ঢাকা, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ০১ জানুয়ারি, ১৯৭০
শিরোনাম

ভারত পাকিস্তানে পরমাণু হামলা চালাতে চায় কেন?

ভারত পাকিস্তানে পরমাণু হামলা চালাতে চায় কেন?

পারমানবিক শক্তিধর দেশ হওয়া সত্ত্বেও বহু বছর নিজে থেকে কারো ওপর পারমানবিক হামলা না কারার নীতিতে অটল রয়েছে ভারত। কিন্তু সম্প্রতি সেই নীতি থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছেন সে দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং। কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের আরেক পরমাণু ক্ষমতাসম্পন্ন পাকিস্তানের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার মধ্যেই এই ঘোষণা দিলেন তিনি। আর ভারতের এমন ঘোষণার ফলে দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ও শান্তি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।

গত ৫ আগস্ট ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাদানকারী ৩৭০ অনুচ্ছেদটি বাতিল করার ঘোষণা দেয় মোদি সরকার। এই ঘোষণার পরপরই প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে ভারত। ইতিমধ্যে গুলি বিনিময়ে দুই দেশেরই বেশ কয়েকজন সেনা ও সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এ ঘটনায় নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে ইসলামাবাদ। তাদের আহ্বানের মুখে ইতিমধ্যে একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলো।

এই প্ররিস্থিতিতে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং সম্প্রতি পোখরানে সাংবাদিকদের বলেছেন, ভারত এতদিন ধরে নিজে থেকে কারো ওপর পারমানবিক হামলা না কারার নীতি মেনে এসেছে। কিন্তু ভবিষ্যতে ‘উদ্ভূত পরিস্থিতির ওপর’নির্ভর করবে এই নীতির বহাল থাকা বা না থাকা।

তার ভাষায়, ‘ওই নীতি চিরস্থায়ী কিছু নয় এবং বড় কোন সংকটে পড়লে ভারত ঐ নীতিতে অটল থাকবে বিষয়টি তেমন নয়।’

পোখরানেই প্রথম পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালায় ভারত

তার এ কথার একটি তাৎপর্য হলো নব্বই এর দশকের শেষ দিকে পোখরানেই ভারত পরমাণু পরীক্ষা চালিয়েছিল। একই কথা রাজনাথ তার নিজের অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকেও পোষ্ট করেন এবং সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো থেকে একই বার্তা দিয়ে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিও জারি করা হয়।

এটাই ছিল ভারত সরকারের তরফ থেকে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক ইঙ্গিত যে, ভারত হয়ত শীঘ্রই তার 'নো ফার্স্ট ইউজ ডকট্রিন' অর্থাৎ আক্রান্ত হবার আগে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে যাচ্ছে। অর্থাৎ নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে দরকার মনে করলে ভারত নিজেই এখন পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে।

নো ফার্স্ট ইউজ নীতি কী?

এটি লিখিত কোন চুক্তি বা নীতিমালা নয়। স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্য এদের সবারই পরমাণু হামলা চালাবার অধিকার ছিল। এক্ষেত্রে প্রথমে পরমাণু হামলা চালানোর পক্ষে দুইটি যুক্তি ছিল--

১. যদি কোন রাষ্ট্র প্রচলিত সামরিক শক্তি ব্যবহার করে যুদ্ধক্ষেত্রে হারতে বসার উপক্রম হয়, তাহলে প্রতিপক্ষকে হারানোর জন্য কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে, অথবা

২. কোন রাষ্ট্রের যদি আশংকা থাকে যে প্রতিপক্ষ তার ওপর পরমাণু হামলা চালাতে পারে, তাহলে নিজের নিরাপত্তার জন্য ঐ রাষ্ট্র আগে পরমাণু হামলা চালাতে পারবে।

১৯৯৮ সালে ভারত যখন প্রথম পারমানবিক পরীক্ষা চালায়, দেশটি তখন ঘোষণা দিয়েছিল, পরমাণু অস্ত্র কেবলমাত্র আক্রান্ত হলে জবাব দেবার কাজে ব্যবহার করা হবে। ভারত বলেছিল, এই পরমাণু অস্ত্রের মাধ্যমে এ অঞ্চলে সংঘাত কমানো সম্ভব হবে।

১৯৬৪ সালে চীন যখন পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা চালায়, সেসময় তারাও একই ঘোষণা দিয়েছিল। তখন বেইজিং বলেছিল, কোন অবস্থাতেই চীন প্রথমে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করে কারো ওপর হামলা চালাবে না। ১৯৬৪ এবং ১৯৬৬ সালের মধ্যে চীন তিনবার পরমাণু পরীক্ষা চালায়। যদিও ভারত কখনোই চীনের ঐ ঘোষণায় বিশ্বাস করেনি। বরং চীনের কারণেই ভারত নিজে পারমানবিক শক্তি অর্জনের প্রকল্প হাতে নিয়েছিল।

ভারত আর চীন ব্যতীত পৃথিবীর অন্য কোন দেশেরই ‘নো ফার্স্ট ইউজ ডকট্রিন’ নীতি নেই।

উত্তর কোরিয়াও এক সময় এ কথা বলেছিল। কিন্তু তার কথা কেউ বিশ্বাস করেনি। কারণ তার পরমাণু শক্তি অর্জনের মূল কারণটি ছিল দক্ষিণ কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ আক্রমণ ঠেকানো। ফলে সে আক্রান্ত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে এমন বিশ্বাস কারোই ছিল না। এমনকি ভারতের সবচেয়ে কাছের শত্রু পাকিস্তান নিজেই আগে পরমাণু হামলা চালাতে পারবে।

ভারত কেন এ নীতি বদলাতে চায়?

গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে ভারত যে নীতি মেনে চলছে, তা নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত বরাবরই ছিলো। কিন্তু এবারের মত সরকারের শীর্ষস্থানীয় কোনো ব্যক্তি এভাবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেননি। ১৯৯৮ সালে ‘নো ফার্স্ট ইউজ ডকট্রিন’ঘোষণার পর, ২০০৩ সালে ভারত সেটির কিছুটা সংস্কার বা পরিমার্জন করে। যাতে বলা হয়, কেবল পারমানবিক হামলা নয়, কেমিক্যাল বা বায়োলজিক্যাল অস্ত্র ব্যবহার করে কেউ হামলা চালালেও ভারত পরমাণু হামলা চালাতে পারবে।

২০১৬ সালে ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকার প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, এই নীতির মাধ্যমে ভারত নিজেকে দুর্বল করে তুলছে কিনা। যদিও সেই বক্তব্যকে তিনি নিজের ব্যক্তিগত মত বলে ব্যাখ্যা করেছিলেন।

পরমাণু শক্তিতে পিছিয়ে নেই পাকিস্তানও

১৯৯৮ সালে ভারতের কেবলমাত্র কিছু ব্যালিস্টিক ক্ষেপনাস্ত্র, সীমিত গোয়েন্দা সক্ষমতা এবং আকাশ থেকে হামলা চালানোর মাঝারি মানের সামর্থ্য ছিল।

কিন্তু এখন ভারতের উচ্চতর ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপনাস্ত্র, মহাকাশে কয়েকটি স্যাটেলাইট, নানা মাপের ও সক্ষমতার ছোট বড় ক্ষেপণাস্ত্র যা দিয়ে অল্প দূরত্ব থেকে হামলা চালানো যায়, এমন সব অস্ত্রের বিপুল এক ভাণ্ডার রয়েছে। তাছাড়া রাশিয়া ও ইসরায়েলের সাহায্য নিয়ে ভারত এমন এক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলছে যা প্রতিপক্ষ হামলা চালিয়ে সহজে ধ্বংস করতে পারবে না।

রাজনাথের কথা কেন গুরুত্বপূর্ণ?

'নো ফার্স্ট ইউজ ডকট্রিন' এর মাধ্যমে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে ভারত নীতিগত দিক থেকে একটি উচ্চতর অবস্থানে থাকে। এর মানে হচ্ছে, ভারতের আগে হামলা করার সামর্থ্য আছে, কিন্তু শান্তির জন্য সে তা করছে না। কিন্তু এখন সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার বিষয়টির সমালোচনা করছেন দেশটির অনেক বিশ্লেষক।

অবসরপ্রাপ্ত লে: জেনারেল প্রকাশ মেননের যুক্তি হচ্ছে, এখন একটি দায়িত্বশীল পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসেবে ভারতের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

অন্যদিকে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও এর সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ভারতের পরমাণু অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ এখন ফ্যাসিস্ট, বর্ণবাদী, হিন্দু আধিপত্যবাদী প্রধানমন্ত্রী মোদির হাতে।’

তবে, পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার কোন মতবাদ বা বাকযুদ্ধের ওপর নির্ভর করেনা। বরং পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করবে পুরো বিষয়টি। তবে এর মূল ঝুঁকি হচ্ছে, গত সপ্তাহেই পাকিস্তান কিছুটা গোপনেই জানিয়েছে যে, তারা ভারতের কথা বিশ্বাস করেনা। ফলে যেটা হতে পারে, তা হলো এখন পাকিস্তান আরো বেশি পরমাণু শক্তি বাড়ানোর দিকে নজর দেবে। আর ভারতের সামনে তার পরীক্ষাও চালাবে। সেটাই হবে আসল ঝুঁকি।

এছাড়া যে কোনো সংকটে আগের চেয়ে দ্রুত পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের প্রশ্ন চলে আসতে পারে। তাতে শান্তির জন্য পাকিস্তান কোন উদ্যোগ নেবার পরিবর্তে, বরং তারাও তখন পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে চাইবে।

আপাততঃ রাজনাথের এই ঘোষণার তেমন কোনো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখা না গেলে, ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বাড়বে। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় নিরাপত্তা, শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্টে ভয়াবহ পরিমাণ বয়ে আনতে পারে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত