনামগঞ্জের দিকে। তখন প্রচুর আনন্দ। জীবনে প্রথমবারের মতো হাওরে যাবার অনুভূতি প্রকাশযোগ্য নয়।

ভোর ৬টায় সুনামগঞ্জ শহরে পৌঁছে পানসী রেস্তোরাঁয় সকালের নাস্তা সেরে তিনটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে আমরা রওয়ানা হয়ে গেলাম তাহিরপুরের উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে নৌকা ভাড়া করতে হবে। তাহিরপুরে প্রয়োজনীয় বাজার সেরে আমরা নৌকায় উঠলাম। মাঝি নৌকা ছেড়ে দিলো। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশে মেঘের ছায়া পড়েছে। তার মাঝে জলকেটে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের পানসী তরী।

দুপুর ১২টার মধ্যেই আমরা সাতারগুল জলাবনে পৌঁছে গেলাম। সেখানে রয়েছে নান্দনিক এক ওয়াচ টাওয়ার। আমরা টাওয়ারে উঠে হারিয়ে গেলাম প্রকৃতির অপার রুপের ছটায়। একদিকে মেঘালয় রাজ্যের মেঘের হাতছানি, অন্যদিকে হাওরের বিস্তীর্ণ জলরাশি। মাঝখানে ছোট জলাবন, যেন এক অপরূপ মায়াময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

লাইফ জ্যাকেট পরে আমরা ঘণ্টাখানেক সাঁতরে বেড়ালাম ওই জলাবনে। জলাবনের সেই রুপ যে অসুরের কণ্ঠেও সুর আনতে বাধ্য করবে। মনের আনন্দে গেয়ে উঠলাম কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা সেই গান ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি’। প্রকৃতির এই লীলাকুঞ্জের মাঝে নৌকায় বসে এই গানটি সবাইকে আবেগাল্পুত করলো।

আমাদের প্রকৃতি দর্শন আর স্নানবিলাসের পরই হাওরের নির্মল বায়ুতে যেন জঠরে নাড়া দিয়ে উঠলো রাজ্যের ক্ষিদে। নৌকার রসুইঘর থেকে ভেসে আসছে হাসের কষা মাংস আর হাওরের পাবদা মাছ ভাজার সুবাস।

দুপুরের আহারাদী সেরে আমাদের পানসী তরতর করে চলছে টেকেরঘাটের উদ্দেশ্যে। সারাদিন মেঘময় থাকার পর শেষ বিকেলে উকি দেয় সোনারোদ। ক্ষণিকের জন্য তন্দ্রাভূত হৃদয় বলে উঠছিলো বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের সেই গান, ‘ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নাও...।

শেষ বিকেলে আমরা পৌঁছে গেলাম টেকেরঘাটে। সেখান থেকে নীলাদ্রী লেক। শহীদ বীরবিক্রম সিরাজের নামে নামকরণ হয়েছে শহীদ নীলাদ্রী লেকের। নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতি স্তম্ভ। সেখানে ভ্রমণ শেষে সুযোগ মতো ঘুরে এলাম সাধুর কূপ থেকে। অবিরাম মিষ্টি ও ঠান্ডা জল উঠছে সেই কূপ থেকে। সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে দেহ-মন যেন শীতল হয়ে উঠলো।

হাওরে ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে। দূরে মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ে জ্বলে উঠলো সোডিয়াম বাতি। সেই বাতির ছায়া পড়েছে টাঙ্গুয়ার হাওরের জলে। সন্ধ্যা যেন সৃষ্টি করেছে রুপকথার এক মোহময় আবেশ।

এরই মাঝে কথা হলো স্থানীয় বয়োবৃদ্ধ বাসিন্দা ও এক বীর মুক্তিযোদ্ধার সাথে। তাঁর মুখে শুনলাম যুদ্ধে হাওরাঞ্চলের অবদানের কথা। ৪ নং সেক্টর কমান্ডার সদ্যপ্রয়াত চিত্তরঞ্জন দত্তের বীরত্বের কাহিনী। প্রয়াত জননন্দিত নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার গল্প। তাদের আমরা এক পেয়ালা চা পান করাতে চাইলাম, তারা উল্টো বললো, আমরা মেহমান। তাদেরই উচিত আমাদের চা পান করানো। মানুষগুলোর স্বভাবসূলভ সারল্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। সম্মান জানিয়ে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

রাতে নৌকার ছাদে বসলো গানের আসর। দলগতভাবে আমরা গেয়ে উঠলাম হাসন রাজা, রাধা রমন ও শাহ আবদুল করিমের গান। হাওরে এই গুণীদের গান গাইতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে হলো।

রাতের খাবার আয়োজনে ছিলো নদীর পাবদা মাছের তরকারী, ডাল ও আলুভর্তা। আমরা খুব আয়েশ করে খেয়ে ঘুম দিলাম।

পরদিন নতুন প্রভাতে আমরা জেগে উঠলাম। সকাল ৭টায় একদাম গাঁ পুড়ে যাওয়া রোদ। আমরা টেকেরঘাট থেকে মোটরসাইকেল ভাড়া করে গেলাম লাক্ষাছাড়সহ আরো কয়েকটা নাম না জানা প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্র পরিদর্শনে। সেখান থেকে ফিরতে ফিরতেই বেলা ১২টা বাজলো।

আবার আমাদের নৌকা জলকেটে চলতে লাগলো যাদুকাটা নদীর উদ্দেশ্যে। পৌঁছে গেলাম বারিক্কাটিলায়। সেখান থেকে দূর পাহাড়ের রুপ আমাদের মুগ্ধ করেছে।

তারপর যাদুকাটার স্বচ্ছজলে জলকেলি করে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম আমরা। বিকেলটা গেলাম জয়নাল আবেদিন শিমুলবাগানের উদ্দেশ্যে। ছবির মতো সুন্দর এই শিমুল বাগানে। একপাশে যাদুকাটা আরেকপাশে মেঘালয়ের খাসিয়া পাহাড়, আর মাঝখানে শিমুলবাগান। এর শোভা ঠিক লিখে বোঝানোর মতো নয়।

ফুরোয় বেলা ফুরোয় খেলা সন্ধ্যা হয়ে আসে, কাঁদে তখন আকুলও মন কাঁপে তরাসে... তিন রাত দু’দিনের ভ্রমণ শেষ হলো। একরাশ সুখস্মৃতি নিয়ে আমরা রওয়ানা হলাম সুনামগঞ্জ শহরের দিকে।

রাতে সুনামগঞ্জ শহরের লঞ্চঘাটে গিয়ে বসলাম। জল বাতাস আর হাওরের গানে হৃদয় আকুল হলো। বিদায় নিয়ে ফিরলুম এই রুপকথার জলরাজ্য থেকে। শেষ হলো একটি আনন্দ হিল্লোল ভ্রমণের। বলে রাখা ভালো আমাদের ভাই বন্ধুদের ট্রাভেল গ্রুপ নাবিক ট্রাভেলার্স ভ্রমণকালীন সব ধরনের সহায়তা করেছে। যে কোনো প্রয়োজনে পাশে থেকেছে নাবিকের সদস্যরা। স্মরণীয় একটি ভ্রমণ উপহার দেয়ার ভ্রমণ সহযোগীদের ধন্যবাদ অবশ্যই প্রাপ্য।

ভ্রমণ টিপস

*টাঙ্গুয়ার হাওর যাওয়ার আগে তাহিরপুর নৌকাঘাট থেকে লাইফ জ্যাকেট অব্যশই নেবেন। ভাড়া পরবে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা

*তাহিরপুর থানায় নিজেদের নাম-ঠিকানা আইডি, ছবিসহ জমা দিয়ে রাখা উত্তম হবে।

*নিজের সাথে পাওয়ার ব্যাংক, চার্জার, চাদর টয়লেট পেপার, পেস্ট, দাঁত মাজার ব্রাশ, প্লাস্টিকের স্যান্ডেল, গামছা, পলিথিন, এক্সট্রা কাপড়, খাবার পানি, শুকনো খাবার ইত্যাদি রাখবেন।

*একসাথে ১০ থেকে ১২ জন মিলে যাবেন, মজা বেশি হবে, খরচ হবে কম। এছাড়া বিভিন্ন অনলাইন ট্রাভেল গ্রুপের মাধ্যমেও যেতে পারেন।

* হাওরে যাবেন, মনের সুখে গান গাইবেন, আনন্দ করবেন। দয়া করে পানিতে প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলবেন না। কেউ ফেললে তার প্রতিবাদ করাও আপনার দায়িত্ব।

আরো পড়ুন

হাওর-পাহাড়-অরণ্যের মিলনমেলা হবিগঞ্জ

এই বর্ষায় হাওরে

বাংলাদেশ জার্নাল/আরকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত