ঢাকা, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

ভালো দামের আশায় খামারিরা

  মিরসরাই প্রতিনিধি

প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০১৮, ১৬:০২

ভালো দামের আশায় খামারিরা

মিরসরাইয়ে দেশি গরুর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। দেশিয় পদ্ধতিতে উপজেলার খামারিরা গরু মোটাতাজা করায় এই উপজেলার গরুর চাহিদা বেশি। আর তাই প্রতি বছর কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে উপজেলার খামারি ও কৃষকরা গরু, ছাগল, ভেড়া ও মহিষ মোটাতাজাকরণে ব্যস্ত থাকেন। কোরবানি ঈদে উপজেলার স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে গবাদিপশু ফেনী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি করেছে উপজেলার খামারিরা।

গতবছর বছর ভারত থেকে কোরবানির হাটে পশু কম আমদানি করায় দেশি গরুর চাহিদা ছিল বেশি। খামারিরা ভালো লাভও করেছিল। তাই এ বছরও কোরবানিকে সামনে রেখে দেশি গরু ও ছাগল মোটাতাজা করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন উপজেলার খামারি ও কৃষকরা। তবে এ বছরও ভারতীয় গরু না আসলে বেশ লাভবান হবে এমনটাই আশা করছেন তারা। বিগত বছরগুলোর মতো এবারও গবাদিপশু লালনপালনকারীরা ভালো দামের প্রত্যাশায় রয়েছেন।

জানা যায়, মিরসরাই উপজেলায় স্থায়ী ও অস্থায়ী মোট ২৪টি হাটে গবাদিপশু বেচাকেনা হয়। হাটগুলো হলো- মিরসরাই বাজার, বড়তাকিয়া বাজার, আবুতোরাব বাজার, কৈলাশগঞ্জ বাজার, সমিতির হাট, কমরআলী, সাহেরখালী, ছোট কমলদহ, ডাকঘর বাজার, সরকারহাট, হাদিফকিরহাট, করেরহাট, বারইয়ারহাট, কয়লা, জোরারগঞ্জ, চৌধুরীহাট, আজমপুর, শান্তিরহাট, মিঠাছড়া বাজার, মাদবারহাট, টেকেরহাট, আবুরহাট, বামনসুন্দর দারোগারহাট, মিঠানালা বাজার, ঝুলনপোল বাজার।

২৪টি হাটের মধ্যে উপজেলার মিরসরাই বাজার, বড়তাকিয়া, মিঠাছরা, জোরারগঞ্জ, বারইয়ারহাট, আবুতোরাব গরুরবাজারগুলো বড়। এসব বাজারে বিভিন্ন স্থান থেকে বেপারিরা এসে গরু ক্রয় করে ফেনী, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় নিয়ে বিক্রয় করে।

এছাড়া স্থানীয় বেপারিরা এলাকায় কৃষকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গরু ক্রয় করে তা বিভিন্ন বাজারে বিক্রয় করে। বর্তমানে এ উপজেলার প্রায় আড়াই হাজার মানুষ (খামারি, কৃষক ও বেপারিরা) এ পেশায় রয়েছে। খামারি ছাড়াও উপজেলার সাধারণ কৃষকরা বাড়তি ইনকামের জন্য বাড়িতে একটি দুইটি করে গরু মোটাতাজা করে। ঈদের সময় আকার ভেদে গত বছর প্রতিটি গরু ৩৫ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকায় বিক্রয় করেন এখানকার গবাদিপশুর খামারি ও কৃষকরা। উপজেলায় ৫০ ভাগ গরু মোটাতাজা করছে খামারিরা আর বাকি ৫০ ভাগ করছে সাধারণ কৃষকরা।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের তথ্য মতে, মিরসরাই উপজেলায় ছোট-বড় মিলে ২৩০ টি খামার রয়েছে। এবার এসব খামারে হৃষ্টপুষ্ট করা হয়েছে ৯ হাজার ১৪ টি ষাঁড়, ৩ হাজার ৯ শত ১৬ টি বলদ, ৩ শত ২৮ টি গাভী, ৩ হাজার ৮ শত ৫৫ টি ছাগল, ১ হাজার ৫৪৩ টি ভেড়া, ২ হাজার ৫ শত ৯১ টি মহিষ। এবার মোট গবাদিপশু পালিত হয় ২১ হাজার ২ শত ৪৭ টি। গত বছরের তুলনায় পালন বেড়েছে। গত বছর হৃষ্টপুষ্ট করা হয়েছে ৭ হাজার ৫ শত ৪৬ টি ষাঁড়, ৪ হাজার ২ শত ২৮ টি বলদ, ২৮০ টি গাভী, ৩ হাজার ৮ শত ৪৪ টি ছাগল, ২৮১ টি ভেড়া, ১ হাজার ৫ শত ৯১ টি মহিষ। উপজেলায় রেড় চিটাগাং গরু সবচেয়ে বেশি মোটাতাজা করা হয়। এছাড়া শাহীওয়াল, ফ্রিজিয়ান, জার্সি ও দেশী গরুও মোটাতাজা করা হয়।

মিরসরাইয়ের খামারিরা জানান, কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে উপজেলার খামারগুলোতে দেশীয় পদ্ধতিতে গবাদি পশু মোটাতাজাকরণ করা হয়। খামারের পাশাপাশি কৃষকরাও নিজেদের মতো করে গরু মোটাতাজা করে। এক্ষেত্রে সবাই দেশীয় পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। কিন্তু তাদের দুশ্চিন্তা ভারতীয় গরু নিয়ে। অন্যবারের মতো এবারও কোরবানির হাটে ভারতীয় গরু আসলে তাদের লোকসান গুনতে হবে। এ ব্যাপারে তারা সরকারি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের মস্তাননগর এলাকার ফারদিন এগ্রোর স্বত্বাধিকারী রেজাউল করিম মাষ্টার জানান, ৫ বছর আগে তিনি তার এগ্রো ফার্ম চালু করেন। এগ্রো ফার্মটি চালু করার পর থেকে সুনামের সাথে কোরবানির গরু মোটাতাজাকরণ করে বিক্রি করে আসছেন। এবার তিনি কুড়িগ্রাম ও রংপুর থেকে ৫০ টি দেশী প্রজাতির গরু ক্রয় করে মোটাতাজাকরণ করেন। খামারে গরু মোটাতাজাকরণে প্রাকৃতিকভাবে ভুসি, ভুট্টা, খড়, খৈল, নালী ও নিপিয়ার ঘাসই খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ইনজেকশন কিংবা ট্যাবলেট এই খামারে নিষিদ্ধ। গতবছর প্রায় ১৭ লক্ষাধিক টাকা লাভ পান কোরবানির গরু বিক্রি করে। এবার ৪০ হাজার টাকা করে ৫০ টি গরু ক্রয় করে মোটাতাজা করা হয় খামারে। ভালো দাম পেলে এবার প্রায় ১১ থেকে ১২ লক্ষাধিক টাকা লাভ হবে বলে আশাবাদী তিনি। তবে ভয় ভারতের গরু নিয়ে, ঈদে ভারত থেকে গরু আসলে মাথায় হাত পড়বে। বিষয়টি সরকারকে দেখা উচিত।

করেরহাট ইউনিয়নের এস.আই ডেইরী ফার্ম এন্ড এগ্রোর স্বত্বাধিকারী শেখ মো. আকতার হোসেন জানান, ৩ মাস আগে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ৭০ থেকে ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা করে ৮০ টি শাহীওয়াল, শংকর, জার্সি ও বাহমা জাতের গরু কেনেন। বড় সাইজের গরুগুলোর বর্তমান বাজার মূল্য ১ লক্ষ ১০ হাজার থেকে আড়াই লক্ষ টাকা পর্যন্ত। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক খাদ্য খাওয়ানোর মধ্যদিয়ে গরুগুলো মোটাতাজা করা হয়। তার খামারে কোরবানিকে ঘিরে ৮০ টি গরু মোটাতাজা করা হয়, ইতিমধ্যে তিনি ১৬ টি গরু বিক্রি করেছেন তাতে গরু প্রতি প্রায় ১০ হাজার টাকা করে লাভ পেয়েছেন।

তিনি আরো জানান, দীর্ঘ ১৯ বছর কুয়েতে ছিলাম। দেশে এসে অনেকগুলো ব্যবসায় টাকা বিনিয়োগ করি, কিন্তু সেখানে মুনাফা অর্জন দুরে থাক মূলধনের টাকা পর্যন্ত হাওয়া হয়ে যায়। এইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হতে হতাশার একপর্যায়ে তিনি এগ্রো ফার্ম করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি এবছরই এগ্রো ফার্ম গড়ে তুলেছেন, তিনি আশাবাদী এই ব্যবসায় সফল হতে পারবেন।

পশ্চিম জোয়ার গ্রামের মোমিন এগ্রো ফার্মের স্বত্বাধিকারী মোমিন উদ্দিন জানান, বিগত ৭ বছর যাবত তিনি কোরবানিকে ঘিরে গরু মোটাতাজা করে থাকেন। এবার ৭ মাস আগে রাজশাহী থেকে নেপালি, পাকিস্তানী, জার্সি প্রজাতির প্রতিটি ৯০ হাজার টাকায় ক্রয় করে পালন করেন। সারা বছর খাবার হিসেবে ঘাস খাওয়ানো হয় এবং ঈদের ২ মাস আগে খড়, খৈল, কুঁড়া ও ভুসি খাওয়ানো হয়। বছরে যে খাবার লাগে অধিকাংশ খাবারই ঘাস, তাই খরচ কম। একটি গরু ৯০ হাজার টাকায় ক্রয় করে ৭ মাস পোষার পর ঈদের সময় আকারভেদে ১ লাখ ১০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকায় বিক্রি করা যায়। আকার ভেদে ৪০-৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ পান তিনি।

উপজেলার আবুরহাট গরুর বাজার ইজারাদার জামাল উদ্দিন দুখু জানান, উপজেলার ঐতিহ্যবাহী একটি গরুর বাজার আবুরহাট। এই বাজারে বিশেষ করে দেশী প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের গরু উঠে থাকে। রাতের বেলায় ক্রেতাদের সুবিধার্থে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা রাখা হয়।

মিরসরাই উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. শ্যামল চন্দ্র পোদ্দার বলেন, পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে গবাদিপশু হৃষ্টপুষ্টকরণে ক্ষতিকর স্টেরয়েড হরমোন জাতীয় ঔষুধ ব্যবহার ও বিক্রি না করার জন্য দোকানদার ও খামারীদের অনুরোধ করে আসছি। উপজেলায় ক্ষতিকর স্টেরয়েড হরমোন জাতীয় ঔষুধ ব্যবহারকৃত গবাদিপশু নেই বলে আমার বিশ্বাস। মিরসরাইয়ে সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে দেশি মাঝারি আকারের গরুর। বিগত বছরগুলোতে কোরবানির পশুর বাজারে আমরা দেখেছি সংকট হয়নি আশা করি এবারও সংকট হবে না। উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে নিরাপদ গো মাংস উৎপাদনের লক্ষ্যে আমরা খামারীদের দীর্ঘদিন ধরে উদ্বুদ্ধ করেছি এবং মনিটরিং কার্যক্রমও জোরদার করেছি। ফলে আশানুরূপ ফল এসেছে। আমরা সরকারিভাবে তাদেরকে ওষুধ ফ্রি দিয়েছি, এরমধ্যে কৃমির ওষুধ ও ভ্যাকসিন রয়েছে। কৃষক ও খামারিদের কয়েকবার করে ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। সবসময় বিভিন্ন পরামর্শসহ খোঁজখবর রেখেছি। গত বছরের তুলনায় এবছর পশু মোটাতাজা বেশি হয়েছে। গত বছর ছিল ১৭ হাজার ৭ শত ৭০ টি পশু এবছর তা বেড়ে হয়েছে ২১ হাজার ২ শত ৪৭ টি। প্রতিবারের মতো এবারও বাজারগুলোতে নজরদারি করবে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর। ৪ টি মেডিকেল টিম উপজেলার ২৪ টি বাজার তদারকি করবে।

তিনি আরো জানান, উপজেলার ইছাখালী ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি গবাদিপশু মোটাতাজা করা হয়। ইছাখালী, ধুম ও ওচমানপুর ইউনিয়নে শতকরা ৬০ ভাগ এবং করেরহাট, হিঙ্গুলী, জোরারগঞ্জ, দুর্গাপুর, মিরসরাই সদর, মিঠানালা, মঘাদিয়া, খৈয়াছড়া, মায়ানী, হাইতকান্দি, ওয়াহেদপুর, সাহেরখালী ইউনিয়ন, মিরসরাই ও বারইয়ারহাট পৌরসভায় ৪০ ভাগ গবাদিপুশু মোটাতাজা করা হয়। উপজেলায় অনেক গৃহস্থের বাড়িতে গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ লালন-পালন করা হয় কোরবানিকে সামনে রেখে।

বাংলাদেশ জার্নাল/এনএইচ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত