ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২৫ মিনিট আগে
শিরোনাম

জেনিফার থেকে মেহু: অলিম্পিক ছেড়ে দেয়া সেই মেয়েটিই ‘সুপারস্টার’

  ইমরুল নূর

প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২১, ১৩:১০  
আপডেট :
 ১৯ এপ্রিল ২০২১, ১৩:২৩

জেনিফার থেকে মেহু: অলিম্পিক ছেড়ে দেয়া সেই মেয়েটিই ‘সুপারস্টার’
মেহ্জাবীন চৌধুরী

ঠিক এগারো বছর আগে শোবিজে নাম লিখিয়েছিলেন একটি নতুন মুখ। ‘লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার ২০০৯’ সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে হাজারো প্রতিযোগীকে পেছনে বিজয়ীর মুকুট ছিনিয়ে নিয়েছিলেন চট্টগ্রামের শান্তশিষ্ট ও লাজুক স্বভাবের একটি মেয়ে, তার নাম মেহ্জাবীন চৌধুরী। মডেলিং তারপর অভিনয় দুই জায়গাতেই হয়ে উঠেন অনন্য। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেকে তৈরি করেছেন একজন ‘ভার্সেটাইল অভিনেত্রী’ হিসেবে। অভিনয় নৈপুণ্যে দর্শক মনে ঠাঁই করে নেওয়া এ অভিনেত্রী বর্তমান সময়ে টেলিভিশন পর্দার এক অপরিহার্য নাম। শুধু তাই নয়, সময়ের সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন নায়িকা হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছেন তরুণ জনপ্রিয় এ অভিনেত্রী।

১৯শে এপ্রিল অর্থাৎ আজকের এই দিনে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মেহ্জাবীন। পুরো নাম মেহ্জাবীন চৌধুরী আর ডাক নাম জেনিফার। জেনিফার নামে তাকে শুধু তার পরিবার ও বন্ধুরাই ডাকেন। এর বাইরে তাকে সবাই মেহ্জাবীন নামেই চেনেন। জন্মের এক বছরের মাথাতেই বাবার চাকুরীর সুবাদে তাকে চলে যেতে হয় সুদূর ওমানে। তাই চট্টগ্রামে জন্মালেও তার বেড়ে উঠা ওমানে। মাতৃভাষা বাংলা শেখার সুযোগ না পাওয়া সেই মেয়েটি বড় হয়েছে ইংরেজি ভাষা শিখে। সেখানকার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা বেশ ভালোই চলছিলো। বন্ধুপ্রিয় এই মানুষটির সঙ্গে বেশ কয়েকজনের ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। সেখানে পড়াশোনা চলাকালীন সময়েই অর্থাৎ কিশোরী বয়সেই ওমানের শীর্ষস্থানীয় ম্যাগাজিন ‘টাইমস অব ওমান’ এর কাভার স্টোরিতে স্থান পায় ছোট্ট মেহ্জাবীন। ওই সময়ে সেখানকার জুয়েলারির জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ‘ ডি ড্যামাস’ ব্র্যান্ডের হয়েও কাজ করেছিলেন তিনি।

এরপর ২০০৮ সালের শেষের দিকে মাত্র ছ’ মাসের জন্য বাংলাদেশে আসেন মেহ্জাবীন। এখানে কোনো বন্ধু না থাকায় অনেকটা ডিপ্রেশনে চলে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিলো তার। এরপর মাথায় চিন্তা এলো যদি এখানে শোবিজে কাজ করা যায় তাহলে হয়তো কিছু বন্ধু পেতে পারেন। সেই চিন্তা থেকেই ২০০৯ সালে ‘লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার’ সুন্দরী প্রতিযোগিতায় নাম লেখান তিনি। সেসময় বয়স তুলনামূলক কম হওয়ায় অডিশনের দিন অনেকেই তাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করেছিলেন, প্রতিযোগিতার অযোগ্য ভেবে বিচারকদের সামনে পর্যন্তও যেতে দিচ্ছিলেন না। সেসব মানুষদের ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে হাজারো প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে নিজের মেধা, বুদ্ধিমত্তা এবং অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যস্পৃহা দিয়ে ২০১০ সালের ২২শে জানুয়ারী সেই কম বয়সী তরুণী-ই জয় করে নিলেন বিজয়ীর মুকুট; তিনিই হাসলেন চূড়ান্ত হাসি।

পড়াশোনায় কিছুটা ফাঁকিবাজ ছিলেন তিনি কিন্তু খেলাধূলায় ছিলেন দুর্দান্ত মেধাবী। মাধ্যমিকেই সেরার কৃতিত্ব স্বরূপ জিতে নিয়েছেন ১৫টিরও বেশি মেডেল। অনেকের স্বপ্ন থাকে ডাক্তার, প্রকৌশলী কিংবা পাইলট হওয়ার। কিন্তু মেহ্জাবীনের স্বপ্ন ছিলো খেলাধূলাকে ঘিরেই। অলিম্পিক বা এশিয়ান গেইমসে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছা ছিলো তার। নিজের দেশের হয়ে খেলবেন, নিজের দেশকে রিপ্রেজেন্ট করবেন; এমন স্বপ্নই দেখতেন কিশোরী বয়সে। সেই সুযোগ এলেও ২০১০ সালে মুকুট জয়ীর কারণে তা আর হয়ে উঠেনি। তখন নিজেকে শোবিজেই প্রতিষ্ঠিত করবেন বলেই স্থির করেন।

২০১০ সালেই প্রথম অভিনয়ে নাম লিখান। নাটকের নাম ‘তুমি থাকো সিন্ধুপাড়ে’। ইফতেখার আহমেদ ফাহমি পরিচালিত এ নাটকে মেহ্জাবীনের বিপরীতে ছিলেন মাহফুজ আহমেদ। নাটকটি প্রচারে আসে একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে। সেই থেকে শুরু। এরপর ক্রমান্বয়ে বিজ্ঞাপন, নাটকে নিজেকে মেলে ধরতে থাকেন তিনি। ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত অভিনয়টাকে সিরিয়াসলি নেননি তিনি। কারণ, দেশের বাইরে বড় হওয়া আর ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা করায় বাংলায় তেমন কথা বলতে পারতেন না। যার কারণে প্রথম দিকে অভিনয় করতে গিয়ে নানান সমস্যার মুখে পড়তে হতো তাকে। বাংলা স্ক্রিপ্ট ইংরেজিতে অনুবাদ করে তারপর কাজ করতে হতো তাকে। এভাবে অনেকটা সময় চলে যেত তার। পরে পরিচালক, সহশিল্পীদের সহযোগিতায় বাংলা আয়ত্ত করেন।

তিনি প্রথম আলোচনায় আসেন ২০১৩ সালে শিখর শাহনিয়াত পরিচালিত ‘অপেক্ষার ফটোগ্রাফি’ নাটক দিয়ে। চমৎকার গল্প এবং মেহ্জাবীন-আফরান নিশো জুটির কেমিস্ট্রি সেসময় বেশ প্রশংসা পেয়েছিল। সেই দর্শকপ্রিয়তা বজায় রাখতে ২০১৩ সাল থেকে মডেলিংয়ের পাশাপাশি নিয়মিত অভিনয়ে মনোযোগ দিতে শুরু করেন। তারপর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে তার ব্যস্ততা এবং ভালো কাজের পরিমাণ। এরপর ২০১৭ সালে মিজানুর রহমান আরিয়ান পরিচালিত ‘বড় ছেলে’ নাটক দিয়ে জিয়াউল ফারুক অপূর্বর সঙ্গে জুটি বেঁধে রীতিমত বাজিমাত করে দেন মেহ্জাবীন। এরপর থেকে ছোট পর্দায় একচ্ছত্র অভিনয়ে তিনি ছাপিয়ে গেছেন অন্যদের। দর্শক ও ভক্তদের ভালোবাসায় মেহ্জাবীন থেকে হয়ে উঠেন মেহু। ভক্তরা ভালোবাসে তাকে এ নামেই ডাকেন। পরিবারের বাইরেও এমন নামে অভিষিক্ত হবেন, তা কখনো ভাবেননি এ নায়িকা। তবে এখন শুধু ভক্তরাই নয়, শুটিং সেটে সবাই তাকে মেহু বলেই ডাকেন।

বিভিন্ন সময়ে অভিনয় নিয়ে সমালোচনার মুখেও পড়েছেন তিনি। অনেকেই তাকে নিয়ে হাসাহাসিও করেছে। দিনের পর দিনে নানামাত্রিক চরিত্রে অভিনয় তাকে করে তুলেছে পরিপূর্ণ। এই সময়ে তরুণদের মধ্যে অভিনয়ে হয়ে উঠেছেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। গল্প ও চরিত্র নিয়ে গবেষণা করা, নিজেকে ধারণ করা; এটাই যেন তার বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। রোমান্টিক, সামাজিক, স্যাড, সচেতনতামূলক, পারিবারিকসহ সব ধরণের গল্পে ও চরিত্রে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। নানামাত্রিক চরিত্রে হাজির হয়ে, অভিনয়গুণে নিজেকে ভার্সেটাইল অভিনেত্রী হিসেবে প্রমাণ করেছেন। নিজেকে গড়ে তুলেছেন পানির পাত্রের মত। তাকে যেই চরিত্রই দেওয়া হোক না কেন, সেটাতে পারদর্শিতার ছাপ রাখতে জানেন তিনি। ছন্দে ফেলে নিজের অপূর্ণতাগুলোকে ক্রমেই পূর্ণতা দিয়েছেন। অভিনয়গুণেই হয়ে উঠেছেন সুপারস্টার। শোবিজের আকাশে যেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। সবার নানান কটুকথা, হাসি-ঠাট্টার জবাব মুখে না দিলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাজেই দিয়ে দিয়েছেন এই তরুণী।

নাটক, বিজ্ঞাপন, মডেলিং ছাড়াও একজন দক্ষ নৃত্যশিল্পী হিসেবেও তিনি মুগ্ধতা ছড়িয়ে এসেছেন বহুদিন ধরে। এখন পর্যন্ত প্রায় দুই শতাধিক নাচ মঞ্চায়িত করেছেন তিনি। এমনকি ২০১৫ সালে ডিসিআরইউ শোবিজ অ্যাওয়ার্ডে বেস্ট ড্যান্সারের খেতাবও পান তিনি। তবে বর্তমানে নাটকের ব্যস্ততার কারণে আগের তুলনায় নাচে অনিয়মিত তিনি।

২০১২ সালে বাবিসাস এবং সিজেএফবি অ্যাওয়ার্ডে সেরা মডেলের পুরস্কার অর্জন করেন মেহ্জাবীন। ২০১৪ সালে সাঁকো টেলিফিল্ম অ্যাওয়ার্ডে সেরা মডেল নির্বাচিত হয়েছেন। এরপর ২০১৭ সালে মেরিল প্রথম আলো পুরস্কারে সেরা টিভি অভিনেত্রীর সম্মাননা পান। পরের বছরও অর্থাৎ ২০১৮ সালে মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার ও আরটিভি স্টার অ্যাওয়ার্ডে সেরা অভিনেত্রীর সম্মাননা পান। একই বছরে বাবিসাস অ্যাওয়ার্ডেও সেরা টিভি অভিনেত্রী নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৯ সালে আরটিভি স্টার অ্যাওয়ার্ডস অনুষ্ঠানে আবারও শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী নির্বাচিত হন। সেই ধারবাহিকতায় ২০২০ সালে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে দুটি আরটিভি স্টার অ্যাওয়ার্ডস সম্মাননা পান।

দেখতে দেখতেই এই অঙ্গনে কেটে গেলো ১১টি বছর। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অভিনয় করেছেন প্রায় ৪৩০টির মতো নাটকে। বিজ্ঞাপনে দেখা গিয়েছে প্রায়৭০/৮০টির মতো। আগামী ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তার অভিনয় ক্যারিয়ারের এক যুগ পূর্ণ হবে। এই অঙ্গনে পা মারিয়ে একটু একটু করেই করেই অভিনয় নৈপুণ্যে নিজের একটা শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। হাঁটতে চান আরও অনেকটা পথ।

বাংলাদেশ জার্নাল/আইএন

  • সর্বশেষ
  • পঠিত