ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৬ মিনিট আগে
শিরোনাম

রিপোর্টার থেকে সম্পাদক (পর্ব -৯)

  শাহজাহান সরদার

প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০১৯, ১১:৫৪  
আপডেট :
 ২৮ নভেম্বর ২০১৯, ১২:০২

রিপোর্টার থেকে সম্পাদক (পর্ব -৯)

[দেশের জনপ্রিয় দুটি পত্রিকার (যুগান্তর, বাংলাদেশ প্রতিদিন) জন্মের পেছনের ইতিহাস, কর্তৃপক্ষের চাপিয়ে দেয়া বিব্রতকর বিভিন্ন আদেশ নির্দেশ, হস্তক্ষেপ, পত্রিকা প্রকাশের ওয়াদা দিয়ে অন্য একটি জনপ্রিয় পত্রিকা থেকে নিয়ে এসে পত্রিকা না বের করে হাতজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে বিদায় দেয়া, পত্রিকা প্রকাশের পর কোন কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কিছু দিনের মধ্যেই ছাপা সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে লাভ খোঁজা, ইচ্ছেমত সাংবাদিক-কর্মচারি ছাঁটাই করা সহ পত্রিকার অন্দর মহলের খবরা-খবর, রাজনৈতিক মোড় ঘুড়িয়ে দেয়া কিছু রিপোর্ট, সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির কিছু ঘটনা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে আমার এ বই ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’। জানতে পারবেন সংবাদপত্র জগতের অনেক অজানা ঘটনা, নেপথ্যের খবর।]

(পর্ব -৯)

কেন সে থাকল না। আমি বললাম, সারওয়ার সাহেব আমাকে এ বিষয়ে কিছুই বলেননি। তবে বাবুল সাহেব তার মতো করে বলেছে। সারওয়ার সাহেব না বললে তো আমি জিজ্ঞেস করতে পারি না। মূসা সাহেব বললেন তা ঠিক। আচ্ছা শোন, আমি যেতে পারি কিন্তু কথায় কথায় ওই ১২ তলায় ডেকে নেয়া যাবে না। আমি আমার মতো কাজ করব। আমি যোগ দিলে মালিক পক্ষ কেউ কথা বলতে চাইলে আমার সঙ্গে অফিসে এসে কথা বলতে হবে। ১২ তলা বলতে তিনি সেনাকল্যাণ ভবনে বাবুল সাহেবের যমুনা গ্রুপের অফিসকে বুঝিয়েছেন। আমি বললাম, আপনি রাজি থাকলে আমি এসব কথা বলে নেব। তবে প্রথম দিনতো যেতে হবে। সবকিছু ঠিকঠাক করতে হবে। তিনি রাজি হলেন। আমি বাবুল সাহেবকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করি। তিনি বললেন, আমিই মূসা সাহেবের বাসায় আসব। তখন মূসা সাহেব জানান, ঠিক আছে আমিই যাব। ঠিক হলো। পরদিন ১১টায়। সকালে প্রেসক্লাব থেকে আমাকে নিয়ে যেতে হবে। কথা বলে ফিরে এলাম। পরদিন সকালে মূসা সাহেবকে নিয়ে গেলাম বাবুল সাহেবের অফিসে। এ সময় তার ছেলে শামীম ইসলামও ছিলেন। তিনি যুগান্তরের মালিকানা প্রতিষ্ঠান যমুনা মিডিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এখন যমুনা টিভিরও একই পদে আছেন।

বাবুল সাহেবই কথা শুরু করলেন। বললেন, মূসা সাহেব আপনি মুরব্বি মানুষ। আপনি আমার পত্রিকার দায়িত্ব নেন। আপনার মতোই চালাবেন। মূসা সাহেব বললেন, ঠিক আছে, কিন্তু সারওয়ার গেল কেন? বাবুল সাহেব উত্তর দিলেন। এমন সময় মূসা সাহেব বললেন, আমি আসতে পারি কিছু শর্ত আছে। সকালে ঘণ্টাখানেক থাকব। আর বিকালে এসে রাত ৮টা পর্যন্ত। আর শর্ত, সরদারকে আমার সঙ্গে থাকতে হবে। আমি একা পুরো সামলাতে পারব না। সরদার মানে আমি। এবার আমি বেকায়দায়। ইত্তেফাকের চাকরি মানে নিরাপদ। যুগান্তর বের হওয়ার সময়ও সারওয়ার সাহেব একই কথা বলেছিলেন। আবার আমি সমস্যায় পড়লাম। মূসা সাহেব তার যোগদানের শর্ত হিসেবে আমাকে সঙ্গে যাবার প্রস্তাবে বাবুল সাহেব বললেন, শাহজাহান ভাই এবার আপনাকে আসতে হবে। আমি কোন কথা শুনবো না। আপনাকেই সব দায়িত্ব নিতে হবে। আসলে বাবুল সাহেবের সঙ্গে আমার দীর্ঘ পারিবারিক সম্পর্ক। বয়সে বড় হলেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তাই আমি দূরেই থাকতে চেয়েছি। কিন্তু এবার আমি বেশ এড়াতে পারলাম না। দুজনের সামনা-সামনি কিছু বলাও সম্ভব নয়। বাবুল সাহেব একদিনও সময়ক্ষেপণ করতে চান না। অগত্যা আমাকে রাজি হতে হলো। তবে কয়েকদিন সময় দিতে হবে। কেননা ইত্তেফাকে এত বছরের চাকরি কয়েকদিন সময় না দিয়ে আসা কঠিন।

মূসা সাহেব বললেন, সময় দেয়া যাবে না। জবাবে আমি বললাম, আপনি যোগদান করেন। আমার আসতে কমপক্ষে সপ্তাহখানেক লাগবে। কেন না মাত্র কয়েকদিন আগে আমি ইত্তেফাকের চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব পেয়েছি। মঞ্জু সাহেবকে (আনোয়ার হোসেন মঞ্জু) ভালভাবে বলে আসতে হবে। তিনি আমাকে তার পরিবারের সদস্যের মতো ভালোবাসেন। এ-কথা বলার পর মূসা সাহেব আমাকে কয়েকদিন সময় দিতে রাজি হলেন। তবে তার যোগদানের বিষয়ে চূড়ান্ত কথা হলো। একই দিনে তার সঙ্গে চুক্তিপত্র স্বাক্ষর হলো। পরদিন তিনি সম্পাদক পদে যোগ দিলেন। যুগান্তরে সম্পাদক হয়ে মূসা সাহেবের যোগদানের আগে কিন্তু সাংবাদিক মহল এমনকি যুগান্তরের দু’একজন মধ্যম সারির সাংবাদিক ছাড়া অন্য কোনো সাংবাদিক কর্মচারি জানতেন না। সবাই আশ্চর্য হলেন। মূসা সাহেব কাজ শুরু করলেন। রোববার আমার যোগদান করতে হবে। বৃহস্পতিবার মূসা সাহেব ফোন করলেন। ইত্তেফাক থেকে বিদায় নেয়া আমার জন্য খুব কঠিন কাজ। কিন্তু বিদায় না নিয়ে তো আর আসা যাবে না। কারণ ইত্তেফাক আমাকে অনেক যশখ্যাতি এনে দিয়েছে। আর এখনও অনেকে শাহজাহান সরদার বলতে আমাকে ইত্তেফাকের শাহজাহান সরদার বুঝে। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আমাকে অনেক স্নেহ করেন। তার কাছ থেকে বিদায় নেয়া সত্যিই কঠিন।

সারারাত টেনশনে ঘুমাতে পারিনি। শুক্রবার সকালে উঠেই মঞ্জু সাহেবকে ফোন করে বাসায় গিয়ে দেখা করার অনুমতি চাই। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, চলে আসো। আমি গেলাম। অনেক কথা-রাজনীতি, ইত্তেফাক প্রসঙ্গ ইত্যাদি। অবশেষে কথা তুললাম। ‘মঞ্জু ভাই’ আপনার কাছ থেকে বিদায় নিতে চাই। তিনি কিছু বুঝলেন বলে মনে হলো না। বললেন, যাও, কাল দেখা হবে আবার। আমি তখন বললাম, আমি ইত্তেফাক থেকে চাকরি ছেড়ে যুগান্তরে যোগ দিতে চাই। তিনি এ কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। আমিই আবার কথা তুললাম, মঞ্জু ভাই আমি এখন চিফ রিপোর্টার আছি, যুগান্তরে উপ-সম্পাদক পদে যাচ্ছি। মূসা সাহেব সম্পাদক। তারপরই আমার অবস্থান। আপনি দোয়া করবেন। আমি সালাম করলাম। উনি কিছুই বললেন না, চেয়ে রইলেন। আমি চোখে পানি নিয়ে বের হয়ে আসি। ঠিক এ সময়ই মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী মঞ্জু সাহেবের বাসায় প্রবেশ করছিলেন। বাসার লনে চোখ মুছতে মুছতেই তার সঙ্গে আমার দেখা। ২০০৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সকালে অফিসে গিয়ে আমি পদত্যাগপত্র দাখিল করি। সেদিন ছিল সম্পাদকের সাথে রির্পোটারদের সাপ্তাহিক সভা। রির্পোটাররা সবাই উপস্থিত ছিলেন। আমি তাদেরসহ অন্যান্য সাংবাদিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে বিদায় নিই। রিপোর্টাররা সম্পাদক মঞ্জু সাহেবের বৈঠকে যোগ দিতে চলে গেলেন। আর আমি ব্যক্তিগত কিছু কাগজপত্র নিয়ে সোজা বাসায় ফিরি। পরদিন রোববার সকালে পূর্ব-কথামতো সেনাকল্যাণ ভবনে যাই। সেখান থেকে বাবুল সাহেব আমাকে নিয়ে গেলেন যুগান্তর অফিসে। মূসা সাহেব অপেক্ষা করছিলেন। ছোট একটা বৈঠক হলো। ১২ সেপ্টেম্বর যুগান্তরের উপ-সম্পাদক পদে যোগ দিলাম। মূসা সাহেব হলেন আমার সম্পাদক।

বাবুল সাহেব কিছুক্ষণ থেকে চলে গেলেন। যাবার আগে যুগান্তর অফিসে চেয়ারম্যানের জন্য অর্থাৎ তার যে রুমটি সংরক্ষিত ছিল সেটিতে আমাকে বসিয়ে দিয়ে গেলেন। বেশ বড় রুম। ইত্তেফাকে আমার বসার রুম ছিল না। অফিসের উন্মুক্ত চেয়ার-টেবিলে বসেছি। একটু বিব্রত হচ্ছিলাম। পরে অবশ্য রুমটি ছোট করে ও চেয়ার-টেবিল পাল্টে বসা শুরু করি। বাবুল সাহেবের বিদায়ের পর অফিসে উপস্থিত যারা ছিলেন সবার সঙ্গে পরিচিত হয়ে মূসা সাহেবের সঙ্গে বৈঠকে বসলাম। মূসা সাহেব বললেন, ‘বিরাট চ্যালেঞ্জ। আমারে নিয়া আইলা এখন কীভাবে সামলাবা’।

বিষয়টি হলো, সারওয়ার সাহেব চলে যাওয়ায় এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন তার সঙ্গে চলে গেছেন। আরও অনেকে চলে যাবেন এমন শঙ্কা। যা বাবুল সাহেব আগেই ধারণা দিয়েছিলেন। তবে সংকট যে এতটা তা ভাবিনি বা বিশ্বাস করিনি। মূসা সাহেব কয়েক দিন ধরে কাজ করছেন, তাই তিনি সব বিষয়ে অবহিত হয়েছেন। আমি তাকে আশ্বস্ত করি, ব্যবস্থা হয়ে যাবে। খবর নিতে থাকলাম। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। অফিস থেকে বের না হয়ে পরিস্থিতি জানার জন্য অনেকের সঙ্গেই কথা বলতে থাকি। বুঝলাম অবস্থা মূসা সাহেব যা বললেন, তাই। কেননা সারওয়ার সাহেব যুগান্তর গড়েছিলেন, তিনি চলে যাওয়ায় অনেকের এমন বিশ্বাস ছিল, এ কাগজ আর চলবে না। আমি সন্ধ্যায় আবার মূসা সাহেবের সঙ্গে বসলাম। জানালাম ঘটনা ঠিক। অনেকেই থাকবে না, তবে আপনি আসায় আবার অনেকে আশ্বস্তও হয়েছেন। তিনি বললেন, আমি এতকিছু জানি না, কী করবা কর, বেইজ্জতি যেন না হই। আমি বললাম, আপনি সকাল-বিকাল আসেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।

চলবে...

বইটি পড়তে হলে সপ্তাহের রবি, মঙ্গল, বৃহস্পতিবার চোখ রাখুন ‘বাংলাদেশ জার্নাল’ অনলাইনে।

বইটি প্রকাশ করেছে উৎস প্রকাশন

আজিজ সুপার মার্কেট (তৃতীয় তলা), ঢাকা।

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে ক্লিক করুন

  • সর্বশেষ
  • পঠিত