ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

ওরা সমুদ্রের যাযাবর

  জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশ : ২২ জুলাই ২০২০, ১৬:৫৩

ওরা সমুদ্রের যাযাবর

মানব সমাজের প্রথম থেকেই যাযাবর জীবন চলে আসছে। বলতে গেলে এক সময় শিকার ও খাবারের খোঁজে মানুষ দলবদ্ধভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়াতো। গড়ে তুলতো স্বল্পস্থায়ী বসতি। এ ধারা এখনো অব্যাহত আছে। এরমধ্যে কিছু যাযাবর গোষ্ঠীর জীবনযত্রা খুবই বিচিত্র।

তেমনই একটি যাযাবর গোষ্ঠী বাজাউ। যাদেরকে সমুদ্রের যাযাবরও বলা হয়ে থাকে। কারণ সমুদ্র তীরবর্তী অগভীর পানিতেই তাদের বসবাস।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগর সংলগ্ন সমুদ্রে তাদের দেখা যায়। যারা জীবনের প্রায় পুরোটা সময়ই সাগরে কাটিয়ে দেন সমুদ্রে। তাদের রয়েছে একটি বিরল যোগ্যতা। সেটি হলো, অবিশ্বাস্যভাবে তারা জলের নিচে প্রায় ১০ থেকে ১৩ মিনিট শ্বাস ধরে থাকতে পারে, যা বিশ্বের আর কোনো উপজাতির মানুষেরা পারে না।

সাগরে কাটানো এই যাযাবর জাতির সামুদ্রিক জীবন যাপনের নেপথ্যে রয়েছে একটি রূঢ় বাস্তবতা। প্রায় হাজার বছর আগের কথা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জোহর রাজ্যের রাজকন্যা দায়াং আয়েশাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সুলু রাজ্যের রাজার সঙ্গে বিয়ে দিতে। তাই জোহরের রাজার বিশাল রাজকীয় নৌবহর চলেছে সমুদ্র পথে। কয়েকশো নৌকার বহর। রাজকন্যাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাজাউ নামের এক উপজাতি। যারা এই এলাকার সমুদ্রকে নিজের হাতের তালুর মতই চেনে।

ব্রুনেইয়ের তৎকালীন সুলতান আগেই আয়েশাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জোহরের রাজা তার মেয়ের সঙ্গে ব্রুনেইয়ের সুলতানকে বিয়ে দিতে রাজি নন। এই অপমান ভুলতে পারেননি ব্রুনেইয়ের সুলতান। সুলুর রাজার সঙ্গে আয়েশার বিয়ে তিনি মেনে নিতেও পারেননি। তাই অন্য কৌশল নিলেন সুলতান। আরও বড় নৌবহর নিয়ে এসে জোহর রাজ্যের নৌবহরকে অতর্কিতে আক্রমণ করলেন। গভীর সমুদ্রে তুমুল লড়াইয়ের পর ছিনিয়ে নিয়ে গেলেন জোহরের রাজকন্যাকে।

দেশে ফিরেই রাজকন্যাকে বিয়ে করলেন সুলতান। আর বিপদে পড়লেন কয়েকশ' বাজাউ ও তাদের পরিবার। দেশে ফিরলে জোহরের রাজা হত্যা করবেন। প্রাণের ভয়ে তারা আর দেশে ফিরতে পারেনি। স্থলের সঙ্গে তাদের চিরকালের জন্য বিচ্ছেদ হয়ে যায়। সমুদ্রই হয়ে যায় তাদের ঘর। ঘুরতে থাকে বাজাউরা বিভিন্ন উপসাগরে, দেশহীন যাযাবর হয়ে।

আজও সমুদ্রেই আছে বাজাউরা

সম্পূর্ণভাবে সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল বাজাউ-লাউটদের আজও পুরো জীবন কাটে সমুদ্রে। প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরের মাঝে অবস্থিত ব্রুনেই, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়াকে ঘিরে বেশ কয়েকটি উপসাগর রয়েছে। যাদের নাম সুলু, সেলেবিস, বান্দা, মালুকু, জাভা, ফ্লোরেস এবং সাভু। এই উপসাগরগুলোর নীল জলে ঘুরে বেড়ান বাজাউরা, তাদের বিশেষ আকৃতির নৌকা লেপা-লেপাতে চড়ে। নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা নেই এদের। তাই এদের বলা হয় 'সি জিপসি' বা 'সি নোম্যাড'।

সমুদ্রের অগভীর জলে বাজাউদের অস্থায়ী বসতি

সমুদ্রের অগভীর এলাকায়, তীর থেকে আধ কিলোমিটার সমুদ্রের ভেতরে বাজাউরা তৈরি করেন তাদের অস্থায়ী গ্রাম। বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি করা বাড়িগুলো কয়েক ঘন্টার মধ্যে খুলে ফেলা যায়। বাড়িগুলোর নিচ দিয়ে সমুদ্রের ঢেউ বয়ে যায়। ছোট ছোট ডিঙির মত নৌকা করে চলে এ বাড়ি সে বাড়ি যাওয়া আসা। বাড়ি থেকে নেমে আসে মই। ওপরে ওঠার জন্য। জলের ওপরে বানানো হলেও ঘরগুলো কিন্তু পোক্ত। ২০০৪ সালে হওয়া সুনামিতে বাজাউদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। সুনামি ঠিক তাদের ঘরের নিচ দিয়ে গেছে।

কেউ কেউ আবার নৌকাতেই থাকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। শুনতে অবাক লাগলেও এটা সত্যি, এই উপজাতির অনেক মানুষ আছে যারা মাটিতে কোনো দিন পা রাখেনি। রাখবেই বা কী করে। নিজের দেশ নেই, নাম শুনলেই পুলিশ তাড়া করে।

বাজাউরা নিজেদের বয়স বলতে পারে না। এই যুগেও, সময় কিংবা তারিখ সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। ঠিক যেমন তারা জানে না বিদ্যুৎ কী ও কেন লাগে। সামুদ্রিক মাছের তেলের মশাল আজও তাদের রাতের অন্ধকার কাটায়। সমুদ্র তীরবর্তী কিছু সহৃদয় গ্রাম এদের জ্বালানি কাঠ ও পানি এবং জামা কাপড় দেয়। বিনিময়ে বাজাউরা দেয় মাছ।

বাজাউরা তিমি ও ডলফিনের মতই প্রাকৃতিক ডুবুরী

অত্যন্ত শান্ত ও আমুদে এই উপজাতিটি সম্পূর্ণ সামুদ্রিক খাবারের ওপর বেঁচে থাকে। বছরের বেশিরভাগ দিনই তাদের সমুদ্রের নিচে নামতে হয় খাদ্য সংগ্রহের জন্য। তাই প্রত্যেকটি বাজাউ পুরুষ ও নারী অবিশ্বাস্য মানের ডুবরী। জলের নিচে তারা জলের ওপরের মতই সাবলীল। ছোট বাজাউ শিশুরাও সমুদ্রের তলায় মাছের মতোই সাঁতার কেটে বেড়ায়। এমনকি খেলা করতেও সমুদ্রের জলে নামে। ডাঙার শিশুরা যেমন মাঠে খেলতে যায়।

খুব ভোরে নয়, একটু বেলার দিকে সমুদ্রে নামে বাজাউ পুরুষরা। তার আগে ভারী হওয়ার জন্য কোমরে পাথর বেঁধে নেয়। কাঠ ও ফেলে দেয়া কাচ দিয়ে নিজেদের অপটু হাতে তৈরি করা জলনিরোধক চশমা চোখে পরে নেয়। যা জলের তলায় দেখতে ও চোখকে চাপ থেকে বাঁচাতে সাহায্য করে। সঙ্গে নেন নিজেদের বানানো অদ্ভুতদর্শন একটি কাঠের বন্দুক। যেটা দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে তির ছোঁড়া যায় জলের নিচে।

এরপর বাজাউরা এক বুক শ্বাস নিয়ে খাদ্যের সন্ধানে নেমে যায় সমুদ্রের ২৩০ ফুট নিচে। অবিশ্বাস্যভাবে এরা জলের নিচে শ্বাস ধরে থাকতে পারে প্রায় ১০ থেকে ১৩ মিনিট। যা বিশ্বের আর কোনো উপজাতির মানুষরা পারে না। জলের নিচে শিকার করে তাদের প্রধান খাদ্য বিভিন্ন মাছ, স্টিং রে, স্কুইড, অক্টোপাস। উঠে আসার সময় শরীরে বাঁধা ওজন খুলে ফেলে শরীরকে হালকা করে নেয়।

জলের নিচে এতক্ষণ দম চেপে রাখার রহস্যটা কী?

বিভিন্ন গবেষকের জীবজগতের ওপর করা গবেষণাপত্র প্রকাশ করে থাকে বিশ্বখ্যাত জার্নাল সেল। এই পত্রিকাটিতে, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষক মেলিসা ইলার্ডো ও রাসমুস নিয়েলসেন বাজাউদের নিয়ে করা এক গবেষণাপত্রে দিয়েছেন বাজাউদের এই রহস্যের উত্তর। গবেষকরা জানিয়েছেন, বাজাউদের জিনে থাকা কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যই তাদের প্রাকৃতিক ডুবুরি করেছে।

বাজাউরা যখন শ্বাস চেপে জলে ডুব দেয় তখন তাদের দেহে বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা দেয়। হৃদপিন্ড তার কাজ কমিয়ে দেয়। অক্সিজেন বাঁচিয়ে রাখার জন্য। পালস রেট নেমে দাঁড়ায় প্রতি মিনিটে মাত্র ৩০ বার। শরীরের বাইরের দিকের কলাকোষ থেকে রক্তপ্রবাহের অভিমুখ ঘুরে যায় শরীরের ভেতরের দিকে। রক্ত যায় মস্তিষ্ক, হৃদপিন্ড ও ফুসফুসে।

মানুষের প্লীহা হলো অক্সিজেন যুক্ত লোহিত রক্তকণিকার ভাঁড়ার ঘর। ডুবন্ত বাজাউদের প্লীহা ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে এই আপৎকালীন পরিস্থিতিতে রক্তের স্রোতে অক্সিজেন যুক্ত লোহিত রক্তকণিকার যোগান বাড়িয়ে দেয়।

এই গবেষণাটির জন্য মেলিসা ইলার্ডো ইন্দোনেশিয়া গিয়েছিলেন সঙ্গী গবেষকদের নিয়ে। ৫৯ জন বাজাউকে রাজি করিয়েছিলেন তাঁর গবেষণায় সাহায্য করার জন্য। তিনি বাজাউদের ডিএনএ পরীক্ষা ও তাদের প্লীহার আলট্রাসোনগ্রাফি করান। একইসঙ্গে তিনি বাজাউদের সঙ্গে অতীতে সম্পর্কযুক্ত ও বর্তমানে ডাঙাতেই বাস করা মোরো উপজাতির ৩৪ জন মানুষেরও একই পরীক্ষা করেন। উভয় গোষ্ঠীর সমস্ত পরীক্ষা করে দেখা যায় বাজাউদের প্লীহা, মোরো উপজাতির মানুষদের প্লীহার তুলনায় ৫০ শতাংশ বড়। এই শারীরিক পার্থক্যই বাজাউদের অবিশ্বাস্য ডুবুরি করে তুলেছে।

ডিএনএন বিশ্লেষণেও একই জিনিস দেখা গেছে। বাজাউদের জিনে আকস্মিক পরিবর্তন বা মিউটেশন দেখা গেছে। এমন একটি জিনে এই পরিবর্তন হয়েছে যেটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। সেই জিনটি আপদকালীন প্রয়োজন অনুসারে রক্তস্রোতকে পাঠিয়ে দেয় সেই অঙ্গগুলোতে, যেখানে সবচেয়ে বেশি অক্সিজেন দরকার। যে অঙ্গগুলোতে অক্সিজেন কিছুক্ষণ না গেলে ততটা ক্ষতি হবে না, সেদিকে রক্তস্রোত কমে যায়।

পরিবর্তন দেখা গেছে বাজাউদের আরেকটি জিনে। যেটি কার্বনিক অ্যানহাইড্রেজ নামে একটি এনজাইম তৈরি করে। যে এনজাইমটি রক্তস্রোতে খুবই ধীরে কার্বন-ডাই অক্সাইড পাঠায়। ফলে এই পরিবর্তনটিও বাজাউদের শ্বাস ধরে রাখতে সাহায্য করে। প্লীহা সংলগ্ন পেশীর সংকোচন ঘটায় যে জিন তারও পরিবর্তন হয়েছে। যে জিনটি প্লীহার সংকোচন ঘটিয়ে রক্তে অক্সিজেন মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে।

পরীক্ষার সমস্ত ফলাফল বিশ্লেষণ করে গবেষকরা সিদ্ধান্তে আসেন। সামুদ্রিক পরিবেশে টিকে থাকার জন্য, শত শত বছর ধরে খাদ্য সংগ্রহের জন্য সমুদ্রের গভীরে যাওয়ার অভ্যাস, বাজাউদের বিভিন্ন অঙ্গ ও শ্বসনতন্ত্র এবং রক্ত সংবহনতন্ত্রে স্থায়ী পরিবর্তন ঘটিয়েছে। তাই, বাজাউরা সমুদ্রের জলে মাছের মতোই সাবলীল। অন্যদিকে ডাঙার খাবারে অভ্যস্ত হওয়ায় মোরো উপজাতির ডুব দেওয়ার ক্ষমতা নেই।

বাজাউদের দেশ নেই। পরিচয়পত্র নেই। ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া আর মালয়েশিয়ার তীর বরাবর সুলু সমুদ্রে যাযাবর হয়ে ঘুরে বেড়ায় তারা। অসুস্থ হলেও তীর ছোঁয়ার উপায় নেই। নাগরিক না হওয়ায় ডাঙায় এলে বিভিন্ন দেশের হাসপাতাল চিকিৎসা করে না। পুলিশ গ্রেপ্তার করে ফেলে রাখে জেলে, বিনা বিচারে। তাই জন্মের মতো বাজাউদের মৃত্যুও হয় সমুদ্রে। নৌকা করে দূর সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে ভাসিয়ে দেয়া হয় মৃতদেহ। সূত্র: ইন্টারনেট

বাংলাদেশ জার্নাল/আরকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত