ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ মিনিট আগে
শিরোনাম

স্মরণ-

বন্ধন ছিন্ন করার ত্বরিকার বিপরীতে কবি কামরুজ্জামান চৌধুরী এক সম্পর্কের মশাল

  -এনামূল হক পলাশ

প্রকাশ : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০৫  
আপডেট :
 ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:১৯

বন্ধন ছিন্ন করার ত্বরিকার বিপরীতে কবি কামরুজ্জামান চৌধুরী এক সম্পর্কের মশাল

পনেরো ফেব্রুয়ারি সকালবেলা কবি তানভীর জাহান চৌধুরীর ফোনে আমার ঘুম ভাংলো। অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসলো, "কামরুল কাক্কু মারা গেছে শুনছস?"

এর একটু পরেই কবি শিমুল মিলকীর ফোন, "চলে আসো মোক্তারপাড়ায়।"

একই সময় বন্ধু আলোকচিত্রী শিল্পী বারীণ ঘোষ ফোন দিয়ে আবেগঘন কন্ঠে জানালো আমি শুনেছি কিনা। আমি তাকে মোক্তার পাড়ার দিকে আসতে বললাম।

আমি ফোন রেখে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পরলাম মোক্তারপাড়ার দিকে। কে নেই?

আমাদের যোগসূত্র কবি কামরুজ্জামান চৌধুরী নেই!

আমাকে আর ফোন দিবেন না? মানুষের প্রতি মানুষের দাবির জায়গায় দাঁড়িয়ে লড়াই করার মানুষটি নেই?

কে পূরণ করবে এই শুন্যস্থান?

কবি কামরুজ্জামান চৌধুরীর সাথে আমার পরিচয় বাইশ বছর আগে। আমি তখন বারহাট্টায় থাকি। তিনি একটি পত্রিকার ব্যুরো প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। আমার বন্ধু সঞ্জয় সরকার আমাকে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর সাথে। আমি নিয়মিত লেখা পাঠাতাম। কিছু লেখা সেই পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। আমার তখন বাউন্ডুলে জীবন। কর্মের নাই ঠিকঠাক। সাংবাদিকতা পেশা ত্যাগ করলেও সাংবাদিক সঞ্জয় সরকার আর কবি কামরুজ্জামান চৌধুরীর সাথে সম্পর্কের আর বিচ্ছেদ ঘটেনি।

আহা বকুলতলা। আহা পঁচিশ বছর। কি যে দাপট নেত্রকোণার কবিদের ছিলো একদিন। কবি কামরুজ্জামান চৌধুরী সাহিত্য সমাজের সভাপতি। আমি মফস্বল থেকে আসা এক তরুণ কবি, যার কবিতা আসলে হয় কিনা কেউ জানেনা। কামরুল ভাই আমাকে কবি ডেকেছেন। আমি কবি হয়ে গেছি। আমি কবি হয়ে গেছি। নেত্রকোণা সাহিত্য সমাজের সভাপতি সঙ্গোপনে আমার ভেতরের শক্তিকে চাঙ্গা করেছেন।

মফস্বলের হীনমন্যতা আমার ভেতরে ছিলো। ছিলো দাপুটে কবিদের অবজ্ঞা। সেইসব উপেক্ষা করে কবি কামরুজ্জামান চৌধুরী আমার হয়েছিলেন। আমিও তাঁর হয়েছিলাম। এই আভিজাত্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। কামরুজ্জামান চৌধুরী এমন একটি চেতনা যার আলো আমাদেরকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আভিজাত্য মানে জন বিচ্ছিন্নতা নয়, আভিজাত্য মানে সমাজের সকল মানুষের সাথে যোগসূত্র রচনা করা। কবি কামরুজ্জামান চৌধুরী ছিলেন সেইসব মানুষদের একজন যিনি যথাযথ অভিজাত ভদ্রলোক। আপাদমস্তক ভদ্রলোক।

তিনি শুধুমাত্র সাহিত্য সমাজের সভাপতিই ছিলেননা, কবি কামরুজ্জামান চৌধুরী ছিলেন পেশায় শিক্ষক, পদমর্যাদায় অধ্যাপক। তিনি ত্বরিকতের অনুসারী, ফুল- পাখি- নদীর প্রেমিক, সুজনের সহযাত্রী, বসন্তের অগমনী গানের গায়ক। খুব কম বলা হয়ে যায় তকমা দিলে তাঁকে। তিনি এক সমুদ্র ভালোবাসার ধারক।

পরবর্তীতে বৈবাহিক সূত্রে তিনি আমার আত্মীয় হওয়ায় আমাকে তিনি ভাগ্নি জামাই বলে সম্বোধন করা শুরু করলেন। এক সময় তিনি ভাই থেকে চাচা হয়ে গেলেন। আমি তাঁকে কামরুল কাক্কু বলে সম্বোধন করতাম। আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা বা মেনে চলাটা তাঁর জীবনের একটি বিশেষ দিক বলে আমি মনে করি।

তিনি বসন্ত ভালোবাসতেন। নিজেকে রাঙ্গিয়ে বসন্ত উৎসব করতেন। অলৌকিকভাবে তিনি বসন্তের প্রথম দিনের পর রাতে জীবনের মায়াবী ভ্রমণ সমাপ্ত করেছেন। লাশ নেয়া হয়েছে প্রিয় কলেজ প্রঙ্গণে, শহীদ মিনারে সর্বস্থরের জনতার ফুলে নিয়েছেন তিনি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা, বড় মসজিদে পড়া হয়েছে জানাজা। খবর পেয়ে পীর ভাই-বোনেরা এসেছেন দূর-দূরান্ত থেকে। ত্বরিকতের পীর ভাইয়েরা তাঁকে দাফন করেছেন পরম শ্রদ্ধা আর মমতায়। আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের বন্ধন ছিন্ন করার ত্বরিকার বিপরীতে কবি কামরুজ্জামান চৌধুরী এক সম্পর্কের মশাল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন এই সমাজ ব্যবস্থায়। তিনি থাকবেন। তাঁর আলো থাকবে।

লেখক- আচার্য, অন্তরাশ্রম

  • সর্বশেষ
  • পঠিত