ঢাকা, শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

‘ক্রাশ কনফেশন’ যখন ক্রাইম কনফেশন

  কামরুজ্জামান পলাশ

প্রকাশ : ২৫ জানুয়ারি ২০২১, ২১:৩২

‘ক্রাশ কনফেশন’ যখন ক্রাইম কনফেশন
ছবি: সংগৃহীত

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘প্রেম গাছ থেকে পড়া অন্ধ তালের মতো, কার ঘাড়ে গিয়ে যে কখন পড়ে তা আগে ভাগে বলা যায় না’। যদিও তিনি তালটি ঘাড়ে পড়ার পরবর্তী অবস্থার কথা বলেননি, তবে আন্দাজ করা যায়, যার ঘাড়ে পড়বে তার অবস্থা বেশ সুখকর হবে বলে মনে হয় না।

সেই আদিকাল হতেই ভালবাসার আদান-প্রদান হয়ে আসছে। আজও রয়েছে সেই ঐতিহ্য কিন্তু পাল্টে গেছে ভালবাসা প্রকাশের ধরন। আগেরকার সময়ে হাতে লেখা চিঠি বিনিময়ের মাধ্যমে ভাব ও ভালবাসা প্রকাশ করা হত আর একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা ব্যবহার করতে শুরু করি ডিজিটাল যোগাযোগ মাধ্যম। তারই এক বহুল আলোচিত ও সমালোচিত মাধ্যম হল ইন্টারনেট ভিত্তিক কিছু ফেসবুক পেজ ‘ক্রাশ এন্ড কনফেশন’।

আজকাল স্কুল, কলেজ থেকে শুরু করে ভার্সিটি পড়ুয়া তরুণ-তরুণীদের প্রেম নিবেদনের মাধ্যম হয়ে উঠেছে এইসব অনলাইন ভিত্তিক পেজ। যেইখানে তারা সহজেই নিজের পরিচয় গোপন রেখে অপরিচিত একজনের ছবি দিয়ে কাব্যিক ভাষায় বা কখনো আবেগময় কথার বাচনভঙ্গি দিয়ে নিজের ভাষাগত দক্ষতা দেখিয়ে তার প্রিয় মানুষটিকে তার মনের কথা জানাতে চায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাস্তব ও আইনগত দিক দিয়ে কতটুকু যুক্তিযুক্ত এই ধরনের প্রেম নিবেদন বা প্রচলিত আইন কতটুকু সমর্থন করে এই অনলাইনভিত্তিক রোমিও-জুলিয়েটদের?

‘ক্রাশ এন্ড কনফেশন’ কথাটির সঙ্গে কম বেশি সবাই পরিচিত। অনেকেই এইজাতীয় পেজ এ পোস্ট করার মাধ্যমে তাদের প্রিয়জনকে প্রেম নিবেদন করে থাকে। এই ধরনের পোস্ট করার কারণে অনেকের গোপনীয়তা নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া কখনো কখনো এইসব পোস্টের মাধ্যমে কারোর সম্মান হানিও ঘটে।

৫ এপ্রিল ২০১৯ এ ‘দি ডেইলি ক্যাম্পাস’ পত্রিকায় ‘ফেসবুকে যৌন হয়রানি, রাবি ছাত্রীর জিডি’ নামীয় একটি সংবাদের হেডলাইন ছিল। উক্ত সংবাদের বিবরণীতে বলা হয়, ৪ এপ্রিল মধ্যরাতে ‘আর ইউ ক্রাশ এ্যান্ড হেইট কনফেশন’ নামক ফেসবুক পেজে তার ছবিসহ একটি পোস্ট দেয়া হয়। পোস্টে ওই ছাত্রীর সম্মানহানি করে আপত্তিকর ও বিব্রতকর কথাবার্তা লেখা হয়। এ বিষয়ে পেজটির কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর পরও পোস্ট সরিয়ে না নেয়ায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য থানায় জিডি করেন রাবি ছাত্রী।

২২ অক্টোবর ২০১৯ সালে আরেকটি অনলাইন ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল ‘বাংলা’ ‘চবিতে কনফেশন পেজের নামে নোংরামি’ হেডলাইন সংবলিত সংবাদ প্রকাশিত হয়। উক্ত সংবাদেও কনফেশন পেজের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের হয়রানির কথা তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য যে, ‘১৯ অক্টোবর, শনিবার প্রাণীবিদ্যার এক শিক্ষার্থী সম্পর্কে ব্যক্তিগত তথ্য তুলে ধরে তার সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা হয়। এরপর থেকেই এই পেজগুলো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হতে থাকে ক্যাম্পাসে। পেজটি বন্ধের জন্য প্রশাসনের কাছে দাবিও জানান তারা।’

২০১৮ সালের ৪৬ নং আইন ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন ২০১৮’র মাধ্যমে বর্ণিত সকল সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে। উক্ত আইনের এর ধারা ২৬ এ অনুমতি ব্যতীত পরিচিতি তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবহার ইত্যাদির দণ্ড সম্পর্কে বলা হয়েছে। ধারা ২৬ এর উপধারা-১ এ বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি আইনগত কর্তৃত্ব ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তির পরিচিতি তথ্য সংগ্রহ, বিক্রয়,দখল, সরবরাহ বা ব্যবহার করেন তাহলে উক্ত ব্যক্তি উপধারা ২ অনুসারে অনধিক ৫(পাঁচ) বছরের কারাদণ্ড বা ৫ (পাঁচ) লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

তাছাড়া উপধারা-৩ এ বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি উপধারা-১ এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার সংঘটন করে তাহলে তিনি অনধিক ৭(সাত) বছরের কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০(দশ) লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

আরো উল্লেখ্য যে, উক্ত আইন ২০১৮’র ধারা ২৬ এ ‘পরিচিতি তথ্য’ বলতে: নাম, ছবি, ঠিকানা, জন্ম তারিখ ইত্যাদি বোঝানো হয়েছে। এই আইনের ধারা ২৯ এ মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, প্রচারের শাস্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ধারা ২৯ এর উপধারা-১ এ বলা হয়েছে যদি কোন ব্যক্তি ওয়েবসাইট কিংবা কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে পেনাল কোড-১৮৬০ এর ধারা ৪৯৯ এ বর্ণিত মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করে তাহলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক ৩(তিন) বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ৫(পাঁচ) লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তাছাড়া উপধারা-২ এ বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি উপধারা-১ এ বর্ণিত অপরাধ পুনরায় সংঘটন করেন তাহলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক ৫(পাঁচ) বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০(দশ) লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

উক্ত আইন ২০১৮ এর ধারা ৩৫ এ অপরাধ সংঘটনে সহায়তার শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ধারা ৩৫ এর উপধারা ১ ও ২ এ বলা হয়েছে যে, যদি কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেন, তাহলে উক্ত কাজটি আইনের চোখে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে এমনকি শাস্তির ক্ষেত্রে মূল অপরাধটির জন্য যে দণ্ড নির্ধারিত রয়েছে, সহায়তাকারী ব্যক্তি সেই দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

তাই ক্রাশ এন্ড কনফেশনের নামে বিনা অনুমতিতে অপরিচিত কারোর নাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি বা অন্যান্য তথ্য দেয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

এইক্ষেত্রে শুধু পোস্টদাতা নয় উক্ত পোস্ট শেয়ার করতে সহায়তাকারীকেও সমানভাবে দোষী হিসেবে গণ্য করা হবে। এই ক্ষেত্রে পোস্ট দাতা ও পোস্ট দানে সহায়তাকারী ক্রাশকে নিয়ে নয় বরং নিজেদের ক্রাইম সম্পর্কে স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন।

পরিশেষে বলা যায় প্রেম নিয়ে নেপোলিয়নই যথার্থ বলেছেন, ‘প্রেমের ব্যাপারে যদি কেউ জয়ী হতে চায়, তাহলে সে ক্ষেত্রে জয়ী হওয়ার একমাত্র অস্ত্র হলো পলায়ন করা। নেপোলিয়নের কথা মেনে পালালে হয়ত সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের মতে ব্যাখ্যা করা ঘাড়ে গাছ থেকে পড়া অন্ধ তাল থেকে বাঁচা যাবে।

লেখক: ছাত্র, আইন বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি

বাংলাদেশ জার্নাল/এনএইচ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত