ঢাকা, রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

মেঘের রাজধানীতে রোমাঞ্চকর চারদিন

  মো. মারুফুর রহমান খান

প্রকাশ : ১৯ জুন ২০২৩, ১৩:৪৪

মেঘের রাজধানীতে রোমাঞ্চকর চারদিন
ছবি: সংগৃহীত

কম্পিউটারকে যেমন F5 দিয়ে রিফ্রেশ করতে হয়, ঠিক তেমনি আমার ক্ষেত্রে এই নাগরিক জীবনের চাপ সামলাতে বেড়ানো F5 এর কাজ করে!

এই তো গেল অগাস্টে আমার দলের নজরুল, মাহিন, সোহেল আর আসিফের সাথে বেড়িয়ে পড়লাম মেঘ আর ঝর্ণার রাজধানী মেঘালয়ের উদ্দেশ্যে। গত বছরের ৪ আগস্ট রাতের বাসে সিলেট যাই। তামাবিল সীমান্তে আমরা যাই পরদিন সকালে। তামাবিল সীমান্ত পেরিয়ে ভারত প্রান্তের ডাউকি বন্দর দিয়ে শুরু হয় আমাদের যাত্রা।

ডাউকি থেকে ভিসার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে করতে প্রায় দুপুর দুইটা। ওইখান থেকে ডাউকি বাজারে দুরত্ব প্রায় ১ কিমি। সারি সারি রেন্ট এ কার দাঁড়ানো। কিন্তু এক আজব ব্যাপার, বাজার পর্যন্ত চাচ্ছিল হাজার টাকা। আমরা গুগল ম্যাপে দূরত্ব দেখলাম প্রায় ৮০০ মিটার। পরে হাঁটা দেই, পাহাড়ি পথ। ক্লান্তও ছিলাম বেশ। যেতে যেতে একজন মেকানিককে দেখলাম ওয়ার্কশপে, তাকে ডাউকি বাজারের দুরত্ব জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিল, ১০ কিমি।

তার কথায় আমরা সোহেলকে ফাপড় দেয়া শুরু করলাম, তার গুগল ম্যাপ ভুয়া! পরে একটি রেন্ট-এ-কার আমাদের কাছে এসে বলে, চলেন দাদা, দু’শ দিয়েন। যেহেতু ক্লান্ত ছিলাম, উঠে গেলাম। তিন মিনিটে ডাউকি বাজারে আমরা। কি আজব!

আমাদের দলের সদস্যরা ব্যস্ত হয়ে উঠলো ডলার ভাঙাতে। আর আমরা খুঁজে খুঁজে একটি বাঙালি হোটেল বের করলাম। ওরা এটাকে বলে ‘থালা’ প্যাকেজ। একটি থালায় ভাত, আর সব তরকারি ছোট ছোট বাটিতে করে সাজিয়ে দেয়। আর সাথে ‘পাপড়’ ভাজা। এই থালা খেতে অতিশয় মজার।

যাইহোক, আমরা যেহেতু ৫ জন তাই সেডান কার না নিয়ে একটি টাটা সুমো নিয়ে শুরু করলাম মেঘের রাজধানী যাত্রা। যেতে যেতে পিছনে তাকিয়ে দেখলাম অনেক নিচে আমাদের জাফলং। কি যে সুন্দর!

আমাদের চালককে বলা ছিলো, গুরুত্বপুর্ণ স্পটগুলো যেন আমাদের মিস না হয়। উনি প্রথমেই প্রায় ১০ মিনিট রাইড শেষে নিয়ে গেলেন উমক্রেম ফলস। আরে, এত ঝর্ণার নহর। আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমাদের চালক মামা তাড়া দিয়ে বললেন, দাদা, এই রকম হাজার হাজার সামনে পাবেন, তাড়াতাড়ি উঠেন, নইলে চেরাপুঞ্জি যেতে রাত হবে, পাহাড়ি পথ।

এটা শুনে আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম। পথে পড়ল বরহিলস ফলস। এইখানেও খানিকটা সময় কাটিয়ে আমরা চলে গেলাম এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাউ লি লং ভিলেজে। অদ্ভুত সুন্দর গ্রাম। কোন কোলাহল নেই, আর একটুও ময়লা কোথাও নেই। গাছে গাছে বেতের ঝুরি দেয়া আছে বিন হিসেবে।

মাউ লি লং এর মুগ্ধতা নিয়ে আমরা চলে গেলাম লিভিং রুট ব্রিজ দেখতে। খানিকটা খাড়া পথ। নামা-উঠা বেশ কষ্টসাধ্য। এ এক অসাধারণ ব্রিজ। জীবন্ত গাছের শিকড় দিয়ে প্রাকৃতিক ব্রিজ হয়ে গেছে। আমরা ব্রিজ পাড় হয়ে অপর পাশে ব্রিজের নিচের ঠান্ডা পানির পরশ নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম । এবার সোজা গন্তব্য চেরাপুঞ্জি।

চেরাপুঞ্জির ট্রেইল অসাধারাণ। কোথাও খাড়া পাহাড়ি পথ, আবার কোথাও যেন সেই লেভেলের অন্ধ বাক। অধিকাংশ সময় মনে হচ্ছিল- গভীর রাত, কারণ মেঘ এসে আমাদের ঢেকে দিচ্ছিল। আর চালক মামার যেন এই রাস্তা হাতের মুঠোয়। এই ট্রেইলের বর্ণনা আমার মত ক্ষুদ্র লোকের লেখনীতে বুঝানো সম্ভব নয়।

আমরা চেরাপুঞ্জিতে যখন ঢুকি, তখন রাত প্রায় আটটা। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। আমরা গিয়ে একটি হোম-স্টেতে কথা বলে বুকিং নেই। আমাদের টাটা সুমো ভাড়া করা ছিলো শুধু মাত্র চেরাপুঞ্জি যাওয়ার। চালকের ব্যবহার ও দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম উনাকে নিয়েই আমাদের চার দিনের সফর শেষ করব। এটা যে কত বড় সিদ্ধান্ত ছিল, তা পরের দিনই টের পেয়েছি। পরের দিন ঝুম বৃষ্টি। যদিও গাড়ি পেতাম, সেডান কার পেতাম, টাটা সুমো একটাও দেখি নাই। যাই হোক, রাতে আমরা খাবার শেষে রুমে গিয়েই ঘুমিয়ে পড়ি। এক ঘুমে ফজর। দ্বিতীয় দফা ঘুম শেষে আমরা রুমের ভাড়া পরিশোধ করে চাপি আমাদের সুমোতে। চেরাপুঞ্জি দেখতে দেখতে শিলং যাত্রা।

আমরা প্রথমেই গেলাম সেভেন সিস্টারস ফলসে। এ এক অসাধারণ দৃশ্য। এতগুলো ঝর্ণাধারা একসাথে আছড়ে পড়ছে, আর মেঘ ক্ষণেক্ষণে এসে ঢেকে দিচ্ছিলো, যা বর্ণনাতীত। নামে সাত বোন, আসলে গুনে দেখি কমপক্ষে বারো বোন!

এখান থেকে বেরিয়ে আমরা চলে গেলাম মৌসুমি কেভ দেখতে। সেখানে গিয়ে আমরা নাস্তা করে ঢুকে পড়লাম। ভেবেছিলাম আলু টিলা গুহার কাছাকাছিই হবে। ঢুকার পর সে কি রোমাঞ্চকর। নিচে পানি, পিছলা পাথর। কোথাও কুঁজো হয়ে পার হয়েছি। আবার কোথাও সেই রকম চিকন প্রবেশ পথ। যা চরম রোমাঞ্চকর। যাই হোক, এই কেভ থেকে আমরা চলে যাই নোহাকালিয়া ফলস। এটা আরেক রোমাঞ্চকর। টাটা সুমো না থাকলে পাহাড়ের চূড়ায় যাওয়া সম্ভবপর ছিলো না।

আমরা চলে যাই ওয়াকাবা ফলসে। দেখলাম এখানে প্রায় দুই শতাধিক সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে-উঠতে হবে। ভয়েই আর নামি নাই আমরা। এবার আমাদের গন্তব্য শিলং। তখন বাজে আনুমানিক বেলা তিনটা। আমরা দুপুরের খাবারের জন্য বিরতি নেই মাওডক ভিউ পয়েন্টে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। খাওয়া শেষে আমি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বৃষ্টির ভিতরে সুমো মামার সামনে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির অনুভব নিতে নিতে চায়ের স্বাদ নিচ্ছিলাম। এ যেন আরেক অসাধারণ অনুভুতি।

এরপর আমাদের শিলংয়ে ঢোকার কথা। কিন্তু ততক্ষণে চালক আর চালক নেই। সে আমাদের বন্ধু হয়ে গেছে। আমি বসেছিলাম সামনের সিটে। তার সাথে বাংলা, হিন্দি মিলিয়ে সে কি কথা! তো মামা আমাদের বলল, এখন বিকেলের শেষ দিক, সামনেই পড়বে এলিফ্যান্ট ফলস, এখন এটা দেখে গেলে কালকে শিলং এ টাইম বেশি দিতে পারবেন। তো আমার কথা মত চলে গেলাম সেই বিখ্যাত এলিফ্যান্ট ফলস দেখতে। আসলেই দারুণ। অনেকটা খাড়া পথ বেয়ে একদম নিচে চলে গেলাম আমরা আর সে কি পানির আছড়ে পড়ার শব্দ।

এলিফ্যান্ট ফলস থেকে বেরিয়ে সোজা শিলং শহরে। গিয়ে আমরা একটা হোটেলে খুঁজে উঠে পড়লাম। তখন প্রায় সন্ধ্যা। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম খাবার আর শপিংয়ে। এখানে আমাদের দুইজন মাস্টার পাওয়া গেল, নজরুল আর আসিফ। তারা প্রায় দুই ঘন্টা একটি মলে কাটিয়ে কিনেছিল একটি লেডিস চিরুনি আর বাচ্চাদের ফুটবল!

শিলংয়ে স্ট্রিট ফুড অত্যন্ত উপাদেয়। পরিচ্ছন্ন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভ্যান গাড়ির সামনে গরম ভাজা পরোটা আর ডিমের সে কি স্বাদ! আর চায়ের কথা কি আর বলবো। মনটাই তো ভরে গেল।

তৃতীয় দিন সকালে আবার আমাদের মাইকেল মামার সুমো পংখীরাজে চড়ে আমরা চলে গেলাম লাইটলুম ক্যানিয়নে। এটা একটি বিশেষ ক্যানিয়ন। পাহাড়ের চুড়ার দাঁড়ালে দেখা যায়, নিচের বিশাল বিশাল খাদ। কি ভয়ংকর সুন্দর। এখানে আমরা অনেকটা সময় কাটাই। পরে চলে যাই উমিয়ুম লেকে। আরেক যাদুর লেক। পাহাড়ের মাঝে লেক যেন তার নীল পানির পসরা সাজিয়ে বসে আছে।

এখান থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম ওয়ার্ডস লেকে। এটি আমাদের বোটানিক্যাল গার্ডেন টাইপ, তাই আমরা আর ঢুকি নাই। লাঞ্চ শেষে সোজা রুমে। সন্ধ্যায় শিলং শহরে ঘুরাঘুরিতেই কাটিয়ে দিলাম।

চতুর্থ দিন সকাল ৬টার দিকে রুম ছেড়ে দিয়ে মাইকেল মামার বাহনে আমরা আবার যাত্রা শুরু করি ডাউকির পথে। তবে এবার ভিন্ন রাস্তায়। এবার প্রথমেই আমরা গেলাম ক্রানসুরি ফলসে। এ এক অদ্ভুত জায়গা। গাড়ি ছেড়ে প্রায় দেড় কিমি হেঁটে নেমেছি আমরা। পাহাড়ের সেকি শব্দ। চারদিকে শুধু নৈশব্দের কলধ্বনি। এ যেন এক বিচিত্র যাত্রা।

এখানেই সবচেয়ে মজা হয়েছে আমাদের। লাইফ জ্যকেট নিয়ে সোহেল, আসিফ আর আমি নেমে পড়লাম ক্রানসুরি ফলসের তলদেশে। চলে গেলাম একদম ফলসের তলদেশে। গায়ের ওপর পানির আছড়ে পড়ার শব্দ অসাধারণ। এ যেন স্বর্গীয় এক অনুভুতি।

ক্রানসুরির মোহ কাটতে না কাটতেই আমরা রওয়ানা দিলাম সনংপাডং এর উদ্দেশ্যে। এটি হলো জাফলং এর উল্টো দিকে। আমরা একদম নিচে নেমে গেলাম। কি যে স্বচ্ছ পানি! একদম পানির নিচের পাথর ও মাছ পরিস্কার দেখা যায় এখানে। ঠান্ডা পানিতে পা ভিজিয়ে আমরা আবার রওয়ানা দিলাম ডাউকির পথে। আনুষ্ঠানিকতা সেরে আমরা আবার চলে এলাম আমার প্রিয় বাংলাদেশে। পিছনে পড়ে রইল চারদিনের স্বপ্নের মেঘালয় সফর।

বাংলাদেশ জার্নাল/কেএইচ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত