ঢাকা, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

এহান দিয়া একটা খাল আছিল, দহল অইয়া গেছেগা

  রূপগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৩:০০  
আপডেট :
 ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৩:১২

এহান দিয়া একটা খাল আছিল, দহল অইয়া গেছেগা

‘কি যেন কন বাজান। এহান দিয়া যে খাল আছিল, হেইডা এলাকার বেবাগ মাইনসে জানতো। খাল এক্কেবারেই দহল অইয়া গেছেগা। দেখতাছেন না অহন আর খাল বুঝবার অবস্থা নাই। অহন দেখলে মনে অয় এইডা একটা ডেরেন।’ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চন পৌরসভার কাঞ্চন-মেঘনা খালের দিকে তাকিয়ে এমন ক্ষোভ আর হতাশার সুরেই কথাগুলো বললেন কাঞ্চন এলাকার সত্তোর্ধ্ব রজ্জব আলী।

প্রায় ১৫০ বছরের পুরনো ও ৫০ ফুট প্রস্থের উকিলবাড়ির এ খালটির এখন অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। খালের মোহনা শীতলক্ষ্যা নদ থেকে কলাতলী ব্রিজ পর্যন্ত ড্রেন আকারে কিছু অস্তিত্ব রয়েছে। এরপর কলাতলী ব্রিজ থেকে বাড়ইবিল-নোয়াগাও হয়ে মেঘনা পর্যন্ত অংশে মোটামুটি অস্তিত্ব রয়েছে।

এলাকাবাসী বলছেন, এ অংশটুকু ধীরে ধীরে দখল হয়ে যাবে। দূষণ আর দখলে খালটি এখন মৃতপ্রায়। খালটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কলাতলী এলাকার ৩ হাজার বিঘা জমিতে সেচ দিতে কৃষকদের প্রতিবছরই হিমশিম খেতে হয়।

উপজেলা সূত্রে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে রূপগঞ্জে প্রায় ২৪ টি খাল ছিল। এর বেশির ভাগেরই এখন চিহ্ন নেই।

উপজেলা কার্যালয়ের তথ্য মতে, রূপগঞ্জে খালের সংখ্যা ছয়টি। এর মধ্যে উকিলবাড়ির খালের নাম নেই। তবে কাঞ্চন পৌরসভা কার্যালয়ে খালটি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।

কাঞ্চন পৌরবাসী জানায়, রূপগঞ্জের মধ্যে উকিলবাড়ির খালটি সবচেয়ে দীর্ঘ। আর টাটকী-গোলাকান্দাইল খালের পর এ খাল পুরনো বেশি। শীতলক্ষ্যার সঙ্গে সংযোগ পেয়ে কাঞ্চন-কলাতলী হয়ে খালটি বাড়ইবিল-নোয়াপাড়া দিয়ে মেঘনা পর্যন্ত পৌঁছেছে। খালটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬ কিলোমিটার।

এ খালের পানি কাঞ্চন-কলাতলী-বাড়ইবিল এলাকার প্রায় ৩ হাজার হেক্টর জমিতে ব্যবহার করা হতো। এ খাল দিয়ে একসময় বেপারীরা পাটের নৌকা, লাকড়ির নৌকা, কাঁঠালের নৌকা ও ছইয়া নাও চালাতেন। স্থানীয় জেলেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এসে খালের দিকে লোলুপ দৃষ্টি পড়ে হতকুচ্ছিত দানবের দলের। দখলের কবলে পড়ে উকিলবাড়ি খাল। অবৈধভাবে এর উপড় শিল্পকারখানা, পাকা ভবন, মার্কেটসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ করা হয়।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, খালের প্রবেশ মুখের কোন চিহ্ন নেই। এরপর থেকেই দখলের প্রতিযোগিতা শুরু। রীতিমতো খাল ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে বাড়িঘর আর দোকানপাট। কাঞ্চন থেকে কলাতলী পর্যন্ত খালটির পুরো অংশজুড়েই অবৈধ দখলদারদের আগ্রাসন। খালের প্রবেশ মুখ থেকে শুরু করে এশিয়ান হাইওয়ে সড়কের কালভার্ট পর্যন্ত প্রভাবশালীরা খালটির কোথাও একেবারেই ভরাট করে ফেলেছে। আবার কোথাও কোনমতে ড্রেন বানিয়ে অস্তিত্ব মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। যা দেখে বুঝার কোন উপায় নেই, এখানে একসময় খাল ছিল।

দখলদার কারা: সরেজমিনে ঘুরে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খালের প্রবেশ মুখেই খাল ভরাট করে বাড়িঘর নির্মাণ করেছেন কবির মোল্লা। এছাড়া হাজী মোজাম্মেল খাল দখল করে নির্মাণ করেছেন টেক্সটাইল মিল। এভাবে হাজী হান্নান, মমিনউদ্দিন মিয়া, বশির মিয়া, নাহিদুল আলী, হাফেজ মোসলেউদ্দিন, সুরুজ মুন্সীর ও তার শ্যালক, ডা. শহিদুল্লা মিয়ার ছেলে দুলাল মিয়া, লন্ডন প্রবাসী গাফফার দেওয়ান, শফিক ওরফে কালু বাদ্যকর, খালেক মেম্বার, আমজাদ হোসেন, জুনায়েদ মিয়া, মজিবুর রহমান, সামসুন্নাহার বেগম, বাসির মিয়াসহ আরো অনেকে বাড়িঘর, দোকানপাটসহ নানা স্থাপনা তৈরি করেছেন।

কয়েকজন দখলদারের বক্তব্য: মুঠোফোনে কথা হয় দখলদার সামসুন্নাহার বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘খালের মধ্যে দুইডা পায়া( পিলার) পড়ছে। অন্যরা যেমনে দহল করছে, আমি হেইভাবে করি নাই। তয় সরকার যদি চায় ভাইঙ্গা দিবো, হেইসময় আমার কোন বাধা থাকব না।’

আরেক দখলদার কবির মোল্লা খাল দখলের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘আমি উপজেলা থেকে লিজ এনেছি। অন্যরা লিজ না এনেই দখল করেছে।’ খালের অস্তিত্ব নেই বলে তিনিও দাবী করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকার যদি চায় খাল হবে তাহলে খাল হবে। আর যদি চায় আরো তিনতলা বাড়ি হবে তাহলে সেটাই হতে পারে।’

দূষণে নিঃস্ব খাল: খাল ভরাট আর দখলের পাশাপাশি দূষণেও নিঃস্ব হয়ে গেছে। শিল্পকারখানার বর্জ্য, পয়োবর্জ্য, বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা ও মলমূত্র ফেলে খালের পানি নষ্ট করা হচ্ছে।

রানীপুরা এলাকার আবুল হোসেন বলেন, ‘যহন টিউবওয়েল তেমন একটা ছিল না, তখন মানুষ এই খালের পানি খাইতো। এই পানিতে থালাবাসন মাঝতো, গোসল করতো। অহন থালা-বাসন মাঝাতো দূরের কথা পা দুর্গন্ধে মানুষ খালের কিনারা দিয়াও যায়না। দূষিত পানির দুর্গন্ধে ৪০ গ্রামের মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।’

তিন হাজার হেক্টর জমিতে সেচকাজে ব্যাহত: এশিয়ান হাইওয়ে সড়কের কালভার্টের অংশে আবাসন কোম্পানি আমেরিকান সিটির বালু পড়ে খালটির মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কলাতলীসহ ২০ গ্রামের তিন হাজার হেক্টর জমিতে সেচকাজে সমস্যা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা কৃষকরা।

এ ব্যাপারে স্থানীয় কৃষকরা উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা কৃষি অফিসার ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বরাবর স্মারকলিপি পেশ করেছেন।

কলাতলী এলাকার সত্তোর্ধ্ব মাওলানা অলিউল্লা বলেন, ‘বাজান এই খাল আছিলো আমাগো প্রাণ। হেই খালডার মুখ আমেরিকান সিটির বালু পইরা বন্ধ অইয়া গেছেগা। টিউনেরে( ইউএনও) জানানের পরে কোনমতন একটা ডেরেন কইরা দিছে। অনেক কষ্ট কইরা এইবার খেত( ক্ষেত ) করছি।’

কলাতলী এলাকারই শহীদুল্লা মোল্লা বলেন, ‘গত ৪/৫ বছর আগে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে খালটি খনন করেছিল সরকার। আমেরিকান সিটির বালু পইড়া খালটি ধীরে ধীরে ভইরা যাইতাছেগা। এখন অনেক কষ্ট করে কৃষকরা জমিতে সেচকাজে পানি নিচ্ছে।’ দিঘলীয়া এলাকার আবুল মিয়া বলেন, ‘বাবা আমাগো গরীবগো দিহে কেউ খেয়াল করে না। খালডা দিয়া আমাগো গ্রামের হগ্গলতের কাম চলতো। অহন অনেক কষ্টে আছি আমরা।’

এ ব্যাপারে সেলফোনে কথা হয় আমেরিকান সিটির ষ্টেট অফিসার তানভীর আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, এটা ঠিক নয়। আমেরিকান সিটির নিজস্ব কেনা জমিতেই বালু ফেলা হচ্ছে। খাল ভরাট করার কোন উদ্দেশ্য নেই আমাদের।

জেলে পাড়ার দুর্দিন: খালের পাশ ঘেঁষেই নোয়াগাও গ্রাম। এ গ্রামের ৮০ ভাগ লোকই জেলে সম্প্রদায়। তারা এ খালে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন খাল ভরাট ও দূষণ হওয়ায় মাছের কোন অস্তিত্ব নেই। জেলেরা বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অনেকে ভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন। জেলে নিত্যানন্দ দাস বলেন, ‘৪/৫ বছর আগেও এই খালো মাছ ধইরা বেইচ্যা সংসার চালাইতাম। অহনতো খাল ভইরাই ফালাইছে। যেহান দিয়া কিছুডা চিহ্ন আছে, হেইডাও ময়লা পানি। সংসারডা বাপু অনেক কষ্ট কইরা চালাইতাছি।’

আরেক জেলে হরিপদ দাস বলেন, ‘৫ টা পোলাপান লইয়া কিযে কষ্টে আছি হেইডা বুজাইবার পারুম না বাপু। খালডা মরলো আর আমাগো মাইরা গেলো। খালডা আছিলো আমাগো খোরাক। যেরা এইডা ভইরা ফালাইছে, যেরা দহল কইরা বাড়িঘর বানাইছে ভগবানে হেগো বিচার করবো।’

কাঞ্চন পৌরসভার মেয়র রফিকুল ইসলাম রফিক বলেন, রেকর্ডে আছে উকিল বাড়ির খাল। খাল দখল হয়ে গেছে এটা সত্যি। খাল দখল করে প্রভাবশালীরা শিল্পকারখানা, দোকানপাট ও বাড়িঘর নির্মাণ করেছে। খুব শীঘ্রই উচ্ছেদের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা জানান, কৃষকদের নিকট থেকে অভিযোগ পেয়ে তদন্ত করেছি। মৎস্য অফিসার ইমরান হোসেন বলেন, সব খাল নিয়ে কয়েকবার উপজেলা সমন্বয় সভায় আলোচনা হয়েছে। খালগুলো আগের অবস্থায় ফিরে আসলে সবদিক দিয়ে ভাল হবে।

উপজেলা সহকারী কমিশনার ( ভূমি) আফিফা খান বলেন, যদি রেকর্ডে খাল থাকে, তাহলে লিজ দেওয়ার কোন নিয়ম নেই। বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে দেখা হবে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহ নুশরাত জাহান বলেন, এ বিষয়ে এলাকাবাসী অভিযোগ করেছিল। সে প্রেক্ষিতে কৃষি অফিসারকে পাঠানো হয়েছে। কৃষি অফিসারের তদন্ত রিপোর্ট পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবৈধভাবে দখল হয়ে থাকলে উচ্ছেদের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ জার্নাল/এনকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত