ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : কিছুক্ষণ আগে
শিরোনাম

চেরি ফুলের দেশে

  -শাহজাহান সরদার

প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর ২০২০, ০২:৩০

চেরি ফুলের দেশে

১৩. হিরোশিমা

ইকোহামা থেকে হিরোশিমা মাত্র এক ঘণ্টার বিমান ভ্রমণ। সামান্য স্ন্যাকস ও কোল্ড ড্রিঙ্কস পরিবেশন করা হয় বিমানে। এসব খেতে খেতেই হিরোশিমা বিমান বন্দরে পৌঁছে যাই। ঐতিহাসিক হিরোশিমা। আণবিক বোমায় প্রায় ৫০ বছর আগে জ্বলেছিল যে শহর এখন তা শান্তির নগরী। বোমায় নিশ্চিহ্ন ক্ষত-বিক্ষত, ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরের স্থলে এখন গড়ে উঠেছে আধুনিক শহর। সবুজ শহর। স্মৃতিচিহ্ন বলতে আছে একটি বিল্ডিং আর হিরোশিমা স্মৃতি জাদুঘর। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বাইরে এসেই দেখি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস এবং একজন গাইড আমাদের জন্য অপেক্ষমান। আমরা রওনা দিয়ে দুই কিলোমিটার পথ যাওয়ার পর হঠাৎ তানজানিয়ার জন চিৎকার করে বলতে থাকে রাই কোথায়? রাই নেপালের বন্ধু। আমরা সবাই গাড়িতে তাঁকে খুঁজতে থাকি। কিন্তু না গাড়িতে নেই। আবার গাড়ি ঘুরিয়ে বিমানবন্দরে ফিরে গিয়ে দেখি রাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘামছে। চোখে-মুখে তার অস্থিরতার ছাপ। আমাদের দেখে যেন সে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। আমাদের না পেয়ে অপরিচিত শহর কোথায় যাবে এসব চিন্তা করছিল। চটজলদি গাড়িতে উঠতেই একযোগে সবাই তাকে নিয়ে ছলচাতুরি শুরু করে। কিন্তু রাই তখনো হাঁপাচ্ছিল, কেন এমন হলো জানতে চাইলে রাইের উত্তর বিমান থেকে নেমেই তিনি বাথরুমে গিয়েছিলেন। মনে করেননি এত তাড়াতাড়ি গাড়ি ছেড়ে দেবে। পরে যতদিন আমরা জাপানে ছিলাম প্রতিদিন গাড়িতে ওঠার সময় তাকে টিপ্পনির মুখোমুখি হতে হয়েছে। খবর নেয়া হয়েছে, রাই গাড়িতে আছে কিনা।

বিমানবন্দর থেকে সোজা আমরা এসে পৌঁছি হিরোশিমা শান্তি জাদুঘরে। এখানেই আণবিক বোমার স্মৃতি বহনকারী জাদুঘর এবং শান্তি পার্ক। গাড়ি থেকে নামার আগেই গাইড আমাদের আধা ঘণ্টা সময় দিয়ে বলে এই সময়ের মধ্যে লাঞ্চ সেরে নিতে হবে। এখানে বেশ কয়েকটি হোটেল এবং রেস্তোরাঁ আছে। আমরা ভাগ হয়ে যার যার মতো করে খেতে গেলাম। স্মৃতি জাদুঘরের মূলভবনের মাটির নিচ তলায় রেস্তোরাঁ। খেয়ে সবাই মিলিত হই গাড়ির কাছে। হাজার হাজার মানুষ আসছে যাচ্ছে প্রতিদিন। বেশির ভাগ স্কুল ছাত্র। এ সময় ভিড় হয় বেশি। আমরা হিরোশিমা স্মৃতি জাদুঘরের ভেতরে প্রবেশ করি। পিনপতন নীরবতা। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট আণবিক বোমায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হিরোশিমা নগরী। প্রায় ৫০ বছর পর আজকের হিরোশিমাকে দেখলে মনে হয় না এ নগর, জনপদ বিধ্বস্ত হয়েছিল, নিহত হয়েছিল ২ লাখ লোক। আর ৩ লাখ মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেছিল।

আজকের হিরোশিমা সবুজ শহর। গাছপালায় বড় বড় দালান-কোঠায় কর্মচঞ্চল নগরী। চিহ্ন শুধু জাদুঘর। এ জাদুঘরে সযত্নে সংরক্ষণ করা আছে বোমায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের ইট থেকে শুরু করে স্কুলছাত্রের টিফিন বক্স, জামা-কাপড় এবং মানুষের পুড়ে যাওয়া চামড়া পর্যন্ত। এছাড়া সাক্ষী হয়ে আছেন তখনকার স্কুল ছাত্র, মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া শান্তি জাদুঘরের পরিচালক আকিহিরো তাকাহাসি।

১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এ জাদুঘর ১৯৯২ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত ৩ কোটি লোক পরিদর্শন করে। এর মধ্যে জাপানের স্কুলছাত্রের সংখ্যা বেশি। তবে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, বরেণ্য বিশ্বনেতা ও শান্তি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ এ জাদুঘর পরিদর্শন করেছেন। তারা তাদের যে অনুভূতি লিখে যান এবং এসব জাদুঘরের বারান্দার দেয়ালে দেয়ালে সযত্নে টানিয়ে রাখা হয়েছে। মাদার তেরেসা তাঁর অনুভূতি লিখেছেন। জাদুঘরের বিভিন্ন স্থানে অনেক টেলিভিশন স্থাপন করা আছে। এসব টেলিভিশনে আগুনে নগর পোড়ার দৃশ্য এবং ধ্বংসের ছবি পর্যায়ক্রমে ভেসে উঠে। জাদুঘরে সংরক্ষিত প্রতিটি আইটেম দেখলে চোখের পানি রাখা যায় না। এক স্থানে এক স্কুলছাত্রের একটা টিফিন বক্স রাখা আছে। এতে মিষ্টি এবং একটা কলা কাল হয়ে রয়েছে। হিরোশিমায় যখন বোমা পড়েছিল তখন সময় ছিল সকাল সোয়া ৮টা। স্কুলের ক্লাস শুরু হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত। তাই হাজার হাজার স্কুলছাত্র নিহত হয়েছিল। এ টিফিন বক্স এমনই একজন নিহত স্কুলছাত্রের। মা ছেলেকে টিফিন দিয়ে স্কুলে পাঠিয়েছিল। কিন্তু বোমার হামলায় মা-ও নিহত হয়েছে, ছেলেও নাই। এমনি ঘটনা ঘটেছে অধিকাংশ পরিবারের। এর প্রতীক হিসাবেই জাদুঘরে টিফিন বক্স, ইউনিফর্ম এবং পানির বোতল রাখা আছে। নিহত শিশুদের স্মরণে জাদুঘর সংলগ্ন পার্কে শিশু স্মৃতিসৌধ নিহত ছাত্র-ছাত্রীদের স্মরণে স্থাপন করা হয়েছে। বছর বছর জাপানি লাখ লাখ শিশু, স্কুল ছাত্র এ স্মৃতিসৌধে এসে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। স্মৃতিসৌধে হাতে বানানো খেলার সামগ্রী রেখে যায়।

জাদুঘরে রক্ষিত একটা ঘড়িতে ঠিক সোয়া ৮টায় কাটা থেমে আছে। বোমা হামলার সময়ের প্রতীক হিসেবে এ ঘড়ি রাখা। বাচ্চাদের খাওয়ানো দুধের বোতল যাতে অর্ধেক দুধ আছে, সাইকেল, খেলনা, চায়ের কাপ এমনকি পুড়ে যাওয়া চামড়া বোতলে প্রসেস করে ভরে রাখা হয়েছে। সাদাকু সাসাকি নামের বোমায় আহত এক শিশু দীর্ঘ ১০ বছর হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে। তাকে বাঁচানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সে শিশুর রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টসহ কয়েক শিশুর বিভিন্ন পরীক্ষার রিপোর্ট রাখা আছে জাদুঘরে। প্রতিদিন জাপানি এবং বিদেশি হাজার মানুষ এ জাদুঘর পরিদর্শন করে, যাতে বুঝতে পারে কী ঘটেছিল হিরোশিমায়।

শান্তি জাদুঘরের পরিচালক আকিহিরো তাকাহাসির সাথে আমাদের কথা হয়। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকালে তিনি স্কুলে ১৫০ জন সহপাঠীর সাথে অ্যাসেম্বলির জন্য সমবেত হয়েছিলেন। ঠিক সোয়া ৮টায় প্রচণ্ড আওয়াজে আকাশ আলোকিত করে বোমা পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে চারিদিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে। তাদের স্কুলভবনটি যেন আগুনের ফুলকিতে পরিণত হয়। এ অবস্থায় তিনি এবং তাঁর সহপাঠীরা দৌড়াতে থাকেন। দৌড়ানোর সময় চারিদিক থেকে উচ্চ স্বরে শুধু ক্রন্দনের স্বর শুনতে পান। তিনিও কাঁদছিলেন আর দৌড়াচ্ছিলেন নদীর দিকে। আকিহিরো বলেন, সরু রাস্তা দিয়ে নদীর দিকে যাওয়ার সময় তিনি দেখতে পান আগুনে জ্বলে যাওয়া অসংখ্য বৃদ্ধ ও নারী রাস্তায় পড়ে আছে। কেউ তাদের ওপর দিয়ে ছুটছে। আবার কেউ সাহায্য করার জন্য চেষ্টা করছে। তিনি দেখতে পান, মায়ের বুকে শিশু সন্তান কাঁদছে। মা পুড়ে মরেছে অথবা শিশু অসহায় হয়ে ছুটছে। প্রায় সবার দেহ ঝলসানো। একসময় তিনি দেখতে পান তাঁর নিজের শরীর দিয়েও রক্ত ঝরছে। রাস্তায় তিনি দেখতে পান তার এক সহপাঠী কাতরাচ্ছে আর উচ্চ স্বরে মা... মা... বলে কাঁদছে। তার পা পুড়ে গেছে। তিনি তার সহপাঠীকে কিছু দূর ধরে এগিয়ে নিয়ে গেলেও ভিড়ের চাপে আবার হারিয়ে যায়। এমনভাবে তিনি অনেক পরিচিতজনকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেন। এমন লোকও দেখতে পান যাদের মাথা থেকে শরীর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল সে সময় সবাই যার যার মতো করে দৌড়াতে থাকে। কারো খবর নেয়ার মতো পরিস্থিতিও ছিল না। বেশি আঘাতপ্রাপ্ত ও পুড়ে যাওয়ারা দৌড়াতে পারেনি। রাস্তায়ই তাদের মৃত্যু হয়েছে।

নিজের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে ছেলে পিতাকে, পিতা সন্তানকে, সন্তান তার মাকে রক্ষা করতে পারেনি। অসহায়ের মতো মৃত্যুকে মেনে নিতে হয়েছিল। আকিহিরো জানান, যারা দৌড়ে নদী অতিক্রম করতে পেরেছিল তারাই বেঁচে যায়। বেঁচে গিয়েও অনেকে পঙ্গু। তিনি হাসপাতালে দীর্ঘ দিন চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠেন। তবে পুরোপুরি সুস্থ হননি। বিকিরণের ফলে তাঁর সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা লোপ পেয়েছে। তিনি জানান, পরে খবর নিয়ে জানতে পারেন তাঁর ক্লাসের ১৫০ জন সহপাঠীর মধ্যে মাত্র ১৩ জন বেঁচেছিল। তিনি তাঁর সহপাঠীসহ হিরোশিমাবাসীরা এ মৃত্যুর জন্য আমেরিকাকে দায়ী করে বলেন, ‘আমি আমেরিকাকে ঘৃণা করি, কোনো দিনই আমি তাদের ক্ষমা করতে পারব না।’ তিনি জানান হিরোশিমায় এখনো আণবিক বোমা বিকিরণের প্রভাব আছে। বোমা হামলার ৫-৬ বছর পরও যেসব শিশুর জন্ম হয়েছে, এদের অধিকাংশই ছিল বিকলাঙ্গ। এখনো এমন আছে। তিনি জানান, সোভিয়েত চেরনোবিলের চাইতে হিরোশিমার বিকিরণ ছিল ৫০০ গুণ বেশি। ধ্বংসপ্রাপ্ত হিরোশিমা নগরী আজ শান্তির নগরী। হিরোশিমার মানুষ আজও ভোলেনি সে বিভীষিকার কথা। তাই হিরোশিমাকে তারা গড়ে তুলেছে শান্তির শহর হিসেবে।

শান্তি জাদুঘর ঘুরে সন্ধ্যার পূর্বক্ষণে আমরা হিরোশিমা গ্রান্ড হোটেলে গিয়ে উঠি। অল্পক্ষণ হোটেলে অবস্থান করে আমরা সব খেতে বের হই। কোজিমাসান এবং ইয়ানোসান আমাদের নিয়ে যান হিরোমিমার ঐতিহ্যবাহী ‘ইকুয়ামিকার’ দোকানে। এক ধরনের খাবার। প্রতিটা দোকানে প্রচুর ভিড়। জাপানের বিভিন্ন এলাকা থেকে যারা হিরোশিমায় আসেন তারা এসব দোকানে খেতে খুবই পছন্দ করেন। আমাদের দেশের ফাস্ট ফুডের মতো ছোট ছোট দোকান। টানা লম্বা ছোট টেবিল। ছোট ছোট বেঞ্চিতে বসার স্থান। আর টেবিলগুলো এক ধরনের টিন দিয়ে তৈরি। টেবিলের নিচে চুল্লী। নুডুলস, ডিম অথবা মাংস দিয়ে খাবার তৈরি করে টেবিলেই পরিবেশন করা হয়। গরম গরম খাবারের জন্য এ ব্যবস্থা আমরা সবাই খেলাম। খেতে খারাপ লাগেনি। ভালই লেগেছে। তবে জাপানিরা এ খাবারের সাথে বিয়ার পান করে প্রচুর। খাবার শেষ করে আমরা হোটেলে ফিরে আসি রাত ৮টায়। টিভি খুলতেই খবর, নেপালে পাকিস্তানি বিমান বিধ্বস্ত। এ খবর শুনে মনটা খারাপ হয়ে যায়। আমি পাকিস্তানের হাশমীকে টেলিফোন করলাম। হাশমীর মন ভীষণ খারাপ। নেপালের রাইকে টেলিফোন করলাম তাঁর মনও খারাপ। রাই জানাল, নেপালের বিমানবন্দরে রাডার নেই। যে কারণে প্রায়ই বিমান অবতরণের সময় বিপদে পড়তে হয়। চলবে...

আগের পর্ব (১২) পড়ুন

বাংলাদেশ জার্নাল/আর

  • সর্বশেষ
  • পঠিত