ঢাকা, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ০১ জানুয়ারি, ১৯৭০
শিরোনাম

বালু-শীতলক্ষ্যার বর্জ্যে মশার দখলে রূপগঞ্জ!

  রূপগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশ : ০৪ এপ্রিল ২০২০, ১৪:০৮

বালু-শীতলক্ষ্যার বর্জ্যে মশার দখলে রূপগঞ্জ!
ফাইল ছবি

বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর মাঝখানে রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়ন। এ দুটি নদীই এখন ভয়াবহ দূষণের কবলে। বালু নদীর পানিকে স্থানীয়রা পানি বলে না, ‘পচা’ নামেই চেনে। পচা থেকে দুগর্ন্ধ ছড়াচ্ছে প্রতিনিয়িত। প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে কোটি কোটি মশা। ঢাকার ময়লা আবর্জনা সবই এসে পড়ে এ নদীতে। এগুলো দেখার যেন কেউ নেই।

কায়েতপাড়া ইউনিয়নসহ নদীর পার্শ্ববর্তী শতাধিক গ্রাম এখন মশার জ্বালায় অতিষ্ঠ। কৃষি কাজে এ পানি ব্যবহার করে শ্রমিকরা খোস পাঁচড়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কৃষি ফলন কমে গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ব্যাবসায়ী বলেন, ‘ভাই আমাদের কপালটাই খারাপ। একে তো করোনা ভাইরাসে না খেয়ে মরার উপক্রম, তারওপর মশার জ্বালা। আর সহ্য হয় না। আগে মশা ছিল না আমাদের এলাকায়। যেদিন থেকে বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীতে পঁচা আইলো, সেদিন থেকেই আমাদের মশার জ্বালা শুরু। এ যাবৎকার এক ছিটা ওষুধও কেউ দেয় নাই। রাস্তা ঘাটের উন্নয়নের খবর নাই, মশার ওষুধ নাই, করোনায় ঘরে খাবার নাই, এখন কোনো নেতারও দেখা নাই উপজেলার কায়েতপাড়ায়। ভোট আইলে নেতার অভাব নাই।‘

রূপগঞ্জে ইউনিয়নের আওতাভুক্ত প্রতিটি ওয়ার্ডে ও পৌরসভায় মশার উপদ্রবের কারণে সাধারণ মানুষ রয়েছে চরম ভোগান্তিতে। দিন দিন বেড়ে চলছে এ সমস্যা। সচেতন এলাকাবাসীরা মনে করেন, যদি প্রতিটি কাউন্সিলর ও মেম্বার একটি করে মশক নিধন যন্ত্র নিজ উদ্যোগে ক্রয় করে মশা নিধন করার ব্যবস্থা করতো, তাহলে মশা অনেকটাই কমে আসতো। তাই সকল জনপ্রতিনিধিরা উদ্যোগ গ্রহণ করলে মশার কামড়ের যন্ত্রণা কমে আসবে।

‘তারা তা করবেন না, ভোট আইলে, খালি ভোট ভোট আর শুধু মিঠা মিঠা কথা। ভোট গেলে তাদের আর চোখেও দেখা যায় না। পাশ করে নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকেন জনপ্রতিনিধিরা। জনগণের কথা বেমালুম ভুলে যান’ -এমনি করে ক্ষোভের সাথে কথাগুলো বলছিলেন রূপগঞ্জ উপজেলার একজন ভোটার। মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে রূপগঞ্জের কয়েক লাখ মানুষ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে আবেদন করেও কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না।

এদিকে বিষাক্ত কয়েল জ্বালিয়ে, ধূপ পুড়িয়ে, অ্যারোসল স্প্রে করে কিংবা মশা মারার বৈদ্যুতিক ব্যাট ব্যবহার করেও মশার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না মানুষ।

মশার কয়েল বিক্রেতা নগরপাড়া বাজারের দোকানদার ফজুল মিয়া জানান, এখন কয়েল ভালোই বেচাকেনা হচ্ছে। কয়েলের ধোঁয়া মানুষের ক্ষতি হয়। তবুও সবায় বিক্রি করছে, তাই আমিও বিক্রি করছি।

এদিকে স্কুল-কলেজগুলোতেও দিন দিন বেড়েই চলেছে মশার উপদ্রব। অথচ এ বিষয়ে একেবারেই নির্বিকার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ। মশার জন্মস্থান নোংরা ড্রেন ও জলাশয়গুলোও পরিস্কার করা হচ্ছে না। মশার লার্ভা মারার জন্যও লার্ভিসাইডসহ অন্য কোনো ওষুধ স্প্রে করা হচ্ছে না।

নদীপারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে এলাকাতে মশা ছিল না। নদী-নালার পচা পানি আসার পর থেকে মশার উপদ্রব বাড়তে থাকে। বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর পচা পানি মশার বংশ বৃদ্ধির কারণ। তাছাড়া নোংরা ড্রেন ও জলাশয় তো রয়েছেই। রাতে তো বটেই; দিনেও মশার যন্ত্রণা থেকে রেহাই মিলছে না তাদের। পুরো রূপগঞ্জই যেন মশার দখলে।

অন্যদিকে, শীত শেষে আবহাওয়া উষ্ণ হয়ে ওঠায় উপজেলার বিভিন্ন এলাকার জলাশয় ও জমে থাকা ময়লার স্তুপে মশার প্রজনন বেড়ে গেছে। ফলে এলাকাবাসীর স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বাজারগুলোতেও মশার উৎপাত ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে উপজেলার শতাধিক বাজার ও এর আশপাশ এবং ড্রেনগুলো অপরিষ্কার থাকায় স্থানগুলো মশার চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে।

এছাড়া বাজার সংলগ্ন রাস্তার পাশে, মহসড়কের পাশে, খেলার মাঠ, খালের পাড়ে, নদীর তীরে, পুকুরপাড়সহ বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে ময়লার স্তুপ। সেগুলো দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করায় মশা তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে। কয়েকটি জায়গায় ডাস্টবিন থাকলেও তার যথাযথ ব্যবহার নেই। ফলে যত্রতত্র ময়লা ও আবর্জনার স্তুপ থেকে মশার প্রকোপ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

অভিযোগ রয়েছে, মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় এলাকাবাসীরা ক্ষুব্ধ। অনেকে মনে করেন, তিন দিন পরপর ড্রেনগুলোতে ওষুধ ছিটানোসহ স্প্রে করতে পারলে মশা কমে যাবে। এ জন্য মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য উপজেলা প্রশাসনের আলাদা একটা বাজেট থাকা উচিৎ।

রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছালাউদ্দিন আহমেদ জানান, সরকারিভাবে মশার উপদ্রব বিষয়ে জানলেও মশক নিধনের প্রয়োজনীয় ওষুধ না সরবরাহ করায় ইউনিয়ন পর্যায়ে তা দেয়া হচ্ছে না।

তারাব পৌরসভার মেয়র হাছিনা গাজী জানান, দেশে এখন দুর্যোগ চলছে। করোনা নিয়ে মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। মানুষের কাছে গিয়ে খাবার পৌঁছে দিচ্ছি। জনসচেতনতা তৈরি করছি। পৌরসভার মশক নিধন কাজও খুব শিগিরই শুরু করা হবে। তখন আর এমন সমস্যা থাকবে না।

কর্মীরা বলেন, নদীপারের মশাগুলো নিধন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ রাজধানী ঢাকার বর্জ্যে দূষিত শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর ময়লা-আবর্জনাযুক্ত ও উভয় পারের ঝোপঝাঁড়ে জন্ম নেয়া মশাগুলো ধ্বংস করা যাচ্ছে না। তবে স্বাস্থ্যবিভাগ এ ব্যাপারে সচেতন রয়েছে।

আশঙ্কার কথা হচ্ছে, শীতের পর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মশার ডিম একযোগে ফুটতে থাকে। অন্যদিকে, কম-বেশি বৃষ্টিপাত হলে তো কথাই নেই, বৃষ্টির জমা পানিতে ভয়ংকর এডিস মশা বেড়ে যায়।

ডা. মেহেদী হাসান বলেন, এডিস মশায় ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা- এ তিনটি রোগ ছড়ায়। এতে হাত-পা বা শরীরের অন্য যে কোনো অঙ্গ ফুলে যায়। তাই এসব রোগ ছড়ানোর আগেই দ্রুত মশা নিধনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।

কায়েতপাড়া ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মারতুজা কামাল বলেন, জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জনগণের সমস্যার কথা না ভেবে নিজের স্বার্থ আছে সে সকল কাজগুলো নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। আমরা মশার কামড়ে জরাজীর্ণ হয়ে যাচ্ছি, কিন্তু তারা কোন ধরনের নিজ উদ্যোগ না নিয়ে শুধুমাত্র সরকারের আশায় বসে থাকে। আমরা চাই জনপ্রতিনিধিরা মশা নিধন করতে কিছু নিজ উদ্যোগ গ্রহণ করুক।

অপরদিকে, উপজেলার দক্ষিণবাঘ এলাকার বাসিন্দা আলম মিয়া বলেন, ভোট নিতে আসে, কিন্তু দুর্ভোগের সময় কেউ নেই পাশে। বর্তমানে মশা অত্যান্ত বড় একটি সমস্যা। কিন্তু এ সমস্যা নিধন করার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ব্যক্তিগতভাবে কোন ধরনের কাজ করে না। যদি তারা নিজ উদ্যোগে একটি করে মশা মারার যন্ত্র দিয়ে এলাকায় মশা নিধনের ব্যবস্থা করতো, তাহলে এতো সমস্যা হতো না।

রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক সাইদ আল মামুন বলেন, মশা ও মাছি অনেক ভয়াবহ রোগের প্রভাব বিস্তার করে। যথাসম্ভব মশা ও মাছির কামড় থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে। মশার কামড় থেকে বাঁচতে যতটা সম্ভব কয়েল, স্প্রে ও নানা ধরনের বিষাক্ত দাহ্য পদার্থের ব্যবহার কমাতে হবে। কারণ, এসব দাহ্য পদার্থের ধোঁয়া শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করে ক্যন্সারসহ নানা জটিল রোগের সৃষ্টি করে যা জনস্বাস্থ্যকে হুমকিতে ফেলে।

এ ব্যাপারে রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ বেগম বলেন, গ্রামা সাধারণত মশার উপদ্রব কম থাকে। তাই ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারি কোনো বরাদ্দ নেই। তবে শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর তীরের মানুষের দুর্ভোগের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন মহলকে জানিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর পচা পানির সমস্যার সমাধান না করতে পারলে মশা নির্মূল হবে না।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত