ঢাকা, রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

ফ্রাঙ্কফুটে গিয়ে প্রেমে পড়লাম রোডেনবাখের

  প্রণব সাহা

প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২৩, ২০:২০  
আপডেট :
 ১৪ আগস্ট ২০২৩, ২১:৪৯

ফ্রাঙ্কফুটে গিয়ে প্রেমে পড়লাম রোডেনবাখের
ব্যাংক-বাণিজ্যের শহর ফ্রাঙ্কফুটে প্রণব সাহা । ছবি: নিজস্ব

মার্সিডিজ বেঞ্জের আদি জন্মভূমি জার্মানির স্টুটগার্ড। আর তার কাছেই ব্যাংক-বাণিজ্যের শহর ফ্রাঙ্কফুটে কেটেছে চার রাত। এর মধ্যে আবার দু’রাত ঘুমিয়েছি শহরতলীর ছোট্টগ্রাম রোডেনবাখে। দারুণ আতিথেয়তায় ৫৫ ঘন্টা আনন্দে ভেসেছে প্রিন্সেসের আপ্যায়নে।

ফ্রাঙ্কফুটের একরাতে সেখানে বোন ফাতেমা রুমার রান্না করা রুইমাছ আর ভুনা মুরগির মাংসের আয়োজন ছিল। অনেকদিন পর দেশী রান্নার স্বাদ পেয়েছিলাম। সকালে ডাইনিং টেবিলে মিললো গরম গরম পরোটা। না বিদেশে গিয়ে আমি কখনই বাংলার ভাত-মাছের জন্য অস্থির হইনা, তাই রাতের দীর্ঘ বুফে ডিনারে আমরা গেলাম জার্মানির এশিয়ান রেস্তোরায়।

বলা যায় ভূরিভোজ। স্কুইড, ঝিনুক, সামুদ্রিক মাছ আর প্রিয় মাশরুম খেলাম দেড়ঘন্টা ধরে। রেস্তোরায় প্রবেশ পথে লাফিং বুদ্ধ স্বাগত জানালো, ভাবলাম থাইল্যান্ড থেকে ফ্রাঙ্কফুটের হানাউ শহরে কি করেন তিনি? খেতে বসে জানলাম বিশাল এই রেস্তোরার নাম ‘এশিয়ান প্যালেস্ট’। যেখানে মিলবে থাই, চাইনিজ আর ইন্দোনেশিয়ার খাবার। আমি সালাদ দিয়ে শুরু করলাম,পেলাম সাগুর পাপড়। আর দুই দফা সালাদ ও সুশি খাবার পর চোখে পড়লো সুপের হাড়ি। সেদিন ফ্রাঙ্কফুটে একটু ঠান্ডা পরেছিল, জার্মানিরা সামার বললেও আমাদের পৌষের শুরুর অল্প ঠান্ডা বাতাসের মত। তাপমাত্র ২০ থেকে ২২ ডিগ্রি। শীত শীত লাগছিল, তাই দ্রুত এক বাটি টমইয়াম গলায় ঢেলে আরাম পেলাম।

জার্মানির বাণিজ্যিক শহর ফ্রাঙ্কফুট রাইম আম । চার রাতের দু’রাত মূল শহরে কাটালেও, শহর থেকে নিরিবিল শহরতলীটাই কেন যেন বেশি ভালো লাগলো। হতে পারে তা প্রিন্সেসের জন্যই। একটা ছিমছাম চারতলা বাড়ি। নামটা পরিচিত, মালিক দেলোয়ার বিপ্লব দিল দরিয়া বাঙালি। রাতেই দারুন আয়োজন ছিল পানাহারে।

হোটেল প্রিন্সেসের অবস্থান হানাউ শহরের পাশের ছোট্ট গ্রাম রোডেনবাখে। পরিচ্ছন্ন এবং গোছানো জার্মানির ঐতিহ্য। ফ্রাঙ্কফুট বিমান বন্দর থেকে ২০ মিনিটের পথ। আর ফ্রাঙ্কফুট শহর থেকে গাড়িতে যেতে লাগবে ২৫ মিনিট। ট্রেনেও ফ্রাঙ্কফুট শহর থেকে সরাসরি এবং খুব সহজেই আসা যায়। ট্রেন স্টেশনের নাম রোডেনবাখ, আবার পাশের শহর হানাউ-তে নেমেও আসা যায় ট্যাক্সি নিয়ে।

হানাউ শহরের পাশের ছোট্ট গ্রাম রোডেনবাখের হোটেল প্রিন্সেস । ছবি: নিজস্ব

যদি কেউ ফ্রাঙ্কফুটের মত মহানগরের কোলাহল ছেড়ে জার্মানির একটি শহরতলীর গ্রাম উপভোগ করতে চান তাহলে যেতেই পারে রোডেনবাখে। আমিতো নিশ্চিত করেই বলতে পারি আবার যদি কখনো যাওয়া হয় ফ্রাঙ্কফুটে, অবশ্যই দুটি রাত থাকবোই থাকবো রোডেনবাখে। কারণ আশা করি প্রিন্সেস তখন আরও সুন্দরী হবে। কারণ ভরসা রাখি বিপ্লব দেলোয়ারের ওপর। চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে তিনি প্রিন্সেসের দায়িত্ব নিয়েছেন। ছাদের ওপরের ছোট্ট ফ্লাটটা গুছিয়ে তুলবেন,পরেরবারের ভ্রমনে ওখানেই থাকবো। গরম কাপুচিনোতে চুমুক দিয়ে দেখবো রোডেনবাখের সৌর্ন্দয। আর এরই মধ্যে তৈরী হয়ে যাবে বেসমেন্টের কনফারেন্স রুম। সকালের নাস্তা সার্ভ করা হবে নিচের গোছানো রেস্তোরায়, নাম তার ক্যাফে বিস্ত্রো সাংহাই গার্ডেন,বর্তমানে চালু নয়। আর চালুর আগে নাকি বিল্পব জাহিদ এই রেস্তোরার নাম পরিবর্তন করবেন। আহা বন্ধুজন আপনি এটার নাম কি আপনার মাতৃভাষায় নামকরন করবেন?

গেলাম ফ্রাঙ্কফুট কিন্তু প্রেমে পড়লাম রোডেনবাখের। তার কারণ ভারী শিল্পের দেশ র্জামানীতে প্রথমবার গিয়ে মিস করেছি বার্লিন, বন, মিউনিখ বা কোলন শহর। তবে রেল ভ্রমনে চোখে পরা মেইনজের রেলস্টেশন রোমিচেস থিয়েটার আর কোলন স্টেশন নজর কেড়েছে। একটা পুরো দিন হেটে, গাড়িতে ঘুরে ফিরে দেখেছি আর ভ্রমনের যে এক প্রধান অনুষঙ্গ কেনাকাটা, খুব অল্প হলেও তা করেছি রোডেনবাখের পাশের শহর হানাউতে। একটি দ্বিধায়ও পরেছিলাম। সুপার মার্কেট বলে যেখানে গাড়ি থেকে নামলাম, তা অনেকটাই লম্বা গোডউনের মত। এবং তা একতলা। নাম রিউ সেন্টার। দুই পাল্লার বড় দরজা দিয়ে ঢুকে দেখি এক এলাহি ব্যাপার।

প্রথম কয়েকটি খাবারের দোকান। পরিকল্পনা ছিল দুপুরের মধ্যহ্ন ভোজ হাল্কা হবে, কারণ রাতে বুফে ডিনার। আর অবশ্যই দুপুরে স্বাদ নেবো জার্মান খাবারের। যথারীতি এক কাপ গরম কফি। সাথে নানাধরনের বীজ, যেমন কুমরোর বিচি, সূর্যমুখীর বিচিসহ আরও কিছু বাদাম দিয়ে তৈরী ব্রাউন ব্রেড। উপরটা খুব শক্ত কিন্তু ভেতরটা নরম তুলতুলে। যারা এসব বাদাম-বিচি পছন্দ করেন তাদের জন্য খুব স্বাদের হবে। সাথে রুমার পছন্দে নিলাম নানা রকম ফল দেয়া একরকম পাই। সেটা একটু মিষ্টি , খাবো কি না ভাবছিলাম। ফতেমা রুমা বললো ‘অল্পই তো মিষ্টি আর আমরা এখন খাবো কম হাটবো বেশি।’

হ্যা হাটলাম বটে, আর হাটতে হাটতেই হানাউ থেকে পৌঁছে গেলাম রোডেনবাখের ডেরা প্রিন্সেসে। আহা প্রিন্সেস কি অভিমান করবে ‘ডেরা’ বলায়। আসলে আদর করেই ডেরা বললাম কারন খুব পছন্দ হয়েছে প্রিন্সেসকে।

প্রথম দফায় প্যারিস থেকে আইসিই নামের দ্রুতগতির ট্রেনে বিকেলে ফ্রাঙ্কফুট শহরে পৌঁছে প্রথমেই গিয়েছিলাম মাইন নদীর তীরে। সেদিন অবশ্য লকড ব্রিজ (তালা ঝোলানোর সেতু) দেখা হয়নি। মিশরীয় রেস্তোরায় নৈশভোজ শেষে রাতে ছিলাম ‘রুমার্স’ নামের পাঁচতারকা হোটেলে। নিকষ কালো ডিজাইনার্স হোটেলের দুর্ণাম করার কোনো কারন নেই, কিন্তু দুরাতের প্রেমটা হয়েছে থ্রিস্টার প্রিন্সেসের সাথেই। তবে অনেকদিন মনে থাকবে রোমারের দু’দুটো প্রাতরাশের কথা। আর শুধু খাবারই নয়, যারা রেস্তোরা চালায় তারা যখন এসে স্বজনের মত শ্রদ্ধা নিয়ে খোজ-খবর করে, তা এক বাড়তি পাওনা যোগ হয় জীবনের চলার পথের অভিজ্ঞতায়।

কারণ লঙ্কানরা যখন এসে সকালেই সুপারিশ করে টাইগ্লাসের আদার রসে চুমুক দিতে আর খাবার শেষে ওয়াইন নিতে, তখন তা স্মরণীয় হয়ে যায়। নেশা ধরার দ্রাক্ষারস এড়িয়ে যেতেই সে নিয়ে এলো সকালের নাস্তার উপযোগী করে সেদ্ধ চিংড়ি আর দামী ফল এভোকাডোর সালাদ, আহা তাকে কি আর শুধু নাস্তা বলে ছোট করা যায়? এরপর আবার এলো ডাবল ডিমের পোচ। কারল আমি ঐ রেস্তোরায় যারা কাজ করেন তাদের সহকর্মী ফাতেমা রামার ‘ব্রুদার’। জার্মানি ভাষায় বড়ভাইকে ব্রুদার বলে, আর জামার্নরা তাকে সম্মান করে তেমন করেই যার অবস্থান পরিবারের পিতার পরেই। ফাতেমা ওর সহকর্মীদের কাছে তেমন করেই উপস্থাপন করেছে আমাকে। খাবার টেবিলে স্বাগত জানিয়েছিল ২৬ বছরের সুন্দরী সেলভি। একটা সেলফি তোলার আগেই সে দৌঁড় দিয়েছিল কাফে, মানে কাপুচিনোর কাপ আনতে। কিন্তু যখন জানলাম তার গলায় বাসা বেধেছে কর্কট, মন খারাপ হয়ে গেলো।

শুধু জার্মান নয় আরও কত কিছু দেখার ছিল ফ্রাঙ্কফুটেই! মাত্র চারদিনে তা সম্ভব নয়। জানা হলো না হিটলারকে নিয়ে জার্মানরা এখন কি ভাবে? তবে দু’বছর মাত্র কয়েকবছর আগেও যে বিশ্বযুদ্ধের বোমা মিলেছে সেই শহরেই তা জেনেছি ইন্টারনেটে। সেসবের খোজে নিশ্চয় আবার যাবো ফ্রাঙ্কফুটে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলা, ইন্টারন্যাশনাল মোটর শো বা সঙ্গীতের বিভিন্ন সরঞ্জামের আয়োজন মিউসিক মেসি । শুধু এসব মেলা যেখানে হয় সেই বিশাল অঙ্গণ মেসি ফ্রাঙ্কফুট দেখে এসেছি বাইরে থেকে।

লেখক: সম্পাদক, ডিবিসি নিউজ

বাংলাদেশ জার্নাল/আরআই

  • সর্বশেষ
  • পঠিত