ঢাকা, রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৭ মিনিট আগে
শিরোনাম

হংকংয়ের বিক্ষোভ দমনে যা করতে পারে চীন

হংকংয়ের বিক্ষোভ দমনে যা করতে পারে চীন
গত ৯ জুন থেকে হংকংয়ে চলছে বিক্ষোভ

হংকং-এর বিক্ষোভ চলছে কয়েক সপ্তাহ ধরে। বিতর্কিত প্রত্যর্পণ আইনের বিরোধিতায় এই বিক্ষোভ ক্রমশই সহিংস হয়ে উঠেছে। সহিংসতা আর ধর্মঘট সেখানকার জনজীবনে বিস্তর ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে।

চীন সরকার বিক্ষোভকারীদের কড়াভাষায় সমালোচনা করেছে। অনেকের মনেই এখন প্রশ্ন চীন কি শেষ পর্যন্ত ধৈর্য হারাবে এবং বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে সেখানে সরাসরি কোনো পদক্ষেপ নিতে উদ্যোগী হবে? কিন্তু চীনের এক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করার আইনগত কতটা অধিকার আছে? তাছাড়া হংকংয়ে চীনের সামরিক পদক্ষেপের সম্ভাবনাই কতটুকু?

চীন কি সৈন্য পাঠাতে পারে?

মূল আইন খুবই পরিষ্কার। ১৯৯৭ সালে ব্রিটেন হংকং-এর প্রশাসন চীনের কাছে ফিরিয়ে দেবার পর হংকংএর একটা ছোটখাট নতুন সংবিধান তৈরি করা হয়েছিল। সে অনুযায়ী যতক্ষণ না হংকংয়ে সার্বিকভাবে জরুরি অবস্থা জারি হচ্ছে অথবা হংকং-এ যুদ্ধাবস্থা ঘোষণা করা হচ্ছে, ততক্ষণ চীনের সামরিক হস্তক্ষেপ একমাত্র ঘটতে পারে হংকং সরকার সে অনুরোধ জানালে। এছাড়া ‘জন শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে এবং দুর্যোগের সময় ত্রাণকাজে’র সময়ও চীন সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে।।

তবে বেশিরভাগ বিশ্লেষক বলছেন এই পর্যায়ে পিএলএ বা পিপলস লিবারেশন আর্মির সৈন্যদের হংকংএর রাস্তায় নামানোর বিষয়টা প্রায় চিন্তার বাইরে।

‘এটা কাঠামোগত এবং অর্থনৈতিক পরিবেশে একটা নাটকীয় পরিবর্তন নিয়ে আসবে। এধরনের পদক্ষেপের পরিণতি সূদুর-প্রসারী হতে পারে।’বলছেন হংকং-এ চীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইভান চয়।

ড: চয় বলছেন হংকং-এর দায়িত্ব হস্তান্তরের পর থেকে যে ‘এক দেশ- দুই পদ্ধতি’মডেলে হংকং এর শাসন ব্যবস্থা চলে এসেছে, এধরনের পদক্ষেপের ফলে তার ওপর আস্থা পুরো ভেঙে যাবে। এতটাই যে সম্ভবত সে বিশ্বাস আর পুনরুদ্ধার করা যাবে না।

হস্তান্তরের পর থেকে হংকং-এ পিএলএ-র প্রায় ৫০০০ সৈন্য রয়েছে। ম্যাককোয়ারি ইউনিভার্সিটির গবেষক অ্যাডাম নাই বলছেন এটা মূলত ‘চীনা সার্বভৌমত্বের একটা প্রতীকি উপস্থিতি’। তবে ৩১শে জুলাই সেনানিবাস তাদের নীরব ও পরোক্ষ ভূমিকা ভঙ্গ করেছে।

প্রতিবাদ নিয়ে একটি ভিডিও প্রকাশ পেয়েছে যাতে দেখা যাচ্ছে সৈন্যরা ক্যান্টনিজ ভাষায় চিৎকার করছে, ‘এর পরিণতির জন্য আপনারা পুরো দায়ী থাকবেন!’সৈন্যরা বিক্ষোভকারীদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং ফুটেজের একটি দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে পুলিশ একটি ব্যানার ধরে রয়েছে যাতে লেখা ‘এগোন বন্ধ কর, নাহলে আমরা শক্তি ব্যবহার করব’। সাধারণত অসন্তোষের সময় হংকং পুলিশ এধরনের ভাষা ব্যবহার করে থাকে।

হংকংয়ে কয়েক হাজার চীনা সেনা রয়েছে

ড: চয় বলছেন বেইজিং ক্রমাগত হংকং-এর মানুষকে মনে এটি করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে যে, তাদের সামরিক শক্তি ব্যবহারের সম্ভাবনা আছে। আর তারা এমন পদক্ষেপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিতে চায় না। তাদের আশা এটা বিক্ষোভকারীদের ওপর একধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করবে।

এ যাবৎ চীনের হংকং বিষয়ক সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারনী দপ্তর বলে এসেছে যে হংকং পুলিশ অসন্তোষ দমন করতে পারবে সে ব্যাপারে তাদের পূর্ণ আস্থা আছে। তবে তাদের মুখপাত্র ইয়াং গুয়াং এমন হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন যে ‘যারা আগুন নিয়ে খেলছে, সেই আগুনই তাদের ধ্বংস করবে’এবং বিক্ষোভকারীরা যেন মনে না করে যে ‘সংযমের অর্থ দুর্বলতা।’

চাই বিবিসিকে বলেছেন, সামরিক হস্তক্ষেপ চীনা সরকারের জন্য মস্ত বড় একটা রাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরি করবে, দেশের ভেতর এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। এছাড়াও যে কোনোরকম সামরিক হস্তক্ষেপ পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে পারে, আরও প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারে।

চীন কি রাজনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারে?

হংকং-এর রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুরোপুরি গণতান্ত্রিক নয়। বিক্ষোভকারীদের বিরোধিতার পেছনে সেটা একটা কারণ। তারা গণতান্ত্রিক সংস্কারের আহ্বান জানাচ্ছে। অন্যদিকে, চীন হংকং-এর রাজনীতিতে বেশ কিছু হস্তক্ষেপ করেছে। তার থেকেই সর্বসাম্প্রতিক এই বিক্ষোভের জন্ম।

হংকং-এর সংসদ , আইনপ্রণয়নকারী পরিষদ- চীনপন্থী এবং আংশিক গণতান্ত্রিক। এর প্রায় অর্ধেক আসনে প্রার্থী নির্বাচিত হন ভোটারদের প্রত্যক্ষ ভোটে। প্রধান নির্বাহীকে নির্বাচিত করেন প্রধানত বেইজিংপন্থি একটি নির্বাচনী কমিটি। ভোটারদের মাত্র ৬ শতাংশের ভোটে এই কমিটি নির্বাচিত হয়।

সমালোচকরা বলেন, এ কারণে হংকং-এর নেতৃত্বের দায়বদ্ধতা চীনের কাছে, হংকং-এর জনগণের কাছে নয়।

ক্যারি ল্যাম নির্বাচিত হন ২০১৭ সালে। বর্তমানে অকার্যকর প্রত্যর্পণ বিলটি তিনিই চালু করেন এবং এই বিক্ষোভে জনরোষের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন।

হংকং-এ বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডিক্সন মিং সিং বলছেন চীন ‘তার ক্ষমতা প্রদর্শনের লক্ষ্যে অনেক কিছুই করেছে...এছাড়াও ক্যারি ল্যামের পদত্যাগের প্রশ্নে প্রবল আপত্তি বজায় রেখেছে, পাশাপাশি প্রত্যর্পণ বিলটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

‘বেইজিং যদি ক্যারি ল্যামের পদত্যাগ চায় সেটা কি সম্ভব?’এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলছেন, ‘অবশ্যই। কিন্তু চীনা কর্তৃপক্ষ সেটা চায় না। কারণ তারা দেখাতে চায় যে জনগণের দাবিতে তারা নীতি বদলায় না।’

তবে, ল্যাম তার পদ ছেড়ে দিলেও, তার উত্তরসূরী হবেন বেইজিং-এর সমর্থনপুষ্ট আরেকজন।

চীন কি আন্দোলনকারীদের চিহ্ণিত করে পদক্ষেপ নিতে পারে?

হংকং-এ বিক্ষোভের সূত্রপাত হয় প্রত্যর্পণ আইন বিষয়ক বিল নিয়ে। সমালোচকদের আশঙ্কা রাজনৈতিক আন্দোলনকারীদের চীনের মূল ভূখন্ডে নিয়ে যাবার জন্য চীন এই আইন ব্যবহারের পরিকল্পনা নিয়েছিল। সেখানে তাদের দণ্ড দেওয়া প্রায় নিশ্চিত হয়ে যেত।

ক্যারি ল্যাম বলেছেন এই বিল এখন মৃত। কিন্তু এই বিল না থাকলেও এধরনের আইনের পাশ কাটিয়ে চীনের হংকং-এর নাগরিকদের আটক করার যথেষ্ট দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেটা হংকং-এর নাগরিকদের জন্য উদ্বেগের।

গুই মিনহাইয়ের হংকংএ একটি বইয়ের দোকান ছিল। তিনি চীনা সরকার বিরোধী বই বিক্রি করতেন। ২০১৫ সালে তিনি থাইল্যান্ডে নিখোঁজ হয়ে যান। এরপর ২০০৩ সালে এক ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে চীনে তিনি ধরা পড়েন।

চীনের এক আদালত তাকে দুবছরের কারাদণ্ড দেয়। ২০১৭ সালে তিনি মুক্তি পান, কিন্তু পরের বছরই চীনে একটা রেলগাড়ি থেকে তাকে আবার আটক করা হয়। এরপর থেকে কেউ আর তাকে দেখেনি।

হংকং বিক্ষোভকারীরা ভয় পাচ্ছেন তারা নিজেরা ধরা না পড়লেও চীনের মূল ভূখন্ডে তাদের পরিবারের সদস্যরা দমনপীড়নের শিকার হতে পারেন।

হংকং-এ এই মুহূর্তে চীনের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ নিয়ে আশংকা বিরাজ করছে। পাশাপাশি বিক্ষোভ দমনে চীনের সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র এখন অর্থনৈতিকভাবে হংকংকে শাস্তি দেয়া।

হংকং অর্থনীতির একটা মূল কেন্দ্র। হস্তান্তর চুক্তির অংশ হিসাবে যেসব বিশেষ সুবিধা তাদের দেওয়া হয়েছিল তা হংকংকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করেছে। কিন্তু এরপরেও ১৯৯৭ সালের পর থেকে মূল ভূখন্ডে শেনঝেন আর শাংহাই দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছে।

এখন হংকং যদি চীনের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানো অব্যাহত রাখে, তাহলে চীন সরকার বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মূল ভূখন্ডকেই অগ্রাধিকার দেবে এবং চেষ্টা করবে হংকংএর অর্থনীতিকে চাপে রাখতে। তারা চাইবে এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে, যাতে হংকং তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য চীনের মুখাপেক্ষী হতে বাধ্য হয়। হংকং বিক্ষোভের পরিণতি যেন শেষ পর্যন্ত সেই দিকে না চায় হংকংয়ের শুভাকাঙ্খীদের সেটাই প্রার্থণা।

চীনা আগ্রাসনের মুখে হংকং

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত