ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৮ মিনিট আগে
শিরোনাম

কনডেমড সেল

  রাজীব কুমার দাশ

প্রকাশ : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৭:৩১  
আপডেট :
 ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৮:১৬

কনডেমড সেল
ফাইল ছবি

মো. রফিকুল ইসলাম। ছুঁই ছুঁই বয়স একচল্লিশ। পেশা: স্ক্রিপ্ট রাইটার, পিতার নাম মৃত: সফদার আমিন। নাদুসনুদুস লম্বাটে গড়ন। তামাটে গায়ের রং, অনুসন্ধিৎসু ধনুক চোখের স্হির দৃষ্টি সম্পন্ন জ্যা মণি, আধাপাকা চুল, আধপাগলা স্বভাব। মা'র নাম আছিয়া বেগম শিক্ষাগত যোগ্যতা বি, কম। গ্রাম: বেদনানগর থানা: ফটিকছড়ি, জেলা: চট্টগ্রাম।

এক সময়ের হাতপাকা তুখোড় কাহিনীকার রফিকুল ইসলাম এখন স্মৃতিপুর কারাগারে বন্দী দণ্ডিত ফাঁসির আসামি। তার কলম কাহিনীতে বেড়ে ওঠা উল্লেখ্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত ছায়াছবির মাঝে- ভুল জীবন, ত্রিশঙ্কু মন,প্রেম অপ্রেম, নন্দিত নিন্দিত মহাজীবন কাহিনী এখনো সিনেমা পিপাসুদের হৃদয় মুখে হাহাকার হয়ে পালিয়ে বেড়ায়। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান রফিক স্ক্রিপ্ট হাতে কলমে এ পর্যন্ত কারোর

সাহায্য না নিয়ে একাকি লিখে চলেছেন। প্রথম প্রথম অবশ্য এপার ওপার বাংলার সিনেমা পরিচালকরা তার লেখা স্ক্রিপ্ট নিয়ে বিস্তর সন্দেহ করতেন; তাঁদের ধারণা ভারতীয় দক্ষিণী সিনেমা কিংবা হলিউড মুভির হুবহু কিংবা আংশিক সংস্করণ।

তাঁর স্ক্রিপ্ট কাহিনী নিয়ে ত্রিতাপ ত্রিচারিণী ছবি নায়িকা রূষ্মিতা রাতারাতি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের সব বিভাগ জিতে প্রধানমন্ত্রী হাতের স্পর্শে একজীবনের অধরা স্বপ্ন হাতিয়ে নেন।

আধাআধি জীবন মানুষের অনেক কষ্টের। আধাআধি আশৈশব স্মৃতি ট্রায়াঙ্গল জীবনে বেড়ে ওঠা প্রেম বিরহ সংসার কারাগারে রফিকুল একাকি হেঁটে চলেছিলেন দিনের পর দিন। মরুবুকে কয়েক ফোঁটা জল চেয়ে কাতর পিপাসার্ত প্রাণী যেভাবে যন্ত্রনায় ছটফট করেন; কয়েকফোঁটা জলদাতা খোদা ঈশ্বরের কাছে আমৃত্যু দাসদণ্ডের নিক্তি মেপে স্বীকার করে নিতে জানেন যে প্রকারে বেঁচে থাকা প্রাণী; সে প্রকারে রফিকুলও বেঁচে থাকার আকুলিত সকাতর বন্দনায় প্রেম চেয়েছিলেন তাঁর স্ক্রিপ্ট নায়িকা রূস্মিতার জীবনে। সমুদ্রের খোলা বুকে তলিয়ে যাবার সময় বাঁচার প্রয়োজনে কে আপন কে পর যেমন বাছবিচার থাকেনা; সে মনে রফিকুলও জাস্ট বেঁচে থাকার আয়োজনে তাঁর সিনেমা নায়িকা রূস্মিতার কাছে চেয়েছিলেন আশ্রয়ণ প্রকল্পের মতো বাড়ি নয় আশ্রয়। প্রেম নয় দেখতে অবিকল প্রেমের মতোন আশ্রয় - প্রেমাশ্রয়।

স্ক্রিপ্ট নায়িকা রূস্মিতাও ছিলেন সংসার নামের কারাগারে ফাঁসি কনডেমড সেলের বন্দিনী। রফিকুলও রূস্মিতার জীবনবোধের সাদৃশ্য বৈশাদৃশ্য বিচারে - তারা উভয়েই এক সময়ে মুক্তিকামী ছিলেন। পরে রূস্মিতা সুখ বিলাসী মনে বুর্জোয়া প্রেমিকা হয়ে রফিকুলকে ছেড়ে নীরবে চলে যান।

মুক্তিকামীদের ঠেকাতে পেরেছে, এমন নজির পৃথিবীতে অনেক কম। দেহগত কোষগত মৃত্যু হয়েছে; আদর্শিক মুক্তিকামীদের ঠেকাতে অসুর রক্তবীজ বার বার জন্মেও পারেনি; যে প্রকারে ঠেকাতে পারেননি বলিভিয়ার জঙ্গলে চে গুয়েভারা হত্যা।

রফিকুল হাতের স্ক্রিপ্ট ছবি ' ত্রিতাপ ত্রিচারিণী ' মুক্তি পেয়েছে গেলো নভেম্বর মাঝামাঝি সকাল আটটে কিংবা ন'টা সময়ে। ও দিনের মিনিট চার পাঁচেকের স্ক্রিপ্ট দেহদানে নায়িকা রূস্মিতা ধন্য হয়েছিলেন ঘরোয়া জুরি বোর্ডের সন্মানে। তাঁকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি কখনো। যেখানে যাচ্ছে সেখানে সুললিত ধন্য ধন্য শিহরণ গর্জনে ভেসে চলেছেন।

শেষমেশ মো: রফিকুলের 'ত্রিতাপ ত্রিচারিনী' ছবির স্ক্রিপ্ট লেখার অপরাধে হৃদয়সংঘ মানবাধিকার কমিশনের উপ-পরিচালক মামলা ঠুকে দেন।

দীর্ঘ তদন্ত শেষে ত্রিতাপ ত্রিচারিণী ছবির নারী পরিচালক, নায়ক নায়িকা খলনায়ক পার্শ্বচরিত্র সবাই নেচে গেয়ে বেড়িয়ে গেলেন। শুধুমাত্র বেচারা স্ক্রিপ্ট রাইটার সহজ সরল রফিকুল আসল সত্যটা না বলে ফেঁসে গেলেন।

আজ শুক্লপক্ষের দ্বিপ্রহর রাত। বুড়িগঙ্গা সেন্ট্রাল কমাণ্ড কারাগার প্রস্তুত। 'এখনো বেঁচে আছি ' ছবির স্ক্রিপ্ট জেলারের হাতে রফিকুল সন্ধ্যের দিকে জমা দিয়েছেন। বাম রাজনীতি করা নতুন পরিচালক স্ক্রিপ্ট নিতে জেলারের অফিস রুমে সে বিকেল হতে বসে আছেন।

আজ রফিকুলের শেষ চন্দ্রদর্শন। ধারদেনাহীন হৃদয়টা রফিকুলের অনেক আগেই শান্ত হয়ে গেছে। শেষ খাবারের ফরমায়েশ পেয়ে জেলারের পিলে চমকে গেলেন। জেলার সাহেব অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্হা করে পায়চারি করে ভাবছেন,' আহা! স্ক্রিপ্ট রাইটার মো: রফিকুল সত্যিই কী অপরাধী ছিলেন? ' ধূর! আমি এ কী ভাবছি? সে ভাবনা আমার নয়; সে ভাবনা রাষ্ট্র সংবিধানের। সে একান্ত ভাবনা বিজ্ঞ মহামান্য মনের।

আমার কাজ হলো, দ্বিপ্রহর রাতে প্রকৃতিমাতা যখন ঘুমিয়ে পড়েন, মোক্ষম সময়ে বেছে বেছে দেয়া প্রকৃতি মাতার আদুরে সক্রেটিস সন্তানদের হত্যা করা।

দু'চারটে লক্ষী পেঁচার আনাগোনা চলছে। উপরে তাকানো নিষেধ। হাতদুটো পিছমোড়া। ফাঁসির মঞ্চের দিকে স্বাভাবিক পায়ে হেঁটে চলেছে কবি - রফিকুল। তার শেষ কবিতা লেখা নিষেধ।

মো: রফিকুল ইসলাম ফাঁসি মঞ্চ পাটাতনের উপরে দাঁড়িয়ে। যমটুপি নিজের হাতে পরে নিতে চাইলেন। তাও পারলেন না।

পরে জল্লাদ বাহাদুরের মুখে শোনা তাঁর - শেষ কবিতার ক'টি লাইন পাঠকদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করছি।

'এখনও অনেক রাত বাকি চন্দ্রবৃষ্টির শেষ প্রার্থনায় ছিলাম;

কী রকমের ছিলাম কী রকমের আছি?

ছিলো হয়তোবা আমার জীবনটা

আনা আনা ষোলোআনা শূন্যের শূন্যভরা মিছে ফাঁকি;

এখনও অনেক রাত বাকি।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কবি, পুলিশ পরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ। মেইল: [email protected]

  • সর্বশেষ
  • পঠিত