ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৬ মিনিট আগে
শিরোনাম

চেরি ফুলের দেশে

  -শাহজাহান সরদার

প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০২০, ০০:০৬  
আপডেট :
 ১৪ অক্টোবর ২০২০, ০০:১১

চেরি ফুলের দেশে

২. আমন্ত্রণ পর্ব

দুপুরে ঘুমানো আমার অভ্যাস। এ নিয়ে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন অনেকের ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্য আছে। দুপুরে একুট সময়ের জন্য হলেও বিছানায় গড়াগড়ি না করলে মাথা ঝিম ঝিম করে। দীর্ঘদিন ধরে সংবাদপত্রে কাজ করছি। রাজনৈতিক অনেক উত্থান-পতন, তীব্র আন্দোলন, গুলি-বোমা, সহিংসতার ঘটনাসহ দিনভর রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের সংবাদ যেমন মাঠে থেকে সংগ্রহ করে থাকি তেমনি সেমিনার সিম্পোজিয়ামের খবরও কভার করেছি। ম্যারাথন এসব কর্মসূচির মধ্যেও চেষ্টা করছি দুপুরে একটু বিশ্রাম নিতে। আর কাজ না থাকলে ঘণ্টা খানেকের ঘুম অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। রিপোর্টার থেকে সম্পাদক হয়েছি। এখনও রয়েছে এ অভ্যাস। বরাবরের মত সেদিনও দুপুরে বিছানায় শুয়েছিলাম। দিনটি ৩রা সেপ্টেম্বর ১৯৯২। টেলিফোনের আওয়াজে কিছুটা বিরক্ত হলেও রিসিভার ওঠালাম। জরুরি টেলিফোন হতে পারে। রিপোর্টার মানে সার্বক্ষণিক চাকরি। তখন আমি দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র রিপোর্টার। অফিস থেকে অথবা কোনো সোর্স হতে পারে, বন্ধু-বান্ধব কিংবা আত্মীয়-স্বজনও হতে পারে। তবে সবকিছুর চাইতে সংবাদপত্রের রিপোর্টারদের সংবাদের দিকেই খেয়াল থাকে বেশি।

টেলিফোন বেজে উঠলেই মনে হয় কোনো সংবাদের সন্ধান হয়তো পাওয়া যাবে। কিন্তু না এসব কিছুই না। অপরপ্রান্ত থেকে যিনি কথা বলছেন তিনি জাপানি দূতাবাসের তৎকালীন জনসংযোগ কর্মকর্তা মতিন সাহেব। সরাসরি তিনি প্রশ্ন করলেন আপনার বসয় কত? আমি বিস্মিত হলাম। হঠাৎ বয়সের প্রশ্ন কেন? পরক্ষণেই তিনি বললেন, আপনি কি জাপান যেতে রাজী আছেন। আমার চোখে তখনও ঘুম ঘুম ভাব। বিস্ময় আরো বাড়ে। এবার আমি আড়মোড়া খেয়ে বিছানা থেকে ওঠে জানতে চাই আসলে ব্যাপারটি কি? তিনি বললেন আপনি যদি জাপান যেতে রাজী থাকেন তাহলে কালই আমাদের অ্যাম্বাসিতে আসুন। এলে বিস্তারিত আলোচনা হবে। তবে যেতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। ১০দিনের সময় পাবেন। মতিন সাহেবের সাথে আমার পরিচয় অনেক দিন। ভদ্রলোক কথা বলেন কম এবং বিনয়ী। আমি বললাম, ঠিক আছে কাল আসব। টেলিফোনে কথা বলাতে আমার স্ত্রী জেগে ওঠেন। রিসিভার রেখে তাকে ঘটনা খুলে বলি। তার কথা সূর্যোদয়ের দেশ সম্পর্কে বইয়ে পড়েছি। দেখার সৌভাগ্য ক’জনের আছে। সুযোগ পেলে অবশ্যই যাবে। আমারও একই কথা। আর ঘুম হল না। বিছানা থেকে ওঠে সোজা ইত্তেফাক অফিসে। পরদিন সকালেই দূতাবাসে যাই। যেতেই মতিন সাহেব ইন্টারকমে কথা বললেন প্রেস কাউন্সিলর তাজিকার সাথে। পরে আমাকে নিয়ে গেলেন তাঁর কক্ষে। তাজিকাও আমার পূর্বপরিচিত। খুবই খুতখুতে স্বভাবের লোক। আমার সম্পর্কে জেনে তিনি হতাশ হয়ে বললেনÑনা, বয়স বেশি। তাজিকা মাথার চুল টানছিলেন, এটা তাঁর অভ্যাস।

আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কাদের আমন্ত্রণ, কতদিনের সফর, কিসের বয়সের কথা বলছেন সবই তখন পর্যন্ত অজানা। কিছুক্ষণ পর মাথা থেকে হাত নামিয়ে তাজিকা বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার নামই আমি পাঠাব। বয়স বেশি হলেও আািম সুপারিশ করব। দেখি কি হয়। দু’দিন পর তোমাকে জানাবো। আর মোটামুটি তৈরি থাকবে। এ বলে তাজিকা সাথে সাথে একটি ফরম জাপানি ভাষায় পূরণ করে আমার তথ্যদিসহ ফ্যাক্স করে দিলেন টোকিওতে (এখনকার মতো তখন ইমেইল ছিলো না। ফ্যাক্স ও টেলেক্স ছিলো বার্তা আদান-প্রদানের মাধ্যম)। মতিন সাহেবের সাথে আমি তাঁর কক্ষে ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করলাম, ঘটনা কি বলুন তো। তখন তিনি জানালেন সব।

আগে একজন সাংবাদিকের নাম পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু টোকিও অনুমোদন দেয়নি। বয়স লাগবে ৩৫ বছর। আপনার তো আরও বেশি। যেতে হবে আগামী ১৪ই সেপ্টেম্বর, তাই তাড়াহুড়ো। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম কারা আমন্ত্রণ করেছে, সেখানে কেন যাওয়া, কি করতে হবে? পরে জানলাম জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ফরেন প্রেস সেন্টারের (এফপিসি) ফেলোশীপ। এফপিসি’র এক মাসের ফেলোশীপে আমার পূর্বে আরো তিনজন বাংলাদেশী সিনিয়র সাংবাদিক অংশ নিয়েছেন। এ ফেলোশীপে জাপানি রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে সে দেশের খ্যাতনামা পণ্ডিতগণ বিশদ বর্ণনা দিয়ে থাকেন। আর বিভিন্ন শহর ঘুরিয়ে দেখানো হয়। জাপানী কৃষ্টি ও কালচার সম্পর্কে অবগত করা হয় । এশিয়া, আফ্রিকাসহ আরো কয়েকটি দেশের সাংবাদিকদের এ কর্মসূচীর অধিনে আমন্ত্রন জানানো হয়।

ভালো সুযোগ। মতিন সাহেব বলেন, আশা করি সমস্যা হবে না। তাজিকা সব কিছু লিখে দিয়েছেন, আপনি প্রস্তুত থাকুন। আমি কিন্তু সংশয়মুক্ত হতে পারিনি। বাসায় এসে স্ত্রীকে সব খুলে বললাম। আমার বড় ছেলের এসএসসি টেস্ট পরীক্ষা শুরু হবে ১৪ই সেপ্টেম্বর থেকে (বড় ছেলে ড. এস এম সাজেদুল হাসান বর্তমানে যুক্তরাষ্টে বসবাস করছে)। আমার স্ত্রী খুবই ব্যস্ত ছিলেন। এ সময় বাইরে যাওয়া ছেলের জন্য ক্ষতিকর হবে এমন চিন্তাও দু’জনে করেছি। কিন্তু সূর্যোদয়ের দেশ জাপান যাওয়ার সুযোগ ছাড়া ঠিক হবে কিনা তাও ভাবছি। এমনি সংশয়ের মধ্যে মতিন সাহেব ৬ই সেপ্টেম্বর সকালে আবার টেলিফোন করে জানালেন ‘আপনারটা হয়ে গেছে। কাল আসেন, সব কিছু ঠিকঠাক করতে হবে। পাসপোর্ট নিয়ে আসবেন।’এ টুকু বলেই তিনি ফোন রেখে দিলেন। চিন্তাভাবনা করে ঠিক করলাম সুযোগটা গ্রহণই করি। তাই যথারীতি পরদিন দূতাবাসে গেলাম। ফ্যাক্সে আসা এফ.পি.সি’র চিঠি আমার হাতে তুলে দিয়ে তাজিকা বললেন, “ণড়ঁ ধৎব খঁপশু”. আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, একথা কেন বলছে? তাজিকার উত্তর, আগের একটি নাম টোকিও আমাদের অনুমোদনের পরও বাতিন করে দিয়েছে। আর তোমার বসয় বেশি দেখানো সত্ত্বেও গ্রহণ করেছে। তুমি তৈরি হতে থাক। আমি সেদেশের মৌলিক তথ্য সম্বলিত কিছু বই-প্রস্তক নিয়ে বাসায় ফিরে খবর জানালে সবাই খুশি হয়। দ্রুত তৈরি হতে থাকি। পুরো এক মাস দেশের বাইরে থাকতে হবে। তাই গোছগাছের প্রয়োজন।

সংবাদ পাঠানোর জন্য আই টি ইউ কার্ড ম্যানেজ করে দিলেন ইত্তেফাকের তৎকালীন বার্তা সম্পাদক সারওয়ার ভাই (মরহুম গোলাম সারওয়ার, তিনি দৈনিক যুগান্তর ও দৈনিক সমকালের সম্পাদক ছিলেন)। সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেল। টিকিট এল ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বিমানযোগে ব্যাংককে একরাত্রি থেকে পরদিন টোকিও-এ নারিতা বিমানবন্দর। ব্যাংকক থেকে যেতে হবে জাপান এয়ারলাইন্সে (জাল)। ১৪ তারিখ সকাল ৬টায় বাসা থেকে রওয়ানা দিতে হবে। তাই সব গোছগাছ করে ১৩ তারিখ রাতের খাবারের টেবিলে পারিবারিক বিভিন্ন কথা হচ্ছিল। স্ত্রী হাসিনাকে বেশ বিমর্ষ মনে হচ্ছিল। বড় ছেলে সাজেদুল হাসানের (নাসিম) এস.এস.সি পরীক্ষার্থী (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ইলেক্টিকের (জি ই) গবেষণা বিভাগের লিড ইঞ্জিনিয়ার) মন কিছুটা খারাপ। মেজ ছেলে ড. এস এম শামীমুল হাসান (আজিম) (যুক্তরাষ্টের সর্ব বৃহৎ গবেষণাগার ও সুপার কম্পিউটার কেন্দ্র টেনিসিতে অবস্থিত ঙধক গবেষনাগারে কর্মরত) বেশ উচ্ছ্বসিত। কি আনতে হবে তার বিবরণ দিচ্ছিল আজিম। আর ছোট ছেলে ডা. ফাহিম হাসানের বয়স মাত্র ১ বৎসর ৫ মাস (বর্তমানে সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অনারারী মেডিকেল অফিসার) সে তেমন কিছু বুঝে না, স্পষ্ট করে কথাও বলতে পারে না। আমার কিন্তু তার জন্যই চিন্তা হচ্ছিল বেশি। কেননা রাতে অফিস থেকে ফিরে এলে আমাকে দেখার পরই সে ঘুমায়। যাইহোক, তবুও যেতে হবে। তাই কোনো সমস্যা হলে অফিসে যোগাযোগ করার জন্য স্ত্রীকে পরামর্শ দেই। এপাশ-ওপাশ করে কাটিয়ে দিলাম রাত, কোন ঘুম হয়নি। স্ত্রীরও একই অবস্থা।

১৪ই সেপ্টেম্বর ভোর সাড়ে ৪টার দিকে বিছানা থেকে উঠে তৈরি হতে থাকি। সাড়ে ৫টার মধ্যে আমার গোসল, শেভ, কাপড় পরা হয়ে গেছে। গরম ভাত, তরকারী স্ত্রী টেবিলে সাজিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যেই। সবাই এক সঙ্গে খেলাম। আমর শ্যালক রেজাউল করিম আর ভাইয়ের শ্যালক আনোয়ার এসে গেছে। স্ত্রী-ছেলেরা বিমান বন্দরে কেউ যেতে পারবে না। বড় ছেলের টেস্ট পরীক্ষা আজই শুরু হচ্ছে। ছোট ছেলে পৌনে ৬টা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছিল। আমি তাকে কোলে তুলে নিলাম। চোখে ঘুম ঘুম ভাবই ছিল। সব তৈরি। গাড়ি নিয়ে ডাইভার নিচে অপেক্ষা করছে।

স্যুটকেস-ব্যাগ নিয়ে টিকিট, পাসপোর্ট, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পরীক্ষা করে এবার বের হওয়ার পালা। সবাই নিচে নেমে এলাম। ছোট ছেলেকে স্ত্রীর কোলে দিয়ে আমি যখন গাড়িতে উঠি তখন সকাল ৬টা। কাটায় কাটায় সাড়ে ৬টায় বিমান বন্দরে যেয়ে পৌঁছি। প্রথম শ্রেণীর টিকিট তাই কোথাও কোন সমস্যা হয়নি। বিমান বন্দরে সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে দোতলায় বলাকা লাউঞ্জে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। পরে প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের একটা গাড়িতে করে সোজা বিমানের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সে সময় বিমানবন্দরে এখনকার মতো হ্যাংগার ছিল না।

বাংলাদেশ বিমানের সময় নিষ্ঠা সম্পর্কে অভিযোগ থাকলেও আতিথেয়তার সুনাম আছে। বিমানে উঠার পর পরই ফলের রস দেয়া হয়। ছাড়ার পর নাস্তা। খাবার খুবই সুস্বাদু। আর গিফটও আছে। সোয়া দু’ ঘণ্টা বিমান ভ্রমণ শেষে ব্যাংকক বিমান বন্দরে গিয়ে অবতরণ করি বাংলাদেশ সময় ১১টা ১৫ মিনিটে। ব্যাংকক সময় তখন ১২টা ১৫ মিনিট। ঘড়ির সময় ঠিক করে নেই বিমান থেকেই। ব্যাংককের ভিসা নিয়ে যাইনি। বিমান বন্দরে তখন সহজেই ভিসা পাওয়া যেতো। (এখন বাঙালিদের জন্য বিমানবন্দরে ভিসা দেয়া দূরের কথা ঢাকার দূতাবাস থেকেও ভিসা নেয়া কঠিন)। বিশাল বিমানবন্দর। চিহ্ন দেখে দেখে ভিসা অফিসের সামনে হাজির হতেই দেখি অনেক বাঙালি লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দেখলেই বুঝা যায় এদের বেশির ভাগ চাকরির আশায় কোনো আদম ব্যাপারীর সাথে এখানে এসেছেন। সোনালী ভবিষ্যৎ তাদের প্রত্যাশা। কিন্তু চোখে মুখে অনেকেরই ভয়ের ছাপ। আমি ভিসা অফিসের সামনের গড়হবু ঊীপযধহমব (মুদ্রা পরিবর্তনকারী) বুথ থেকে ডলার ভাঙিয়ে বাথ করিয়ে নিয়ে ভিসার লাইনে দাঁড়াই। আধা ঘণ্টার মধ্যে ভিসা হয়ে যায়। তখন ব্যাংককে বিমান বন্দর থেকে ভিসা পাওয়া খুবই সহজ ছিল। আমাকে মাত্র ১০ দিনের ভিসা দেয়া হয় সাথে লিখে দেয়া হয় থাইল্যান্ডে চাকরি নিষিদ্ধ।

আরও পড়ুন- চেরি ফুলের দেশে- পর্ব ১

বাংলাদেশ জার্নাল/আর

  • সর্বশেষ
  • পঠিত