সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন চাই
পরিতোষ দেবনাথ
প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ২১:১৭
মায়ের ভাষার শক্তিই বড় শক্তি। ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের মধ্যে নিবিড় এক আত্মীয়তার বন্ধন মাতৃভাষা। ভাষার উপর দাদাগিরি করে যে প্রভুত্ব বজায় রাখা যায় না তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ বাংলাদেশ। বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা। এই ভাষার টানে, ভাষার দাবিতে বাঙালি জাতি স্বৈরাচারের সকল দম্ভ পদানত করে বাংলা ভাষাকে সমুন্নত রেখেছে।
দুইশত বছরের শাসনের পরে ভারতের মাটি থেকে বিদায় নেয় ব্রিটিশ সরকার এবং ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি দেশ। জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তানের পার্লামেন্টে তৎকালীন পূর্ব বাংলার কংগ্রেস নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এর প্রতিবাদ করেন। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ জিন্নাহ সাহেব ঢাকা সফরে এসে এক সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘উর্দু, কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ প্রতিবাদে গর্জে উঠে পূর্বে বাংলার ছাত্রসমাজ। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা মর্যাদার দাবিতে গড়ে ওঠে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা অমান্য করে ছাত্রসমাজ, প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা ৫ জন ১০ জন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতে মিছিল বের করেন। এক সময় মিছিল বিক্ষোভে রূপ নেয় । ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার অজুহাত দেখিয়ে পুলিশ দুপুর বেলায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি তখনকার প্রাদেশিক আইন পরিষদ বর্তমান জগন্নাথ হলের সামনে মিছিলের উপর গুলি চালায়। গুলিতে নিহত হন রফিক, বরকত, সালাম, জব্বার। রক্তে ভেসে যায় রাজপথ। আহত হন আরও ১৭ জন। সালামের লাশ নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঢুকে পড়েন সৈয়দ আশরাফ হোসেন। সেখানে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তার ভাই ডাক্তার ফজলুর রহমান। তিনি বরকতের রক্তমাখা শার্ট সৈয়দ আশরাফের হাতে দিয়ে পালিয়ে যেতে বলেন। তিনি বন্ধু আব্দুল লতিফকে সাথে নিয়ে বরিশাল-ভোলা হয়ে পটুয়াখালীতে গিয়ে ছাত্র গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বহির্বিভাগের বারান্দায় পড়ে থাকা শহীদ রফিকের লাশ দেখতে ছুটে গিয়েছিলেন রফিকুল ইসলাম, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, শফিকুর রহমানসহ অনেকে।
২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ রফিকের লাশ দেখে ঢাকা কলেজের ছাত্র আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর শোকার্ত হৃদয়ে অনুরণিত হয় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। গাফ্ফার চৌধুরীর শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। তিনি থাকতেন আজিমপুরে ৮/আই কলোনিতে। সেখানেই ছিল ভাষা আন্দোলনে বামপন্থীদের হেডকোর্য়াটার। পাতা-২
আর একজন প্রগতিবাদী বিখ্যাত দার্শনিক অধ্যাপক সাইদুর রহমান তখন ঢাকা কলেজের বেগম বাজারস্থ ‘নুপুর ভিলা’ নামক ছাত্রাবাসের সুপারিনটেনডেন্ট। তাঁর সন্তান শফিক রেহমান থাকতেন হোস্টেলের গেস্ট হাউজের দোতালায়। সেখানে বসে গাফ্ফার চৌধুরী লিখে ফেলেন একুশে ফেব্রুয়ারি কবিতার আরও কিছু অংশ।
২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে ভাষা শহীদদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় । ইমামতি করেন জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। জানাজা শেষে বের হয় বিশাল এক মিছিল।
২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকারের বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি মিছিলের ওপর পুলিশের গুলিতে নিহত হন শফিউর রহমান শফিক, রিকশাচালক আউয়াল এবং একজন কিশোর। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে জেলা ও মহকুমা শহরে।
একুশের কদিন পরেই প্রকাশিত হয় রক্তঝরা ভাষা আন্দোলনের প্রথম ইশতেহার। ইশতেহারের অধিকাংশ পাতা জুড়ে ছিল আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিনের লেখা এবং দ্বিতীয় পাতায় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কবিতা ‘একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’। প্রগতিবাদী সঙ্গীত শিল্পী ও সুরকার আব্দুল লতিফের চোখে পড়ে একুশের হৃদয় ছোঁয়া এই কবিতা। ১৯৫৩ সালের প্রথম শহীদ দিবসে ঢাকা কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের অভিষেক অনুষ্ঠানে আতিকুল ইসলাম সর্বপ্রথম এই গানটি পরিবেশন করেন। পরবর্তীতে এই গানটি নতুন করে সুরারোপ করেন সুরকার আলতাফ মাহমুদ। একুশের এই গানের লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, প্রথম সুরকার আব্দুল লতিফ এবং ১৯৭১ সালে পরবর্তী সরকারু আলতাফ মাহমুদ তিনজনই বরিশাল জেলার মানুষ। একুশে ফেব্রুয়ারির অমর সংগীত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ বিশ্বের বেশ কটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
১৯৬০ সালে ভারতের আসাম প্রদেশের কাছাড় শিলচরে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের উপর অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা গ্রহণ করে আসাম সরকার। মাতৃভাষার জন্য গর্জে উঠে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে ভাষার দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে আসামের শিলচর। শহীদ হন ১১ জন প্রতিবাদী বাংলা ভাষাভাষী মানুষ। অমর একুশে ফেব্রুয়ারি মিছিল তাদের কাছে প্রেরণার উৎস।
১৯৯৭ সালে কানাডার ভ্যানকুভার প্রবাসী রফিকুল ইসলাম, আব্দুস সালাম, হাফিজুর জাহাঙ্গীর অন্যান্য বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তোলেন ‘মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভারস অব দ্য ওয়ার্ল্ড সোসাইটি’। সংগঠনটির ১০ জন পরিচালকের দু’জন করে সদস্য বাংলাদেশ, ভারত, ব্রিটিশ, ফিলিপিনের আর একজন করে জার্মান ও চীনের। উদ্দেশ্য, পৃথিবী থেকে যেন কোন ভাষা হারিয়ে না যায়। পাতা-৩
সংগঠনটি ১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারি জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনানের কাছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানান। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ থেকে রফিকুল ইসলামকে জানানো হয় জাতিসংঘের জাতীয় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ভাষা সংক্রান্ত বিষয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার ইউনেস্কোর। এ ধরণের প্রস্তাব জাতিসংঘের কোন সদস্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে উত্থাপন করতে হবে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ১৯৯৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ইউনেস্কোর সদর দপ্তর প্যারিসে প্রস্তাবটি পাঠানো হয়। এই বছরের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩০তম পূর্ণাঙ্গ সাধারণ অধিবেশনে ১৮৮টি সদস্য দেশের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি অর্জন করে। ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের দেশে দেশে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
বাংলা ভাষা এখন বিশ্বের ৪র্থ বৃহত্তম ভাষা। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। ভাষার আন্দোলন ছিল আমাদের সকল আন্দোলন ও সর্বোপরি স্বাধিকার আন্দোলনের প্রেরণাদায়ী শক্তি।
বাংলাদেশের সকল সরকারি অফিস-আদালতসহ সর্বত্র বাংলায় লিখতে হবে বলে ১৯৮৭ সালে আইন প্রণীত হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যুগে এমন কোন বিষয় নেই যা বাংলায় অনুবাদ করা সম্ভব নয়। তবুও স্বাধীনতার ৫০ বছরে সর্বস্তরে আমাদের মায়ের ভাষা বাংলার প্রচলন হলো না। ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদেরা প্রতিবছর একুশে আমাদেরকে জানান দিয়ে যায় বাংলাদেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন চাই।
লেখক: রাজনীতিক ও সম্পাদক, নতুন বাংলা পত্রিকা
বাংলাদেশ জার্নাল/এনএইচ