ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২ মিনিট আগে
শিরোনাম

রিপোর্টার থেকে সম্পাদক (পর্ব -৭)

  শাহজাহান সরদার

প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০১৯, ১৭:৪২  
আপডেট :
 ২১ নভেম্বর ২০১৯, ১৭:৪৬

রিপোর্টার থেকে সম্পাদক (পর্ব -৭)

[দেশের জনপ্রিয় দুটি পত্রিকার (যুগান্তর, বাংলাদেশ প্রতিদিন) জন্মের পেছনের ইতিহাস, কর্তৃপক্ষের চাপিয়ে দেয়া বিব্রতকর বিভিন্ন আদেশ নির্দেশ, হস্তক্ষেপ, পত্রিকা প্রকাশের ওয়াদা দিয়ে অন্য একটি জনপ্রিয় পত্রিকা থেকে নিয়ে এসে পত্রিকা না বের করে হাতজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে বিদায় দেয়া, পত্রিকা প্রকাশের পর কোন কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কিছু দিনের মধ্যেই ছাপা সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে লাভ খোঁজা, ইচ্ছেমত সাংবাদিক-কর্মচারি ছাঁটাই করা সহ পত্রিকার অন্দর মহলের খবরা-খবর, রাজনৈতিক মোড় ঘুড়িয়ে দেয়া কিছু রিপোর্ট, সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির কিছু ঘটনা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে আমার এ বই ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’। জানতে পারবেন সংবাদপত্র জগতের অনেক অজানা ঘটনা, নেপথ্যের খবর।]

(পর্ব -৭)

জানতে চাইলাম, আপনার সাথে কি পরিচয় আছে? বললেন, আছে। কীভাবে জানতে চাইলে বলেন, তিনি জেলে থাকার সময় তার মুক্তি দাবি করে আবেদ সাহেব ভোরের কাগজে একটি লেখা লিখেছিলেন। সেই সুবাদে জেল থেকে বের হবার পর পরিচয় হয়। তখন বললাম, তাহলে আপনি যোগাযোগ করলেই ভাল হয়। আমি তো বাইরের মানুষ। বাবুল সাহেব বললেন, যুগান্তর প্রতিষ্ঠায় আপনার ভূমিকার কথা সবাই জানে। আপনি প্রথম কথা বলেন, পরে আমি বলব। আর রাজি না হয়ে পারলাম না। বললাম ঠিক আছে ফোনে কথা বলব। রাতে আবেদ সাহেবকে ফোন দিলাম। আবেদ খান থাকেন উত্তরায় আর আমি ধানমন্ডি। ভোরের কাগজ অফিস তখন বাংলামটর। কুশল বিনিময়ের সাথে জানতে চাইলাম কাল সকালে অফিসে আসবেন কিনা। আমি দেখা করতে চাই। কিছু কথা আছে। পরদিন ছিল হরতাল। আবেদ সাহেব জানালেন, হরতালে সকালে তিনি আসবেন না। বিকালে আসবেন। বিকালে সংবাদপত্রে কাজ থাকে বেশি। কথা বলা সম্ভব নয়। তাই বললাম সকালে আমি আপনার বাসায় আসব। হরতালে বেবিট্যাক্সি নিয়ে রিপোর্টররা সংবাদ সংগ্রহের কাজে চলাচল করে, তাই সহজেই উত্তরা যাওয়া যাবে। তিনি বললেন, তুমি এসো, আমি অপেক্ষা করব। রাতে অফিস থেকে যাবার সময় অ্যাসাইনমেন্ট খাতায় দেখি আমারও হরতাল ডিউটি। লেখা ‘হরতাল কম্পাইল’, মানে হল হরতালের সব খবর জেনে মূল নিউজটি তৈরি করতে হবে। অফিস থেকে আসার সময় বেবিট্যাক্সিওয়ালাকে বললাম সকাল ৯টার মধ্যে যেন আমার বাসায় আসে। আমি উত্তরা এলাকায় যাব।

পরদিন সকালে বেবিট্যাক্সি এলো। আমি রওনা দিলাম। উঠতেই বেবিট্যাক্সিওয়ালা জানাল, ফেরার সময় মিলন সাহেবকে (জাকারিয়া মিলন) নিয়ে আসতে হবে। তার বাসাও উত্তরায়। মিলন সাহেব ভাল রিপোর্টার ছিলেন। ক্রাইম রিপোর্টার। কয়েকবছর আগে মারা গেছেন। বেবিট্যাক্সি থেকেই আমি মিলন সাহেবকে ফোন দিলাম, আমি উত্তরা আসছি। ফেরার সময় আপনাকে নিয়ে যাব। আবেদ সাহেবও ফোন দিলাম, আমি রওনা হয়েছি। উত্তরা রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্সের কাছে গিয়ে মনে হল, এভাবে খালি হাতে যাওয়া ঠিক হবে না। বেবিট্যাক্সি থেকে নেমে কিছু মিষ্টি নিলাম। ১০টার মধ্যেই আবেদ সাহেবের বাড়িতে পৌঁছি। তখন বাড়িটি ছিল ছোট, ছিমছাম। সামনে লন, যাতে উন্নত রুচির পরিচয় বহন করে। এখন ফ্ল্যাট বাড়ি করেছেন। আবেদ সাহেব আর ভাবি দু’জনই বাসায় থাকেন। একমাত্র ছেলে বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে এসে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। বসতেই চা মিষ্টি এল। কথা হল। খুলে বললাম বাবুল সাহেবের প্রস্তাব। জবাবে আবেদ সাহেব বললেন, এখনই আমর পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। কেননা এখন ভোরের কাগজে আছি। সহসা ছাড়তে পারব না। তবে বিষয়টি নিয়ে আমার দু’জন অভিভাবকের সাথে কথা বলব। তারা সম্মতি দিলে আমি ভোরের কাগজ থেকে গুটিয়ে নিব। এখানেই কথা শেষ। বিদায় নিয়ে মিলন সাহেবকে তুলে প্রেসক্লাবে আসি। প্রেসক্লাবে মিলন সাহেবকে নামিয়ে আমি যাই সেনাকল্যাণ ভবনে বাবুল সাহেবের অফিসে। বাবুল সাহেবকে আবেদ সাহেবের বক্তব্য জানালাম এবং বললাম, সারওয়ার সাহেব তো আছেন। আপনি আলোচনা করুন। না হয় ধৈর্য ধরুন। আমি আবারো বলি সমঝোতায় পৌঁছতে পারলে যুগান্তরের জন্য ভাল হবে। বাবুল সাহেব বললেন, আমি তো তাকে চলে যেতে বলছি না। কিন্তু উনি চলে যাবেন বুঝতেছি, আমি এত শিল্প-প্রতিষ্ঠান চালাই আমার কাছে খবর থাকবে না?

আমি আর কথা না বাড়িয়ে বলি কিছুদিন অপেক্ষা করেন। আগে দেখেন কি হয়। পরে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। আসলে আমি ছিলাম অন্ধকারে। ভিতরে ভিতরে যুগান্তরে বড় ধরনের কোন্দল চলছিল। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া দুটি গ্র“পে বিভক্ত হয়ে পড়ে সাংবাদিক কর্মচারীরা। একটি সম্পাদককে ঘিরে, আর একটি মালিককে ঘিরে। আমার সাথে কোনো পক্ষেরই যোগাযোগ না থাকায় আমি জানতাম না। আর ঊর্ধ্বতন দু’এক জন ছিলেন যারা দু’দিকেই সমানভাবে যোগাযোগ রাখতেন। দু’পক্ষের কাছেই খবরাখবর দিয়ে দু’দিকে বেশ ভাল অবস্থান করে নেন। যেদিকে সুবিধা, সুযোগ বুঝে সে দিকে ঝুঁকবেন এমন একটি অবস্থা ছিল। সারওয়ার সাহেবের মধ্যে একধরনের সরলতা আছে। অনেক কথা অনেকের সামনে বলে ফেলতেন। তার এই সরলতার সুযোগ কাজে লাগিয়েছিল উচ্চাভিলাষী কেউ কেউ। দুপক্ষের কাছেই সুযোগ বুঝে কথা লাগিয়ে প্রিয় থাকতে চেয়েছেন। এরা কেউ কেউ দু’জনের মধ্যে সম্পর্কের তিক্ততাও সৃষ্টি করেন। যা আর সমঝোতায় পৌঁছানোর মতো ছিল না। বাবুল সাহেব বেশি কথার মানুষ নন। যা বুঝেন তাই করেন। আগেই বলেছি সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেন না। তার কাছে তথ্যপ্রমাণসহ এমন কেউ হয়তো কিছু বলেছে যে সারওয়ার সাহেব থাকবেন না। তাই তিনিও আগেই নতুন সম্পাদক ঠিক করে রাখতে চান। আমি ওঠার আগে বাবুল সাহেবকে আবার বললাম, কিছুদিন অপেক্ষা করেন দেখেন কী হয়? আমিও ভাবি।

কয়েক সপ্তাহ পর আরেক বিকেল। বাবুল সাহেবের ফোন। আমি অফিসে। এর মধ্যে দু’একবার তার সাথে কথা হয়েছে। তবে নতুন সম্পাদক নিয়োগ নিয়ে তেমন তাড়া ছিল না। তাই ফোন পেয়ে সিরিয়াস কিছু মনে করিনি। তিনি বললেন, এখনই কিছুসময়ের জন্য অফিসে আসেন। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিছুদিন আগে মাত্র আমি ইত্তেফাকে চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। বিকালে কপি দেখে ছাড়তে হয়। বের হওয়া কঠিন। বাবুল সাহেবকে বললাম, কাল সকালে আসি। তিনি বললেন, না এখনই। গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। এক সহকর্মীকে দায়িত্ব দিয়ে সেনাকল্যাণ ভবনে গেলাম। গিয়ে দেখি যমুনা গ্র“পের এক জিএম একটি টাইপ করা কাগজ পাঠ করছেন। বাবুল সাহেব ও তার একমাত্র ছেলে শামীম ইসলাম মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। আমি ঢুকতেই বাবুল সাহেব বললেন, সারওয়ার সাহেব পদত্যাগ করেছেন। আমার সাথে আলোচনা না করে কিছু না জানিয়ে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। এই পদত্যাগপত্রটি জিএম সাহেব আমাকে শোনানোর জন্য আবার পাঠ শুরু করলেন। আমি শুনলাম। বাবুল সাহেব বললেন, আমি জানতাম তিনি পদত্যাগ করবেন। কিন্তু না জানিয়ে এভাবে করবেন জানা ছিল না। এখন তাড়াতাড়ি সম্পাদক ঠিক করতে হবে। বাবুল সাহেব জানালেন, তার কাছে খবর আছে বিভাগীয় প্রধানদের কেউ কেউ দু’একদিনের মধ্যে পদত্যাগ করবেন। ইতোমধ্যেই বিজ্ঞাপন বিভাগের প্রধানসহ কয়েকজন পদত্যাগ করেছেন। তার ধারণা মতে, সারওয়ার সাহেব বেশি বেতন দিয়ে অনেককে নিয়ে যাবেন। যাতে যুগান্তর প্রকাশ অসম্ভব হয়ে পড়বে। কেননা সারওয়ার সাহেব এরই মধ্যে অন্য জায়গায় যোগদান করেছেন। তাদেরও নিয়ে যাবেন। সাত দিন থেকে দেড় মাসের মধ্যে এ ঘটনা ঘটতে পারে। কেননা সে-সময়টায় বেতনের বাকি ছিল সাত দিন। আর দেড়মাস পর ঈদ হবে। তাই যারা যাবেন তাদের বেশিরভাগই অপেক্ষা করবেন। তাই তাড়াতাড়ি একজন সম্পাদক নিয়োগ দিতে হবে। এত তাড়াতাড়ি সম্পাদক পাওয়া কীভাবে সম্ভব?

আমাদের আলোচনার মধ্যে যুগান্তরের একজন সিনিয়র সাংবাদিক এলেন। তিনি অনেক ঘটনা জানেন। তার কাছ থেকে বাবুল সাহেব অনেক খবর নিলেন। আমি শুনলাম সব। সারওয়ার সাহেব চলে যাওয়ার পর দায়িত্বশীল কেউ দ্বিমুখী ভূমিকা পালন করছেন। উস্কানি দিচ্ছেন। সারওয়ার সাহেব চলে গেলে যুগান্তর চলবে না এমন গুজবও ছড়াচ্ছেন। সারওয়ার সাহেববের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগও রাখছেন। সুযোগ বুঝে পা বাড়াবেন। আবার বাবুল সাহেবকে বোঝাচ্ছেন অন্যভাবে। তার কথা শুনে বাবুল সাহেবও বললেনÑআমি জানি, তার সম্পর্কে সবই জানি। এরপর ওই সিনিয়র সাংবাদিককে বাবুল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আতাউস সামাদের সাথে কথা হয়েছে? তিনি জানালেন হয়েছে। তবে ফলাফল ইতিবাচক নয়। আমি বুঝলাম তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে সম্পাদক খুঁজছেন। এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, শিগগিরই একটি ব্যবস্থা করতে হবে। আমি বললাম, আপনারাও চেষ্টা করেন আমিও করছি। কিন্তু বাবুল সাহেবের ত্বর সইছে না।

চলবে...

বইটি পড়তে হলে সপ্তাহের রবি, মঙ্গল, বৃহস্পতিবার চোখ রাখুন ‘বাংলাদেশ জার্নাল’ অনলাইনে।

বইটি প্রকাশ করেছে উৎস প্রকাশন

আজিজ সুপার মার্কেট (তৃতীয় তলা), ঢাকা।

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে ক্লিক করুন

  • সর্বশেষ
  • পঠিত