ঢাকা, সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

‘মেরে ফেলো, ওদের মেরে ফেলো’

  আসাদুজ্জামান সাজু, লালমনিরহাট প্রতিনিধি

প্রকাশ : ০৮ নভেম্বর ২০২০, ১৭:৩৬

‘মেরে ফেলো, ওদের মেরে ফেলো’
ওসি সুমন কুমার মোহন্ত

রুমে শহীদুন্নবী জুয়েল ও তার বন্ধু সুলতান রুবাইয়াত সুমনের সাথে আমি একাই। বিক্ষুপ্ত জনতা গ্রিল ভেঙে রুমে প্রবেশ করে জুয়েল ও সুমনকে মারধর করছেন। তখন জুয়েল মেঝেতে শুয়ে আছে। বিক্ষুপ্ত জনতা শ্লোগান দিচ্ছে ‘মেরে ফেলো, ওদের মেরে ফেলো।’ ওই মুহূর্তে আমিও মৃত্যুর ভয়ে ভীত হয়ে পড়ি। অন্য পুলিশদের ফোন দিলে তারা বলেন তারাও হলরুমে আটকা পড়ে আছে। তখন সাহস করেই সুমনকে নিয়ে বের হই। টিনের চালা দিয়ে পার হয়ে বের হয়ে আসি। অনেকেই সেই দিনের ঘটনায় পুলিশের ব্যর্থতা নিয়ে নানা কথা বলছেন কিন্তু বাস্তবতা ছিলো একেবারে ভিন্ন তা বিশ্বাস করার মতও নয়।

এভাবেই লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী স্থলবন্দর বাজারে আবু ইউসুফ শহিদুন্নবী জুয়েলকে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন পাটগ্রাম থানার ওসি সুমন কুমার মোহন্ত।

গত ২৯ অক্টোবর বিকালে মসজিদে শহিদুন্নবী জুয়েল ও তার সঙ্গী সুলতান রুবাইয়াত সুমনকে পিটিয়ে যখন বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদে নেয়া হয়, তখন গোলযোগের খবর পেয়ে ফোর্স নিয়ে ছুটে যান ওসি সুমনও।

ওসি সুমন বলেন, ঘটনাস্থলে উপস্থিত ইউএনও, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যানসহ মেম্বাররা যখন জীবন বাঁচাতে ভবনের বাইরে চলে যান, তখন আমি ভিকটিমের রুমে যাই। ততক্ষণে গ্রিল, দেয়াল ভেঙে ‘মেরে ফেলো, ওদের মেরে ফেলো’ স্লোগান দিতে দিতে লোকজন ইউপি ভবনে ঢুকতে শুরু করেছে। আমি গিয়ে দেখি একজন দাঁড়িয়ে আছেন। অন্যজন ফ্লোরে শুয়ে পড়ে আছেন, আর তাকে ইচ্ছামতো পেটানো হচ্ছে। আমি দাঁড়ানো জনকে নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে আসি। তখন পেছন থেকে আমাকে মারা হচ্ছিল।

আরও পড়ুন: ‘অনুদান নয়, বাবা হত্যার বিচার চাই’

‘এই ধরনের ঘটনা ঠেকানোর মতো প্রস্তুতি আমাদের ছিল না। আমরা ঘটনা শুনে এসেছিলাম। কিন্তু হরতাল-অবরোধ মোকাবিলায় তো না, তাই আমাদের গ্যাস, গান বা অন্য প্রস্তুতি ছিল না।’

তিনি বলেন, উন্মত্ত জনতা ইচ্ছামতো পাথরের ঢিল ছুড়তে থাকে। আমার শরীরেও অসংখ্য পাথরের ঢিল পড়েছে। তখন মনে হলো আমাকে কিছু করতে হবে। তাই সাহস নিয়ে ঘটনাস্থলে অবস্থান করি। পুলিশ ১৭ রাউন্ড রাবার বুলেট ছুড়েছিল। কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। তবুও উপস্থিত জনগণের উন্মত্ততা থামছিল না। পরিস্থিতি আরও বেশি জটিল হয়ে উঠেছিল, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল।

তিনি বলেন, ‘সেদিন ঘটনাস্থলে প্রায় ৫-৬ হাজার জনতার ভিড় ছিল। সবাই স্লোগান দিচ্ছিল, ‘মেরে ফেলো, ওকে মেরে ফেলো।’

সুমন কুমার মোহন্ত বলেন, আমি দ্রুত ভবনের দোতলায় উঠে যাই। গ্রিল টপকে চালের ওপর দিয়ে আরেকটি মার্কেটের ছাদ দিয়ে পালিয়ে অন্য একটি সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসি। দ্রুত বাজারের ভেতর ঢুকে দৌড়ে সামনে যাই। পরে একজনের বাইকে করে পুলিশ টিমের সঙ্গে মিশে যাই।

ওসি সুমন বলেন, আমার শরীরে এতো পাথরের ঢিল ও লাঠির আঘাত পড়েছিল, তারপরও একজনের প্রাণ বাঁচাতে পেরেছি। এটিই আমার কাছে শান্তির। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আর একটি প্রাণ বাঁচাতে পারিনি।

আরও পড়ুন: লালমনিরহাটে হত্যাকাণ্ড: প্রধান আসামি ঢাকায় গ্রেপ্তার

ওসি বলেন, আমি সেদিন বিকাল ৫টা ১ মিনিটে খবর পাই। তখনই আমি বুড়িমারী জিরো পয়েন্ট থেকে ৮ জনের পুলিশ ফোর্স পাঠাই। আমি আরও দশ জন ফোর্স নিয়ে সেখানে পৌঁছাই। আমার থানায় ৬৪ জন ফোর্স। এমপি ডিউটি, অন্যান্য ডিউটি ও ছুটি মিলিয়ে ৩২ জনকে আমি কখনই পাই না। যানবহনেরও সঙ্কট আছে।

তিনি বলেন, ঘটনাটি শুরুতেই থামানো যেতো। স্থানীয়রা বিষয়টি মসজিদে মিটিয়ে দিয়ে লোক দু'জনকে পাঠিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তারা ইউপি কার্যালয়ে আটকে রেখে সময়ক্ষেপণ করেছেন এবং লোক জমায়েত হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। পরে তারা আর সামলাতে পারেননি।

২৯ অক্টোবর লালমনিরহাটের বুড়িমারীতে পবিত্র কোরআন অবমাননার গুজব ছড়িয়ে শহিদুন্নবী জুয়েলকে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় পাটগ্রাম থানায় পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে।

নিহতের চাচাত ভাই সাইফুল আলম করেছেন হত্যা মামলা, পুলিশের পক্ষে এসআই শাহাজাহান আলী ও বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত করেছেন সরকারি কাজে বাধা, অগ্নি সংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনায় অপর দুটি মামলা। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৪ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত