ঢাকা, রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

দেশে দেশে কেন এত বিক্ষোভ?

দেশে দেশে কেন এত বিক্ষোভ?

গত কয়েক সপ্তাহে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের দেশ যেমন লেবানন, স্পেন ও চিলিতে ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপক বিক্ষোভ। এই আন্দোলনগুলোর ধরন, সেগুলোর কারণ এবং এগুলোর লক্ষ্যের মধ্যে ফারাক থাকলেও কিছু বিষয়ে বিক্ষোভগুলোতে বেশ মিল রয়েছে। হাজার মাইল দূরের কোনো দেশে যখন আন্দোলন শুরু হয়, তখন প্রায় একই বিষয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে, কীভাবে আন্দোলনকে সংগঠিত করা যায় এই নিয়ে বিক্ষোভকারীরা একে অপরের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পায়।

যেসব দেশের লোকজন আন্দোলনে যোগ দিয়েছে তাদের কমন বিষয় হলো বৈষম্য, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও দুর্নীতি। দুর্নীতির সাথে বৈষম্যের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তাদের একটি বড় অংশ দীর্ঘদিন ধরেই নিজের দেশে নিজেদেরকে বঞ্চিত মনে করে এসেছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ কোনো সেবার মূল্য বৃদ্ধির সরকারি সিদ্ধান্ত এই ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছে। কোনো কোনো দেশে বিক্ষোভকারীরা চলমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। রাজনৈতিক স্বাধীনতার অভাবে তারা এক ধরণের বন্দীদশায় থাকার কথা উল্লেখ করেছেন।

একুয়েডর

এই অক্টোবরেই একুয়েডরে দেখা দেয় প্রবল বিক্ষোভ। সরকারি খরচ কমানোর অংশ হিসেবে সরকার হঠাৎ করেই জ্বালানিতে ভর্তুকি বন্ধ করার ঘোষণা দেয়।

ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পরামর্শে অর্থনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে, বহু বছর ধরে চলে আসা এই ভর্তুকি যখন সরকার বন্ধের ঘোষণা দেয় তখনই বিক্ষোভের শুরু।

ভর্তুকি বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্তের পর দেশটিতে পেট্রোলের দাম অনেক বেড়ে যায়। মূল্যবৃদ্ধির এই ভার বহন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় বলে জানিয়েছেন অনেকেই।

আদিবাসী গোত্রের বাসিন্দারা আশঙ্কা করছিলেন, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির কারণে তাদের দৈনন্দিন যাতায়াত ও খাদ্য খরচ বেড়ে যাবে এবং এর বড় কোপটা পড়বে গ্রামীণ জনগণের ওপর।

ফলে, বিক্ষোভকারীরা সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে এবং ভর্তুকির দাবীতে আন্দোলনে নেমে রাজপথ বন্ধ করে দেয়, সংসদে হামলে পড়ে এবং নিরাপত্তারক্ষীদের সাথে সংঘর্ষে জড়ায়। অবশেষে, আন্দোলনের মুখে সরকার পিছু হঠে এবং জ্বালানি তেলে ভর্তুকি বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে।

চিলি

চিলিতে আন্দোলন দানা বাঁধার পেছনেও রয়েছে মূল্যবৃদ্ধি। জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্য এবং দেশটির দুর্বল মুদ্রার কারণ দেখিয়ে চিলি সরকার বাস ও মেট্রোর ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। এই বাস ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদেরই রাস্তায় নেমে আসে লাখ লাখ মানুষ। ওই বিক্ষোভে ইতিমধ্যে আটজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

গত শুক্রবারে আন্দোলনকারীরা যখন নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, ঠিক সেসময় প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনেরাকে ইতালিয়ান এক অভিজাত রেস্তোরাঁয় খেতে দেখা যায়। এই ছবিটিকে অনেকেই ব্যাখ্যা করছেন এই বলে যে, চিলির রাজনৈতিক অভিজাতদের সাথে সাধারণ জনতার যে দুস্তর ফারাক দেখা গিয়েছে এটি তারই প্রতিচ্ছবি।

দাক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম ধনী দেশ চিলি। কিন্তু দেশটিতে তীব্রভাবে ধন-বৈষম্য বিরাজমান। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনোমিক কো-অপারেশন এন্ড ডেভেলপমেন্টের যে ৩৬টি দেশ রয়েছে তার মধ্যে চিলিতেই সবচেয়ে বেশি আয় বৈষম্য রয়েছে।

একুয়েডরে যেমন জ্বালানি তেলের ভর্তুকি বন্ধের সিদ্ধান্ত সরকার প্রত্যাহার করেছে, চিলিতেও ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত সরকার বাতিল করেছে। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা এখন আরো বিবিধ অভিযোগের প্রেক্ষিতে আন্দোলন করছে।

আন্দোলনে অংশ নেয়া এক শিক্ষার্থী রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, 'এটি কেবল মেট্রোর ভাড়া বাড়ানোর প্রতিবাদে একটা মামুলি বিক্ষোভ নয়। বরং এটি হচ্ছে বহু বছর ধরে গরীবদের উপরে চলে আসা নিপীড়ন ও জুলুমের প্রতিবাদ'।

লেবানন

লেবাননেও বিক্ষোভ ছড়িয়েছে কর আরোপের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে। হোয়াটসঅ্যাপ কলের উপরে কর আরোপের সিদ্ধান্ত নেয় লেবানিজ সরকার। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে অর্থনৈতিক সমস্যা, বৈষম্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষ ফুঁসে ওঠে।

যদিও ঋণের ভার বাড়ছে, তবু আন্তর্জাতিক দাতা গোষ্ঠীদের কাছ থেকে বিভিন্ন প্যাকেজ নিয়ে সরকার নানান অর্থনৈতিক সংস্কার করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সাধারণ মানুষেরা বলছেন, সরকারের অব্যবস্থাপনা এবং দেশের অর্থনৈতিক নীতি-নির্ধারণীর বলি হয়েছেন তারা।

বৈরুতে বিক্ষোভে অংশ নেয়া আব্দুল্লাহ বলছিলেন, ‘শুধু হোয়াটসঅ্যাপের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আমরা এখানে আসিনি। আমরা এখানে সব কিছুর প্রতিবাদে এসেছি— জ্বালানি, খাদ্য, রুটি— সবকিছু।’

ইরাক

ইরাকেও চলমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা জানিয়ে এর ইতি টানার আওয়াজ তুলেছে ইরাকি জনতা। ইরাক সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের অভিযোগ, মেধার ভিত্তিতে সরকারী কাজে নিয়োগ না দিয়ে জাতিগত ও অন্যান্য বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।

বিক্ষোভকারীরা বলছেন, জনগণের টাকার শ্রাদ্ধ করে নেতা-নেত্রীরা নিজেরা এবং তাদের অনুসারীদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনে 'পাবলিক ফান্ড' বা সরকারী কোষাগারের অর্থ কোনো কাজেই আসছে না।

মিশর

দুর্নীতির অভিযোগে মিশরীয় সরকারের বিরুদ্ধেও বিক্ষোভ দানা বেঁধেছে। স্পেনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলীর ডাকে গত সেপ্টেম্বরে মিশরে বিক্ষোভ দেখা দেয়। মোহাম্মদ আলী মিশরীয় প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল-সিসি এবং সেনাবাহিনীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন।

সরকারি ফান্ডের টাকা প্রেসিডেন্ট সিসি এবং তার সরকার অপব্যবহার করছে বলে অভিযোগ তুলেন ওই নেতা। সরকারের কৃচ্ছতা নীতির কারণে ভোগান্তিতে থাকা সাধারণ মানুষের ছিল একই অভিযোগ।

হংকং

সরকারি একটি বিলের বিরোধিতা করতে গিয়ে এই গ্রীষ্মে হংকং-এ বিক্ষোভের সূত্রপাত। বিলটিতে বলা ছিল, কোনো অপরাধী ব্যক্তিকে কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে চীনের মূল ভূখণ্ডে হস্তান্তর করা যাবে।

হংকং চীনের অংশ হলেও এই স্থানটি বিশেষ স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে। কিন্তু হংকং-এর মানুষের মধ্যে এই বোধ তীব্র হচ্ছে যে, বেইজিং তাদের উপরে আরো বেশি মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চায়।

চিলি ও লেবাননের মতই হংকং-এর বিক্ষোভেও কাজ হয়েছে। বিতর্কিত বিলটি প্রত্যাহার করেছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তবু বিক্ষোভ এখনো চলমান।

এখন যারা আন্দোলন করছে তাদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে সকল নাগরিকের ভোটাধিকারের দাবি। এছাড়া বিক্ষোভে পুলিশি সহিংসতার স্বাধীন তদন্ত এবং গ্রেফতারকৃত আন্দোলনকারীদের মুক্তির দাবি রয়েছে। তাদের রাজনৈতিক এই কর্মসূচি বিশ্বের আরেক প্রান্তের দেশকেও উদ্বুদ্ধ করেছে।

বার্সেলোনা

কাতালান বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাকে কারাবন্দী করার প্রতিবাদে স্পেনের বার্সেলোনার রাস্তায় নেমে আসে লাখ লাখ মানুষ। ২০১৭ সালে বার্সেলোনায় যে 'অবৈধ' গণভোট আয়োজন করা এবং স্বাধীনতা ঘোষণার কারণে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে তাকে কারাদণ্ড দেয়া হয়।

কিন্তু এই রায় ঘোষণার কিছুক্ষণের মধ্যেই জনপ্রিয় একটি অ্যাপের মাধ্যমে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে, হংকং-এ প্রতিবাদকারীদের মতন একই কায়দায়, 'এল পার্ট এয়ারপোর্ট' এলাকায় সকলে জড়ো হয়।

স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, বিমানবন্দর অভিমুখে যে তরুণেরা আসছিলেন তাদেরই একদল স্লোগান দিয়ে বলছিলেন: 'আমরাও দেখাবো আরেক হংকং'।

পুলিশ যদি জল কামান বা টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে তাহলে কিভাবে নিজেদের রক্ষা করতে হবে সেই বিষয়ে কাতালান বিক্ষোভকারীরা নিজেদের মধ্যে গ্রাফিক্সের মাধ্যমে তথ্য ছড়িয়ে একে অপরকে সতর্ক করেছে।

এএফপিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বার্সেলোনার বিক্ষোভে অংশ নেয়া একজন বলেন, 'এখন মানুষের রাস্তায় নামতে হবে; সকল বিদ্রোহের সেখানেই শুরু, হংকং-এর দিকে তাকিয়ে দেখুন।'

বলিভিয়া

বিতর্কিত পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস যখন নির্বাচনে পুনরায় জয় লাভ করতে যাচ্ছিলো তখন বলিভিয়াতে মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং সংঘর্ষে জড়ায়।

প্রেসিডেন্ট সর্বোচ্চ কয় মেয়াদে থাকতে পারবে এই বিষয়ক বিধানকে মি. মোরালেস যখন বাতিল করার পরামর্শ দিয়েছিল ২০১৬ সালে এক গণভোটের মাধ্যমে মানুষ তার সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছিল।

কিন্তু আদালতে গিয়ে মোরালেসের পার্টি নিজেদের পক্ষে রায় পায় এবং টানা চতুর্থ বারের মতন তার আবার প্রেসিডেন্ট হবার পথ উন্মুক্ত হয়।

কেবল উপরের দেশগুলোই নয়; আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি, স্পেন, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স ও নিউজিল্যান্ডের মতন দেশগুলোতেও বিক্ষোভ চলছে। গত মাসে কয়েক লাখ মানুষ সারা পৃথিবী জুড়ে 'গ্লোবাল ক্লাইমেট স্ট্রাইক'-এ অংশ নিয়েছে। প্যাসিফিক আইল্যান্ড থেকে শুরু করে মেলবোর্ন, মুম্বাই, বার্লিন ও নিউইয়র্কেও সেই আন্দোলনের ঢেউ লেগেছে।

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত