ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

বাংলা সিনেমার ‘অপু’ তিনি

  হৃদয় আলম

প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২০, ১৪:০৫  
আপডেট :
 ১৫ নভেম্বর ২০২০, ১৪:৩৯

বাংলা সিনেমার ‘অপু’ তিনি
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ফাইল ছবি

তিনি শুধু অভিনেতাই ছিলেন না, কবিতাচর্চা, রবীন্দ্রপাঠ, সম্পাদনা, নাট্যসংগঠন তার বিপুল বৈচিত্র্যের একেকটি দিক। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সবকিছু নিয়েই অনন্য। তিনি এমনই এক শিল্পী, যার মূল্যায়ন নিয়ে কোনো পণ্ডিতি-তর্ক তোলার অবকাশ রাখে না। বলা হতো সময়ের ধুলা তার আভিজাত্যের সৌন্দর্য স্পর্শ করতে পারে না।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বাংলা সিনেমায় অপু হিসেবে খ্যাতি ছিলো। চলচ্চিত্রে ক্যারিয়ার শুরু ১৯৫৯ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ দিয়ে। অপুর সংসার পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়। সেই পথচলা শুরু এই জুটির। সত্যজিত পরিচালিত ৩৪টি ছবির ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, যা বিরল প্রাপ্তি।

তবে শুধু সত্যজিত রায় নন, তপন সিনহা, মৃণাল সেন,তরুণ মজুমদার থেকে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-নন্দিতা রায়, সৃজিত মুখোপাধ্যায়,অতনু ঘোষ, সুমন ঘোষের মতো আজকের প্রজন্মের পরিচালকদের ছবিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ৬১ বছর দীর্ঘ ফিল্মি ক্যারিয়ারে প্রায় ২৫০টি ছবিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র।

অভিনয় ছিল সৌমিত্রের জীবনের অক্সিজেন, বলতেন- ‘আমি অভিনয় করছি বলেই তো সুস্থ আছি’। তাই তো করোনা সতর্কাতার মাঝে লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেননি। লডকাউন পরবর্তী সময়ে শেষ করেছেন নিজের বায়োপিক অভিযান-এর শ্যুটিং। কাজ করেছেন একটি ডকুমেন্ট্রি ফিল্মেরও। কারণ সৌমিত্র বলতেন ‘কাজ ছাড়া আমি আর কিচ্ছু করতে চাই না’।

১৯৩৫ সালে কৃষ্ণনগরে জন্ম সৌমিত্রের। বাবা মোহিত কুমার চট্টোপাধ্যায় কলকাতা হাইকোর্টের উকিল ছিলেন। তবে নাটকের চর্চা নিয়মিত ছিল পরিবারে, বাবা নাটকের দলে অভিনয় করতেন। ছোট থেকেই সেই পরিবেশে বড় হওয়া তার। তখন থেকেই অভিনয়ের প্রেমে পড়ে যান সৌমিত্র। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে প্রথমে আইএসসি এবং পরে বিএ অনার্স(বাংলা) পাস করার পর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ অফ আর্টস-এ দু-বছর পড়াশোনা করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

চেহারা নিয়ে আশৈশব হীনন্মন্যতা ছিল সৌমিত্রের। খুব সঙ্কুচিত বোধ করতেন। ছোটবেলায় দীর্ঘ ৬৩ দিন টাইফয়েডে ভুগে হাঁটতে ভুলে গিয়েছিলেন। সুস্থ হওয়ার পর নতুন করে হাঁটা শিখতে হয়েছিল। ‘আমাকে লোকে নেবে তো?’ এই ভীতি, শঙ্কা এবং প্রশ্ন ‘অপুর সংসার’-এ আবির্ভাব পর্যন্ত তাকে তাড়া করেছে। একজন পারফর্মার হিসাবে ছটফটিয়ে উঠত তার মন। তাই সেলুলয়েডের পাশাপাশিই মঞ্চে, সাহিত্যে, গানে নিজের অন্তরের ক্ষুধা মিটিয়ে ফিরেছেন তিনি।

নিজের অভিনয় শুরুর দিনগুলো নিয়ে তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘বাবা সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি ঝোঁক ছিল। কিন্তু তখন অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়ার প্রশ্ন ওঠেনি। সে কারণেই হয়তো বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে ওকালতি পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু একান্ত নিমগ্নতায় বাবাকে অভিনয় আর আবৃত্তিটাই করতে দেখেছি। এ সব দেখেই এক সময় অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি আগ্রহ বাড়ে আমার।’

বাবা সৌমিত্রকে বোঝাতেন কীভাবে অভিনয় করতে হয়। আবৃত্তি করতে হয়। এভাবে চিন্তার ক্রমাগত উৎকর্ষতায় পরবর্তীকালে কলকাতায় শিশিরকুমার ভাদুড়ির অভিনয় দেখে আগ্রহ বাড়ে।

সৌমিত্রের ছেলেবেলা কেটেছিল ‘ডি এল রায়ের শহর’ কৃষ্ণনগরে। তার মা আশালতা চট্টোপাধ্যায়। গৃহবধূ। বাবা মোহিত চট্টোপাধ্যায়। পেশা ওকালতি। নেশা শখের থিয়েটারে অভিনয়। নদিয়া থেকে হাওড়া। হাওড়া জেলা স্কুলে পড়াশোনা। তারপর সিটি কলেজ থেকে বাংলার স্নাতক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। হাইস্কুল থেকেই অভিনয় শুরু।

১৯৫৬ সালে সত্যজিৎ যখন ‘অপরাজিত’ বানাচ্ছেন, তখন সৌমিত্র ২০ বছর। আলাপ হলেও তখন তার মধ্যে অপুর ‘কৈশোর’ দেখতে পাননি সত্যজিৎ। কিন্তু দু’বছর পর ‘অপুর সংসার’-এ সত্যজিতের ‘অপু’ হলেন তিনি। ‘জলসাঘর’-এর শ্যুটিং–ক্লান্ত বিশ্বম্ভর রায়ের সামনে দাঁড় করিয়ে সটান বললেন সত্যজিৎ, ‘এই হল সৌমিত্র চ্যাটার্জি। আমার পরের ছবির অপু।’ তার চেহারা সম্পর্কে তখন এতটাই মুগ্ধতা ছিল সত্যজিতের, যে বলেছিলেন, ‘তরুণ বয়সের রবীন্দ্রনাথ।’

আর সৌমিত্র বলেছেন, ‘আমি তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওতেও কাজ করি। অভিনয়ের প্রতি বেশ আগ্রহী। তা জেনেই তিনি আমাকে ডাকলেন। গেলাম। সত্যজিৎবাবু আমাকে দেখামাত্র বললেন, ‘আরে না-না! তোমার বয়সটা একটু বেশি মনে হচ্ছে।’ প্রথমে না বললেও পরে নিজেই আগ্রহভরে নিলেন। সুধীজনের আগ্রহ ও দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ায় ছবিটির পর তিনি আবার পরবর্তী সিনেমা নির্মাণের কাজে হাত দেন। সেটির নাম ‘অপুর সংসার’। আমার সঙ্গে কোনওরকম কথা না বলেই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, অপুর সংসারে আমার কাজ করতে হবে। এভাবেই শুরু। তার পর একের পর এক হাঁটা অভিনয় জগতে।’

আড়াই শরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র । মনে থেকে যায় ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘ঝিন্দের বন্দি’, ‘একটি জীবন’, ‘কোনি’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘দত্তা’ । নায়ক হিসেবে তিনি তার সমসাময়িক সব নায়িকার বিপরীতেই সাফল্য পেয়েছেন। সম্ভবত তাই তেমন করে কারও সঙ্গে ‘জুটি’ গড়ে উঠেনি। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘দত্তা’ ছবিতে সৌমিত্র হয়ে উঠেছিলেন অনন্য। তেমনই সাবিত্রী, সুপ্রিয়া, অপর্ণারাও সৌমিত্রের সঙ্গে মিশেছেন অবলীলায়।

১৯৬১ সাল সৌমিত্রের অভিনয় জীবনে মাইলফলক। ওই বছরই মুক্তি পায় তপন সিনহা পরিচালিত ‘ঝিন্দের বন্দী’। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সেই ছবিতে সৌমিত্রকে প্রথম দর্শক পেয়েছিলেন একটি খলচরিত্রে। নাম ‘ময়ূরবাহন’। যে অভিনেতা ‘অপু’ হিসেবে দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘দেবী’ বা ‘সমাপ্তি’-তে যে নায়ক ঝড় তুলেছেন, সেই অভিনেতাকে তপন সিনহা দিলেন এক নিষ্ঠুর ভিলেনের চরিত্র। তখনও বাংলার দর্শকের সাহিত্য পড়ার অভ্যাস ছিল। উপন্যাসে ময়ূরবাহনকে একজন অত্যন্ত ‘সুদর্শন ও লম্পট’ যুবক হিসেবে বর্ণনা করেছেন শরদিন্দু। এমন একটি চরিত্রে সৌমিত্রকে যে কেউ ভাবতে পারেন, সেটাই ছিল আশ্চর্যের।

২০০৪ সালে ‘পদ্মভূষণ’, ২০০৬ সালে ‘পদক্ষেপ’ ছবিতে জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত সৌমিত্র ২০১১ সালে ভারতীয় সিনেমার সর্বোচ্চ সম্মান ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পান। ঘটনাচক্রে, তার ছ’বছর পর ২০১৮ সালে তিনি ভূষিত হন ফরাসি সরকারের সেরা নাগরিক সম্মান ‘লিজিয়ঁ দ’নর’-এ। তার মানসপিতা সত্যজিতের ঠিক ৩০ বছর পর।

সৌমিত্রর মৃত্যুতে বাংলা চলচ্চিত্রের একটা যুগ যেন শেষ হয়ে গেল। করোনাই যেন অনুঘটকের মতো সৌমিত্রকে এগিয়ে নিয়ে গেল সেই না-ফেরার দেশে। তবে অনেকরকম জটিলতাই দেখা গিয়েছিল শরীরে।

চিকিৎসকদের সূত্রে জানা যাচ্ছে, মাল্টিঅর্গান ফেলিওর, ব্রেনডেথ হয়ে মৃত্যু হয়েছে সৌমিত্রের! বুধবার বিকেলের পর থেকেই চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যান এই বর্ষীয়ান অভিনেতা।

আরো পড়ুন: না ফেরার দেশে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

রোববার সকালে হাসপাতাল থেকে জানানো হয়, মৃত্যু হয়েছে সৌমিত্রের। ৪০ দিন ধরে বেলভিউতে ভর্তি ছিলেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।

খুব স্বাভাবিকভাবেই তাই করোনামুক্ত শরীর একটু-একটু করে হারাতে বসেছিল রোগের সঙ্গে লড়াইয়ের ক্ষমতা। ফলে তাকে দীর্ঘদিন লাইফ সাপোর্টে রাখতেও হয়েছিল।

৫ অক্টোবর কোভিড টেস্টের রিপোর্ট আসে সৌমিত্রের। পরের দিন বেলভিউ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় অভিনেতাকে। কোভিড-মুক্ত হন তিনি। শারীরিক অবস্থার খানিক উন্নতির কথাও জানানো হয় হাসপাতালের তরফে।

তবে শেষ পর্যন্ত বাধ সাধল কো-মর্বিডিটি ফ্যাক্টর। একের পর এক অঙ্গ নিষ্ক্রিয় হতে থাকল। কোভিড-এনসেফ্যালোপ্যাথিই এর কারণ বলে জানান চিকিৎসকেরা। একটু একটু করে অবস্থার অবনতি হতে থাকে রোজই। শেষ রক্ষা হল না। আজ সকালেই সৌমিত্রের মৃত্যুর খবর ঘোষণা করল হাসপাতাল।

বাংলাদেশ জার্নাল/এইচকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত