ঢাকা, রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ মিনিট আগে
শিরোনাম

সেই ভয়াল দৃশ্য আজও মনে পড়ে: বশির আহমেদ

  জামালপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৬:১৩

সেই ভয়াল দৃশ্য আজও মনে পড়ে: বশির আহমেদ

নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও এক হাতে সাদা পতাকা অপর হাতে সারেন্ডার লেটার নিয়ে পাকবাহিনীর কামালপুর গ্যারিসনে গিয়ে বিজয়ের বার্তা বয়ে এনেছিলেন অসীম সাহসী কিশোর মুক্তিযুদ্ধা বশির আহমেদ। ১৬ বছর বয়সী বশির দশম শ্রেণীতে পড়াকালীন ১১নং সেক্টরে হেলাল কোম্পানীর অধীনে যুদ্ধ করেন। অংশ নিয়েছেন একাধিক সম্মুখযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসের সাথে পালন করেছেন বীরত্বপূর্ণ ভুমিকা। বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর প্রতীক পদকে ভূষিত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথা কাহিনী তুলে ধরে বাংলাদেশ জার্নালের মুখোমুখি হয়েছিলেন অসীম সাহসী মুক্তিযুদ্ধা বশির আহমেদ বীর প্রতীক। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আমাদের জামালপুর প্রতিনিধি শওকত জামান।

বাংলাদেশ জার্নাল : যুদ্ধে যাওয়ার প্রেরনা পেয়েছিলেন কিভাবে?

বশির আহমেদ : পাক সেনারা আমাদের দেশের মানুষকে হত্যা, নারীদের নির্যাতন, বাড়ীঘরে আগুন জাবাঙ্গালী নিধনের ধংসজজ্ঞ চালায়। প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে হানাদারের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।

বাংলাদেশ জার্নাল : কখন কিভাবে মহেন্দ্রগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে গেলেন এবং যুদ্ধে অংশ নিলেন?

বশির আহমেদ : আমার বাড়ী জামালপুর জেলার বকসীগঞ্জ উপজেলার ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা গ্রাম লাউচাপড়ায়। ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের কাছে। যুদ্ধে যাবো, ছোট হওয়ায় বাড়ী থেকে অনুমতি দিচ্ছেনা। আমি এবং ভাগিনা বাড়ী থেকে পালাই। রওনা দেয় ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের উদ্দেশে। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের বিলডোবা বিএসএফ ক্যাম্প হয়ে মহেন্দ্রগঞ্জে এক আত্মীয়ের বাড়ীতে আশ্রয় নেই। তারা শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়ে রেশন কার্ড করার পরামর্শ দেয়। এপ্রিলের মাঝামাঝিতে শরনার্থী ক্যাম্পে না গিয়ে মুক্তিযুদ্ধা ক্যাম্পে পৌঁছে দেখা হয় আমার স্কুল শিক্ষক সোলামান হক স্যারের সাথে। মুক্তিযোদ্ধা তালিকা তৈরির দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তার কাছে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করলে বলে, তোমরা ছোট মানুষ, অস্ত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে পারবানা বলে আমাদের বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

তারপর ?

বশির আহমেদ : ১৫ দিন আত্মীয়র বাড়ীতে থাকার পর মে মাসের প্রথম সাপ্তাহে খবর পেলাম মুক্তিযুদ্ধে লোক নিচ্ছে। ফের লাইনে দাঁড়াই। সোলায়মান স্যার আমাদের দেখে বলে, তোমরা আবার এসেছো ? উত্তরে আমরা বলি স্যার মরি আর বাঁচি আমাদের যুদ্ধে যাওয়ার সুযোগ দেন। আমাদের প্রবল আগ্রহ দেখে বলে তালিকায় নাম তুলে বলেন, বিকেলে কাঁথা বালিশ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে চলে এসো। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ আমার।

বাংলাদেশ জার্নাল : কোথায় ট্রেনিং নিয়েছিলেন।

বশির আহমেদ : মহেন্দ্রগঞ্জেই ট্রেনিং নিয়েছি। হাবিলদার ধন বাহাদুর সিং প্রথমে বাঁশের লাঠি পরে অস্ত্রের ট্রেনিং দেয়। তারপর ভারতীয় সেনাবাহিনী ক্যাম্পে আসার পর তাদের কাছে অস্ত্রের ট্রেনিং নেই।

বাংলাদেশ জার্নাল : আপনি কোন কোম্পানীর অধীনে এবং কোন পজিশনে যুদ্ধ করেছেন।

বশির আহমেদ : আমি হেলাল কোম্পানির অধীনে যুদ্ধ করেছি। পরবর্তীকালে স্থানীয় হওয়ায় মিত্র বাহিনীর একটি কোম্পানীতে নিযুক্ত হই। সেখানে রেকি করা, দোভাষির দ্বায়িত্ব পালন ও সম্মুখ যুদ্ধেও অংশ নিয়েছি।

বাংলাদেশ জার্নাল : আপনি কোন কোন অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন?

বশির আহমেদ : বেশীরভাগ অপারেশন কমালপুরেরই চালিয়েছি। দেওয়ানগঞ্জসহ বিভিন্ন অপারেশনে গিয়েছি এবং আমাদের সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল তাহের যে যুদ্ধে মর্টার শেলের আঘাতে পা হারিয়েছে সেই যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলাম। ১৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের নির্দেশ দিলেন তোমাদের কামালপুর আক্রমনে যেতে হবে। আমরা কামালপুর পাকবাহিনী ক্যাম্পের উত্তর পাশে এখন যেটি ভারতীয় চেকপোস্ট সেই স্থানে অবস্থান নেই। সরাসরি আক্রমন করতে প্রস্তুত করে রাখা হয়। আমাদের সহযোগিতা করতে আরো ২টি প্লাটুন দুই সাইটে প্রস্তুত রাখা হয়। রাত ২টার সময় সেক্টর কমান্ডারের তাহের অপারেশনের খবর জেনে গেছে বলে বাতিল করে আমাদের নিয়ে ভারতীয় গ্রাম ব্রহ্মনপাড়া থেকে পুর্বদিকে টুংরো চর গ্রাম হয়ে বাংলাদেশে নয়াপাড়া গ্রাম দিয়ে মৃর্ধাপাড়া মোড়ে চলে আসেন। আসতে সকাল হয়ে যায়। মৃর্ধাপাড়া মোড়ের পশ্চিম পাশের কাঠের ব্রীজ ছিল। ব্রীজের পশ্চিম পাশে আখক্ষেতের দক্ষিনে বেশকিছু পাকসেনাদের দেখা গেল। তাহের স্যারকে আমরা বললাম, এদের উপর আক্রমন করা হোক, ফায়ার করা হোক। তিনি আমাদের বলেন না তাদেরকে মারবোনা ধরবো। এই বলেই তাহের স্যার রাস্তার উত্তর পাশ দিয়ে কাঠের ব্রিজের নিচে গেলে ৫শ গজ দুরেই শিমুল গাছে পাক সেনাদের অবজারভেশন পোস্ট থেকে দেখে ফেলে। কামালপুর পাক বাহিনী ক্যাম্পে ওয়ারলেসে তারা বার্তা পাঠালে মুর্হুতেই ৬০ মিলিমিটার মর্টার সেল নিক্ষেপ করলে তাহের স্যারের পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দ্রুত স্ট্রেচারে করে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে নিয়ে যাই। সেখান থেকে হেলিকপ্টার যোগে আসামের গোহাটিতে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায়।

বাংলাদেশ জার্নাল : যুদ্ধ চলাকালে উল্লেখযোগ্য স্মৃতি কি?

বশির আহমেদ : কামালপুর পাকসেনা ক্যাম্পের কোনায় শিমুল গাছের তলা থেকে রকেট লাঞ্চার নিক্ষেপ করে মহেন্দ্রগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে আক্রমন করে। আমাদের ক্যাম্প ছেড়ে নিচে নেমে যেতে হয়েছিল। দূর থেকে রকেট লাঞ্চারের গোলাবারুদ ক্যাম্পের উপর এসে পড়ছে। সেদিন ভযাবহ হামলার মুখে পড়েছিলাম। সেই ভয়াল দৃশ্য আজো মনে পড়ে।

বাংলাদেশ জার্নাল : আপনি নিশ্চিত মৃত্যু জেনে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে কামালপুর পাকসেনা ক্যাম্পে গিয়েছিলেন, বিজয়ের বার্তা বহনের গৌরবময় অভিজ্ঞতার কথা বলুন।

বশির আহমেদ : ৪ ডিসেম্বর সকাল বেলা যৌথ বাহিনীর ১১ নং সেক্টর সেনাপতি বিগ্রেডিয়ার হরদেব সিং ক্লে ১১ নং সেক্টরের উপস্থিত ২০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার উদ্দেশ্যে প্রস্তাব রাখলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাকসেনাদের আত্মসর্মপনের প্রস্তাব নিয়ে যেতে হবে কামালপুর ক্যাম্পে। সবাই নিশ্চুপ। আমি উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে বললাম আমি যাবো। সেনাপতি আমাকে নির্দেশনা দেয়, তুমি এক হাতে সাদা পতাকা আরেক হাতে সারেন্ডার লেটার নিয়ে যাবে। ক্যাম্পের কাছে বাঁধ রোডের কিছু উপরে উঠবে সাদা পতাকা ও সারেন্ডার লেটার দেখাবে এবং ইশারায় ডাকবে। তারা আসলে হাতে সারেন্ডার লেটার হস্তান্তর করবে আর গুলি চালালে নিচে পজিশনে নেমে পড়বে, আমরা আর্টেলারী ফায়ার দিয়ে তাদের দমিয়ে রাখবো তুমি চলে আসবে। সকাল ৮টায় সাদা পতাকা হাতে সারেন্ডার লেটার নিয়ে কামালপুর ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ব্রাহ্মন পাড়া থেকে কামালপুর ক্যাম্প পর্যন্ত পুরো জায়গাটা ফাঁকা। আমি সাদা পতাকা উড়িয়ে মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছলে পাকসেনারা দেখে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যার যার ব্যাংকারে পজিশন নেয়। আমি অর্ধেক না উঠে সাহস করে বাঁধ রোডের উপরে উঠে পড়লাম। তাদের সারেন্ডার লেটার দেখালাম ও ইশারায় ডাকতে থাকলাম। প্রায় ৩০ মিনিট ডাকলেও তারা কাছে না এসে উল্টো ইশায়ায় তাদের কাছে যেতে বলে।

তারপর ?

বশির আহমেদ : ক্যাম্পে ঢোকার রাস্তায় গ্রেনেড মাইন লে আউট করে রেখেছে। সে পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। র্দীঘ সময় পার হওয়ার পর গুলি করতে পারে ভেবে সাবধানে পা ফেলে ক্যাম্পে পৌঁছাই। একজন পাকিস্তানি আর্মি অফিসার এসে আমার হাত থেকে সারেন্ডার লেটার ও সাদা পতাকা নিয়ে পিঠে হাত দিয়ে বলে মুক্তিযোদ্ধা তুম মাত গাবরাও। সেখানে আমাকে দুটি রুটি ডাল ও পানি খেতে দিল। আমার নিরাপত্তার জন্য একজন অফিসার নিয়োগ করে আশপাশে সৈন্যদের না আসার নির্দেশ দিলেন। আমার দেরি দেখে ক্যাম্পের উপরে ভারতীয় ৪টি বিমান টহল দিল। অক্ষত রাখতে আমার হাত ধরে টান দিয়ে পাক আর্মি অফিসার বাংকারের অভ্যন্তরে নিয়ে গেল। বিমান থেকে একটি বোমা নিক্ষেপ করে। তবে আমি ও পাকসেনাদের কেউই আক্রান্ত হয়নি। আধা ঘন্টা পর রকেট লাঞ্চার মেরে ভারতীয় বিমান চলে গেল। ইতোমধ্যেই বিমান হামলায় পাক সেনাদের মধ্যে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেছে। আমাকে মেরে ফেলেছে ভেবে সাড়ে ৭ ঘন্টা পর বেলা সোয়া ৩টার দিকে মুক্তিযোদ্ধা সঞ্জু কে সারেন্ডার লেটার ও সাদা পতাকা দিয়ে পাঠালো। সাড়ে ৩টার দিকে ভারতীয় যুদ্ধ বিমান পুনরায় কামালপুর পাকসেনা ক্যাম্প আক্রমন করলো। বিমান থেকে নিক্ষেপ করা বোমা ও রকেট লাঞ্চারের আঘাতে ৪জন পাক সেনা আহত হয়। এক অফিসার দৌড়ে এসে বলে তোমরা ফাঁকা মাঠে গিয়ে সাদা পতাকা দেখাও, আমরা আত্মসর্মপন করবো। আমরা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে সাদা পতাকা উড়ালে ভারতীয় বিমান চলে যায়। ৪টার দিকে ক্যাম্পের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন আনসার মালিক সারেন্ডার লেটারের জবাব লিখে সাথে সাদা পতাকা দিয়ে বলে তোমাদের ব্রিগেডিয়ারের কাছে পৌঁছিয়ে ফেরত লেটার নিয়ে আসো। আমি পৌছলে আত্মসর্মপণের শর্তাবলী লিখে ফেরত লেটার দিয়ে ফের পাক ক্যাম্পে আমাকে পাঠায়। পরে আমার সাথে পাকসেনারা অস্ত্র নামিয়ে আত্মসর্মপণ করে। আমাদের কামালপুর ক্যাম্প দখলের পর বাঙালীর স্বাধীনতা লাভের সূচনা হয়। বাংলাদেশ বিজয়ের পথে যাত্রা শুরু করে। দ্রুত হানাদার মুক্ত হয় ১১নং সেক্টরের অন্যন্য অঞ্চলগুলো। পরে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী বিজয়ের বেশে রাস্তায় পাকসেনাদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে জামালপুর ও টাঙ্গাইল দখল শেষে রাজধানী ঢাকা দখল করে। ১৬ ডিসেম্বর রেসর্কোস ময়দানে পাকবাহিনীর সারেন্ডার শেষে বাংলাদেশের আকাশে ওড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।

বাংলাদেশ জার্নাল : যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন তা কি বাস্তবায়ন হয়েছে?

বশির আহমেদ : না তা বাস্তবায়ন হয়নি। অপূর্ণ রয়ে গেছে অনেকটাই। স্বাধীনতার সত্যিকারের চেতনা থেকে বাংলাদেশ অনেক দূরে। এই বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধসাথীরা জীবন দেয়নি।

বাংলাদেশ জার্নাল : ভবিষৎ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন

বশির আহমেদ : আমাদের অসমাপ্ত কাজ ভবিষৎ প্রজন্মকে সম্পন্ন করার আহবান জানাচ্ছি। সমাজে নাগরিক বৈষম্য থাকবেনা, রাষ্ট্রীয় অনিয়ম দুর্নীতি নির্মুল করতে হবে। সকল নাগরিক অধিকার ভোগ করবে জনগন। তাহলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে।

বাংলাদেশ জার্নাল : সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

বশির আহমেদ : আপনিসহ বাংলাদেশ জার্নাল পরিবারকে ধন্যবাদ।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসবি

  • সর্বশেষ
  • পঠিত