ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২০ মিনিট আগে
শিরোনাম

শিক্ষা ক্যাডার সমিতি নেত্রীর স্বামীর কাণ্ড

ভিডিও কলে চাকরি প্রার্থী ছাত্রীর কাছে যৌন আবেদন

  বরিশাল প্রতিনিধি

প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৪:৪০  
আপডেট :
 ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৪:৫৮

ভিডিও কলে চাকরি প্রার্থী ছাত্রীর কাছে যৌন আবেদন

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্নাতক পড়ুয়া এক চাকরি প্রত্যাশী ছাত্রীকে চাকরি পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়ে ওই ছাত্রীকে বিভিন্ন সময়, এমনকি গভীর রাতে একা বাসায় ডাকার অভিযোগ করা হয়েছে রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে। গভীর রাতে ওই ছাত্রীর মুঠোফোনে ভিডিও কল দিয়ে যৌন আবেদনময়ী অঙ্গভঙ্গি করাসহ অন্যান্য জঘন্য অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এ ধরনের একটি ভিডিও ক্লিপ সংরক্ষিত আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমন যৌন হয়রানির অভিযোগে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বরিশালের বিভিন্ন দায়িত্বশীল মহল।

এদিকে একের পর এক নৈতিক স্খলনের ঘটনায় অভিযুক্ত রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বৃহস্পতিবার উপাচার্যের কাছে গিয়েছিলেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ। তখন উপাচার্য তাদের লিখিতভাবে অভিযোগ করতে বলেছেন। এদিকে শুধু এই চাকরি প্রত্যাশী ছাত্রীই নয়, এর আগে গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা নারী কর্মকর্তাকে যৌন হয়রানিসহ তাকে তার সঙ্গে ঢাকা যাওয়ার প্রস্তাব দেয়ার অভিযোগ আছে রেজিস্ট্রার মনিরুলের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় শারীরিক শিক্ষা কর্মকর্তার লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে তখন তদন্ত কমিটিও গঠন করেছিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী কোন ব্যবস্থা না নিয়ে তা ধামাচাপা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নারী কর্মকর্তাকে যৌন হয়রানির ঘটনা চেপে যাওয়ার ঘটনার পর রেজিস্ট্রার দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।

এ ছাড়াও রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে এলাকা প্রীতিসহ লাখ লাখ টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে রেজিস্ট্রার মনিরুলের যৌন নিগ্রহের শিকার ওই ছাত্রীটি পিতৃহীন। ওই ছাত্রীর বাড়ি বরিশাল সদর উপজেলার কীর্তনখোলা নদীর পূর্ব পাড়ে। সে বরিশালের একটি সরকারি কলেজের স্নাতক সম্মান ৩য় বর্ষের ছাত্রী। আক্তার (ছদ্মনাম) নামের ওই ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে (কথোপকথন সংরক্ষিত) জানা যায়, তিনি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। এক বছর বয়সে তার বাবা মারা যায়। মা অনেক কষ্ট করে তাকে গ্রামের স্কুল-কলেজ থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি পাস করিয়ে বরিশাল নগরীর একটি সরকারি কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। মাকে একটু আর্থিক সাহায্য করার জন্য স্নাতক অধ্যয়নের পাশাপাশি তিনি একটি মুঠোফোন অপারেটর কোম্পানির বিভিন্ন প্যাকেজ প্রকল্পে পার্টটাইম চাকরি করতেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন সরকারি দফতরে চাকরির আবেদন করতে থাকেন তিনি।

ইতোপূর্বে ২ বার প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির জন্য তিনি আবেদন করেন এবং লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। কিন্তু তার চাকরি হয়নি। এরপর তৃতীয় দফায় গত মে মাসে আবারও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির আবেদন করেন তিনি। কিন্তু নিয়োগ পরীক্ষার হলে এন্ড্রয়েড মুঠোফোন ব্যবহারসহ নানা সুবিধার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ মাস্টাররোল কর্মচারীদের নিয়োগ দিয়ে চাকরি স্থায়ী করা হলেও তার চাকরি হয়নি। এই সময়ে ফেসবুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. মনিরুল ইসলামের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। প্রথম দিকে ফেসবুক মেসেঞ্জারে সালাম ও কুশল বিনিময় হতো মাত্র। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নম্বর চেয়ে নিয়ে ওই ছাত্রীর মুঠোফোনে কল দিতে থাকেন মনিরুল। জানতে চান ছাত্রীটির বিস্তারিত পরিচয়। ওই ছাত্রীও বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাওয়ার নিয়মকানুন জানতে চান। ওই ছাত্রীর আর্থিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে রেজিস্ট্রার মনিরুল গত রমজানের শুরুর দিকে এক পর্যায়ে তাকে রাতে ভিডিও কল দিতে শুরু করেন। তিনি রূপাতলী হাউজিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাড়া বাসায় একা থাকেন এবং সরকারি কলেজে চাকরিরত তার স্ত্রী ও দুই মেয়ে ঢাকায় থাকেন বলে জানিয়ে নিজের একাকীত্ব প্রকাশ করেন।

নিজের একাকীত্বের কথা বলে ওই ছাত্রীর অনুগ্রহ পাওয়ার আশা করেন এবং তার রূপাতলী হাউজিংয়ের বাসায় যাওয়ার জন্য বিভিন্ন সময় আমন্ত্রণ জানান। ফেসবুক মেসেঞ্জারে এবং ভিডিও কলে ওই ছাত্রী ভয়ে তার বাসায় যেতে চায় না বলে তার ভয় ভাঙানোর চেষ্টা করেন। শুধু রাতে ভিডিও কল দিয়েই নয়, রমজানের শেষের দিকে দিনে বিভিন্ন স্থানে দেখা করার জন্য ডাকতেন ওই ছাত্রীকে। কিন্তু ওই ছাত্রী নানান অজুহাতে এড়িয়ে চলতেন। এতে নিরাশ-বিমুখ হয়ে রেজিস্ট্রার মনিরুল ওই ছাত্রীকে মুঠোফোনে ভিডিও কলে বলেন, তুমি আমার জন্য কিছুই করোনি। একা থাকি জেনে তুমি এড়িয়ে চলো। কোন ধরনের কাট এবং পুশবিহীন ৫ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডের ওই ভিডিও কলের সময় রেজিস্ট্রার মনিরুলের পরনে ছিল নীল-সাদা রঙের গেঞ্জি এবং চোখে পাওয়ার চশমা।

এর আগে গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টর সেলিনা বেগমকে বিভিন্ন সময় যৌন সঙ্গমের প্রস্তাব দেয়ার অভিযোগ ওঠে রেজিস্ট্রার মনিরুলের বিরুদ্ধে। ওই সময় সেলিনা বেগম এ ঘটনার বিচার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। এ ঘটনায় তখন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু ওই কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। এমনকি অভিযুক্ত মনিরুলের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাও নেয়নি কর্তৃপক্ষ।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বরিশাল মহানগর কমিটির সভাপতি নারী নেত্রী অধ্যাপক শাহ্ সাজেদা বলেন, চাকরি প্রত্যাশী এক ছাত্রীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের মতো দায়িত্বশীল পদে থেকে মনিরুল ইসলামের অনৈতিক আচরণ দুঃখজনক। তিনি বলেন, গত বছর রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে এক নারী কর্মকর্তার দেয়া অভিযোগের বিষয়ে উপাচার্য কঠোর ব্যবস্থা নিলে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতো না। এই ধরনের ঘটনার প্রতিরোধ এবং প্রতিবাদ হওয়া উচিত। চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী নৈতিক স্খলনের দায়ে রেজিস্ট্রার মনিরুলের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান নারী নেত্রী অধ্যাপক শাহ্ সাজেদা।

বরিশালের সুশীল সমাজের এক প্রতিনিধি বলেন, গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নারী কর্মকর্তাকে যৌন প্রস্তাব দেয়ার ঘটনায় রেজিস্ট্রার মনিরুলের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চরম ব্যর্থতা। গত বছর রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলে এখন তিনি চাকরি প্রত্যাশীর সঙ্গে চরম অনৈতিক প্রস্তাব দিতে পারত না। তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ভাবমূর্তি সংকটে পড়বে। একজন কর্মকর্তার অনৈতিকতার জন্য বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণœ হবে। এটা কোনক্রমেই মেনে নেয়া যায় না।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর মিয়া বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা রেজিস্ট্রারের এমন অনৈতিক কর্মকা- মেনে নেয়া যায় না। এ ঘটনার বিচারের দাবিতে আজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির জরুরি সাধারণ সভা ডাকা হয়েছে। ওই সভার পর প্রমাণসহ উপাচার্যের কাছে লিখিত অভিযোগ দেয়া হবে।

রেজিস্ট্রার মো. মনিরুল ইসলাম তার বিরুদ্ধে আনীত নৈতিক স্খলনের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, একটি কুচক্রি মহল সব সময় তার পেছনে লেগে আছে। তারা বিভিন্নভাবে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। একটি মহল তাকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করতে এবং তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে একটা এডিট করা ভিডিও ক্লিপ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিয়েছে।

ঢাকায় অবস্থানরত বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. এসএম ইমামুল হক মুঠোফোনে বলেন, রেজিস্ট্রার সম্পর্কিত একটা আনসাইনড অভিযোগ এবং একটা সিডি বিভিন্ন দফতরে পাঠানো হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন। কিন্তু তার কাছে কেউ অভিযোগ দেয়নি। শিক্ষক সমিতির নেতারা এ বিষয়ে তার কাছে বিচার চাইতে গিয়েছিলেন। তিনি তাদের লিখিত অভিযোগ দিতে বলেছেন। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেন তিনি।

গত বছর নারী কর্মকর্তাকে রেজিস্ট্রারের যৌন সঙ্গম প্রস্তাবের বিচার না হওয়া প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, তাদের (নারী কর্মকর্তা ও রেজিস্ট্রার) রেকর্ড করা ফোনালাপ বিশ্লেষণে দেখা গেছে ওই ঘটনায় দুই জনেরই দোষ ছিল। শাস্তি দিলে দুই জনকেই দিতে হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তির ব্যাপার। তাই দুই জনকেই সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল বলে জানান উপাচার্য।

পদাধিকার বলে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট কমিটির সদস্য বরিশালে সদ্য যোগদানকারী বিভাগীয় কমিশনার রামচন্দ্র দাস বলেন, তিনি এমন অভিযোগ আগে শোনেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তার নৈতিক অবক্ষয় গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট কমিটির আগামী সভায় এ বিষয়ে আলোচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মনিরুল বিতর্কিত ক্যামব্রিয়ানের একটি শাখায় কিছুদিন চাকুরি করার অভিজ্ঞতা নিয়ে কীভাবে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার হয়েছেন তা নিয়ে শিক্ষা প্রশাসনে রয়েছে নানা কানাঘুষা। জানা যায়, মনিরুলে স্ত্রী বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির নেত্রী। গত নয় বছর ধরে তিনি ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের উপপরীক্ষা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও সনদ শাখায় প্রেষণে চাকরি করেছেন। সম্প্রতি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে তাকে কুমিল্লায় বদলি করা হয়।

আরও পড়ুন: দাফনের ১১ দিন পর জীবিত উদ্ধার

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত