ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

নিজেকে আঘাত? কাটিয়ে ওঠার উপায়

  জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০১৯, ০৯:৩৮

নিজেকে আঘাত? কাটিয়ে ওঠার উপায়

নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা বা সেলফ হার্ম - এই শব্দটির সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। এই প্রবণতা আমাদের আশেপাশে অনেকের মধ্যে রয়েছে।

নিজের-ক্ষতি করতে চাওয়া কোন ধরণের মানসিক অসুস্থতা নয়। যুক্তরাজ্যে নিজের ক্ষতি বলতে বোঝায় "ইচ্ছা করে বা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে অথবা কারও কোন পরোয়া না করে নিজেকে বিষ দেয়া বা আঘাত করা।"

এই ব্যাখ্যা নিয়ে ভাবার আছে আরও অনেক কিছু। প্রথমত, যে ব্যক্তি নিজের ক্ষতি করছে সেটি যেন দুর্ঘটনার কারণে না হয় সেটা যেন উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়, অর্থাৎ ইচ্ছা করে নিজের ক্ষতির চেষ্টা হয়। এমন অনেক কাজ রয়েছে যা সেলফ হার্ম সংজ্ঞার আওতায় পড়ে। যেমন - কেউ বিষ খায়, হয়ত অতিরিক্ত ওষুধ খেয়ে অথবা বিষাক্ত কিছু খেয়ে সেটা করে।

সেলফ হার্ম এর চাইতেও আরও বিস্তৃত। শরীরে কাটা-ছেড়া করে, নিজের চুল টেনে ছিঁড়ে আনা, শরীরের চামড়ায় আঁচড় কাটা বা চামড়া তুলে আনা, নিজেকে পোড়ানোর চেষ্টা অথবা এর চাইতেও সহিংস কোন কাজ যেমন দেয়ালে মাথা ঠোকা বা ঘুষি মারার কথা জানা যায়।

যুক্তরাজ্যে বর্তমানে বছরে দুর্ঘটনা ও জরুরী বিভাগগুলিতে আসা প্রায় দুই লাখ লোক নিজেকে ক্ষতি করার কারণ চিকিৎসা নিতে আসে। তবে এটি খুব ছোট অংশটি মাত্র যাদের কথা জানা যায়। বেশিরভাগ লোক যারা নিজের ক্ষতি করে তারা দুর্ঘটনা ও জরুরী বিভাগগুলিতে চিকিৎসা নিতে যান না। যুক্তরাজ্যে প্রতি বছর নিজের ক্ষতি করে এমন লোকের সংখ্যা কয়েকটি হিসাবে যা উঠে এসেছে তা এই সংখ্যাটির চেয়ে ২০ গুণ বেশি, অর্থাৎ ৪০ লাখ।

একটি ধারণা রয়েছে যে, কিশোরী মেয়েরা এবং তরুণী মেয়েরা নিজেদের ক্ষতি করতে চাইলেও তারা সফল হয়না। অথচ কয়েক দশক আগে, হাসপাতালগুলোয় দেখা যেতো, একজন পুরুষের অনুপাতে তিনজন নারী নিজেই নিজের ক্ষতি করতে গিয়ে চিকিৎসা নিতে এসেছে। আজকাল নিজেদের ক্ষতি করতে চাওয়া পুরুষের অনুপাত, নারীদের অনুপাতের প্রায় সমান। বর্তমানে প্রতি ১.২ জন নারীর অনুপাতে একজন পুরুষ নিজের ক্ষতি করে থাকে।

আগের চাইতে এখন আরও বেশি বেশি মানুষ নিজেদের ক্ষতি করছে বলে গবেষণায় দেখা গেছে। ২০০০ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে এই হার প্রায় তিনগুণ বেড়েছে, বিশেষত ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সের মেয়েদের মধ্যে। ২০১৪ সালে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয় যে, আশ্চর্যজনক হলেও দেখা গেছে ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন নিজেদের ক্ষতি করে থাকে।

তবে এটি যে অল্প বয়সী মেয়েরাই করে থাকে, তা নয়। নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা নারী পুরুষ নির্বিশেষে সব বয়সীদের মধ্যেই রয়েছে।

মানুষ নিজেরা নিজের ক্ষতি কেন করে, এই প্রশ্নের একক কোন উত্তর নেই। তবে কিছু অন্তর্নিহিত ব্যপার রয়েছে যা মানুষকে নিজের ক্ষতি করার দিকে ধাবিত করে। যারা নিজের ক্ষতি করে, তাদের মধ্যে এমন কিছু মানুষ আছে যাদের হতাশা বা উদ্বেগের মতো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে, তবে বেশিরভাগের কোন মানসিক সমস্যা নেই। যেসব মানুষকে মানসিক ট্রমার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তাদের সেলফ হার্মের আশঙ্কা বেশি থাকে। বিশেষত যারা সমাজে বৈষম্যের শিকার হন যেমন সমকামী সম্প্রদায়ের মানুষ অথবা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্নতায় ভোগা মানুষেরা সেলফ হার্মের ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি থাকে।

কিছু গবেষক মনে করেন যে বঞ্চনা, দারিদ্র্য এবং কঠোরতা মানুষের মধ্যে নিজের ক্ষতি করার আশঙ্কা তৈরি করে। সাম্প্রতিক বছরে অর্থনৈতিক মন্দা সেলফ হার্ম বাড়ার অন্যতম কারণ।

আবার সোশ্যাল মিডিয়া এই সেলফ হার্ম বাড়ার পেছনে দায়ী এমন তত্ত্বও রয়েছে।

এটি বলা জরুরি যে যারা নিজেদের কষ্ট দেয় তারা প্রত্যেকেই যে নিজের জীবন শেষ করতে চান, ব্যাপারটা তা নয়। তবে কেউ যদি নিজের ক্ষতি করার পর হাসপাতালে যান তাহলে তারা সাধারণ মানুষদের চাইতে ৩০ থেকে ৫০ গুণ বেশি আত্মহত্যা প্রবণ হয়ে থাকে। তদুপরি, আত্মহত্যার ফলে মারা যাওয়া মানুষের অর্ধেকেরই সেলফ হার্মের ইতিহাস রয়েছে।

অনেকে অভিযোগ করেন, তারা যে মুহূর্তে নিজেদের আঘাত করেছে সে সময় তাদের আবেগগুলি অপ্রতিরোধ্য এবং নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। চরম মানসিক দুর্দশা এবং সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনও উপায় খুঁজে না পাওয়া। কখনও কখনও এটি সম্পর্কে জটিলতার কারণে বা ঝগড়াঝাঁটির কারণে হতে পারে। অনেক সময় অন্যান্য বিষয় যেমন পড়াশোনার চাপ বা কাজের চাপের কারণেও এমনটা হতে পারে। অনেকে জানেন না যে তারা কীভাবে তাদের দুর্দশাকে প্রকাশ করবেন বা সাহায্য চাইবেন।

বিশ্বের সাথে যোগাযোগ করার জন্য মানুষ নিজের ক্ষতি করার দিকে ঝুঁকছে, এবং এই ক্ষতিটা তারা করে বাইরে, যেন সেটি সবাই দেখতে পারে। মনের আঘাত তো কাউকে দেখানো যানা। মানুষের একটি সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি হ'ল যারা মনোযোগ নিতে নিজের ক্ষতি করে তাদের প্রত্যাখ্যান করা হয়।

তবে এ কারণে নিজেদের ক্ষতি করতে চাওয়া মানুষেরা প্রায়শই কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে সেই আশঙ্কাকে উপেক্ষা করা হয়। এ ধরণের মানুষের যে সাহায্য আর সমর্থন প্রয়োজন, সেই বিষয়টিও এড়িয়ে যাওয়া হয়।

ভালো খবর হচ্ছে যারা নিজের ক্ষতি করেন তাদের দশজনের মধ্যে নয়জনের এই সমস্যা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যাবে। তবে, যারা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পরও নিজেকে ক্ষতি করা চালিয়ে যান, তাদের আচরণের ধরণটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। প্রায়শই এটি এক ধরণের মানসিক অসুস্থতার সাথে যুক্ত থাকতে পারে। যাকে বলা হয় ইমোশনালি আন্সটেবল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার যা অনেকের কাছে বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার নামে পরিচিত।

এমন কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে যা এই ধরণের মানুষের ক্ষেত্রে কাজ করবে যেমন ডায়ালেক্টিকাল বিহেভিওরাল থেরাপি বা ডিবিটি। এটি তাদের চিন্তাভাবনা, অনুভূতি এবং আচরণগুলো নিয়ে কাজ করে। যেন আক্রান্ত ব্যক্তি তার তীব্র আবেগ এবং সম্পর্কের টানাপড়েনগুলো নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে পারে। তারা কেন নিজেদের ক্ষতি করে আসছে সেটা যেন বুঝতে পারে এবং এমন ঘটনা এড়াতে কোন কৌশল খুঁজে নিতে পারে। তবে, ডিবিটি চিকিৎসা সব জায়গায় পাওয়া যায় না। এটি কেবলমাত্র তাদের জন্য প্রযোজ্য যারা নিজেদের গুরুতর ক্ষতি করতে চাইছে। তদুপরি,এ ধরণের চিকিৎসা নিতে আসা মানুষের অপেক্ষার তালিকাটি অনেক লম্বা। চিকিৎসার বিলম্ব প্রায়শই এই সমস্যাটিকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। তা সত্ত্বেও চাইলেই এর চিকিৎসা পাওয়া যায়না।

এবার জেনে নেওয়া যাক আমরা নিজের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কী করতে পারি?

প্রথম পদক্ষেপটি নিতে হবে সমাজের পক্ষ থেকে। আর সেটা হল তারা সেলফ হার্ম করে এমন লোকদের নিয়ে মনগড়া মন্তব্য করা বন্ধ করতে হবে, এবং এর পরিবর্তে তাদের প্রতি আরও বেশি সহানুভূতি দেখাতে হবে।

সোশ্যাল মিডিয়াকে খারাপের চাইতে ভাল দিকগুলির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন: দিনে বা রাতে যে কোন সময় উপলভ্য ভার্চুয়াল থেরাপিউটিক স্পেস তৈরি করা।

স্কুল ও কলেজগুলো বিভিন্ন সহায়তা দেয়ার মাধ্যমে ভূমিকা থাকতে পারে।

নিজের ক্ষতি করার এই প্রবণতা প্রায়শই লজ্জা বয়ে আনে এবং যারা নিজের ক্ষতি করে তাদের কলঙ্কিত করার মাধ্যমে সমস্যাকে আরও প্রকট করে তোলে।

বেশ কয়েকটি ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, দ্রুত পদক্ষেপ নিলে আমরা যারা নিজের ক্ষতি করি তাদের কষ্টকে লাঘব করতে অন্যান্য উপায় খুঁজে পেতে সহায়তা করতে পারি।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসবি

  • সর্বশেষ
  • পঠিত