ঢাকা, রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

একটি ছোট্ট নতুন গল্প

  আবু এন এম ওয়াহিদ

প্রকাশ : ০৭ আগস্ট ২০১৯, ১২:৪৯  
আপডেট :
 ০৭ আগস্ট ২০১৯, ১২:৫৫

একটি ছোট্ট নতুন গল্প

ব্রুনাই বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি সম্মেলন শেষ করিয়া এক সপ্তাহ পর বাড়ি ফিরিয়া আসিতেছি। পথিমধ্যে স্থানীয় সময় রাত এগারোটায় সিঙ্গাপুরের ‘চ্যাঙ্গি’ বিমানবন্দরে ইস্তাম্বুলের উদ্দেশ্যে টার্কিশ এয়ার লাইন্সের বি-৭৭৭-এর পেটের ভিতর ‘ইকোনমি ক্লাসে’ বসিয়া আছি।

যাত্রীরা একে একে উঠিয়া আপন আপন আসন গ্রহণ করিতেছেন। কেহ বাক্সপেটরা চাকার ওপর ভর করিয়া টানিয়া টানিয়া আনিতেছেন। কাহারও বুকেপিঠে মালসামান বানরের মতন লটকিয়া রহিয়াছে। কাহারও কাঁখে দুধের শিশু হাসিয়া হাসিয়া সম্মুখ হইতে পিছনের দিকে অগ্রসর হইতেছে, হঠাৎ যেন লাল পিঁপড়ার কামড় খাইয়া চিৎকার করিয়া উঠিল! কী হইতে কী হইল, কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। নিষ্পাপ শিশুটির কান্না থামিতে না থামিতে আমার চোখের সামনে আরেক অঘটন ঘটিয়া গেল।

এক ভদ্রলোকের হাত ফসকাইয়া উপরের ‘বিন’ হইতে একটি কাপড়ের গাট্টি গলিয়া পড়িল। পড়িল তো পড়িল অশীতিপর বৃদ্ধার ঘাড়ে গিয়া পড়িল। তিনি ব্যথায় আহ উহ করিতে লাগিলেন! জীবনের গতি এতই প্রবল, কাহারও পিছন পানে ফিরিয়া তাকাইবার সময় নাই। অথচ কে আগে উঠিয়া কাহার আসনে বসিয়া পড়িল, তাহা লইয়া বচসা করিবার ফুরসৎ ঠিকই মিলিল। এই ভাবে ৩০/৪০ মিনিটের মধ্যে ক্যাবিনের ভিতর যাত্রীদের কর্মচঞ্চল অস্থিরতা সব থিতু হইয়া গেল। সবাই সোজা হইয়া বসিলেন, কোমরে বেল্ট বাঁধিলেন, কান খাড়া করিয়া রহিলেন। বিমান যে কোনও মুহূর্তে আকাশে ডানা মেলিবার আগে মাটিতে তুমুল বেগে দৌড় মারিবে। এমন সময় চিফ অফ ক্যাবিন ক্রু আমার পাশে আসিয়া দাঁড়াইলেন এবং নাম ধরিয়া বলিলেন, ‘মি. আকাশ, হাও আর ইউ? ইফ ইউ নিড এনিথিং, প্লিজ লেট মি নো’। অনেক ক্ষণ ধরিয়া ভাবিলাম, ভদ্রমহিলার এমন আচমকা আচরণের হেতু কী, কিছুই বোধগম্য হইল না। পরে এক বার তাহার সামনাসামনি হইলে সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করিলাম, মে আই নো দ্যা রিজন ফর ইউর স্পেশাল অ্যাটেনশন টুওয়ার্ড মি? তিনি উত্তরে যাহা বলিলেন তাহার অর্থ এই রকম দাঁড়ায় - ইউ আর ‘ওল্ড’, নো, নো - ইউ আর ‘গোল্ড’, ইউ আর ‘এলিট’। এইবার আমার কাছে সব রহস্য খোলাসা হইয়া গেল। টার্কিশ এয়ার লাইন্স, ‘স্টার এলায়েন্স’-এর সদস্য। আর আমি ‘স্টার এলায়েন্স গোল্ড কা¬ব’-এর সদস্য। সময় যতই বহিয়া যাইতে লাগিল, ততই বোধ করিলাম, কোনও এক অলৌকিক ইশারায় আসমানে নতুন আরেক রহস্য দানা বাঁধিতে শুরু কারিয়াছে! এগারো ঘন্টা ধরিয়া বিমান মেঘের উপরে ভাসিয়া বেড়াইল, খাওয়াদাওয়া হইল, দেদারসে জলপানির এস্তেমাল চলিল, মহিলার এক দণ্ড সময় হইল না - আমার খবর নেওয়ার। ইতিমধ্যে উড়োজাহাজ ইস্তাম্বুলের উপর ঘন সাদা মেঘের পাহাড় ভেদ করিয়া নিচে নামিতেছে। এমন সময় তিনি কোথা হইতে আবার আমার সামনে আসিয়া উদয় হইলেন। এই বার লজ্জাশরমের মাথা খাইয়া বলিয়া বসিলেন, ‘ইট হ্যাজ নাথিং টু ডু উইথ টার্কিশ এয়ার লাইন্স, আই অ্যাম গিভিং ইউ দিস লিটল গিফট ইন মাই ভেরি পার্সোন্যাল ক্যাপাসিটি’।

এই বলিয়া আমার দিকে একটি লাল তাজা গোলাপ আগাইয়া দিলেন। আমি কোনও কিছু বুঝিয়া উঠিবার আগেই সুনিপুনভাবে তিনি ফুলটি আমার হাতে ধরাইয়া দিলেন। আমি নাড়িয়া চাড়িয়া দেখি গোলাপের গোড়ায় স্কচটেপে সাঁটা একটি চিরকূট যেখানে লাল কালিতে লেখা মহিলার নাম-ঠিকানা আলো-আঁধারির মাঝে ঝলমল করিয়া জ্বলিয়া উঠিতেছে! আর আমার হৃৎস্পন্দন বাড়িতে বাড়িতে থামিয়া যাইবার উপক্রম হইতেছে! হাত পা কাঁপিতেছে! কোন অশুভ ক্ষণে কী ঘটিতেছে, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না! ভাবিয়া লাভ কী, কপালে যাহা আছে আজ তাহাই হইবে! বোকার মতন কী মনে করিয়া তখনকার মতো গোলাপটি পকেটে পুরিয়া লইলাম। বিমান বিকট আওয়াজ তুলিয়া জমিনে পা রাখিল। মুহূর্তের মধ্যে আমার ব্যক্তিগত সঙ্কট এতই তীব্র হইয়া উঠিল যে, সকলের জন্য অবতরণকালীন মহাসঙ্কটের কথা বেমালুম ভুলিয়া গেলাম! আমার বাকি পথের দীর্ঘ সময়ক্ষেপন কেমন গেল তাহা যাঁহারা বুঝিবেন তাঁহারা তো বুঝিবেনই, আর যাঁহারা বুঝিবেন না তাঁহাদের মনের বোঝা আর বাড়াইতে চাই না। বাড়িতে আসিয়া বিচিত্র পথের সচিত্র বয়ান গিন্নিকে সব খুলিয়া বলিলাম। জ্যান্ত গোলাপের জান কোরবান করিবার জন্য তাঁহার করকমলে সঁপিয়া দিলাম। আমার কথা শুনিয়া তিনি নির্বাক নিশ্চুপ হইয়া রহিলেন, যত্ম করিয়া ফুলটি উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিলেন, অজানা অচেনা প্রেম বিনোদিনীর ঠিকানাটি মনে মনে মুখস্থ করিতে লাগিলেন। এর মাঝে দেখিলাম দুই-এক ফোঁটা অশ্রু ডান দিকে কপোল গড়াইয়া পড়িল। গল্পটি এই খানেই শেষ হইতে পারিত, কিন্তু হইল না। কান্নার সঙ্গে ক্ষণে ক্ষণে মুচকি হাসির আভা সবকিছুকে রহস্যাভৃতই করিয়া রাখিল!

(ফেসবুক থেকে- লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি; এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ)

  • সর্বশেষ
  • পঠিত