ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৭ মিনিট আগে
শিরোনাম

বিভীষিকার সেই স্মৃতি আজও তাড়া করে

  আহমেদ ইসমাম

প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২০:২১  
আপডেট :
 ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২০:২৯

বিভীষিকার সেই স্মৃতি আজও তাড়া করে

রাজধানীর পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় ভয়াভহ অগ্নিকাণ্ডের এক বছর পার হলেও এখনো ট্রমা থেকে বের হতে পারেননি এলাকার বাসিন্দারা। বিশেষ করে যারা সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী। যে কোনো অস্বাভাবিক শব্দ আর হই হুল্লোড়ে আঁৎকে ওঠেন তারা। আতঙ্কে ঘর ছেড়ে নেমে আসেন রাস্তায়।

তাদের এ আতঙ্কের কারণগুলোও এখনো বিদ্যমান। রাসায়নিক গুদাম না সরানোয় সব সময় সন্ত্রস্ত থাকেন স্থানীয়রা। তাদের বক্তব্য, এই রাসায়নিক গুদাম না সরানো পর্যন্ত আমাদের আগুন আতঙ্ক যাবে না।

স্থানীয়রা বলছেন, সেই ভয়াভহ আগুনের সাক্ষী হয়ে আছি আমরা। এই এলাকার শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার চোখের সামনেই ঘটে ওই ঘটনা। আমাদের অনেকেই প্রাণে বেঁচে গেলেও অধিকাংশ পরিবার তাদের স্বজনদের হারিয়েছে। অনেকেই এই ঘটনা নিজ থেকে দেখার কারণে মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত। চোখের সামনে যে কোনো ছোট ঘটনায়ও তারা আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে থাকেন।

বৃহস্পতিবার সরেজমিনে চুড়িহাট্টায় গিয়ে দেখা যায়, বিষণ্ন মুখে স্বজনদের স্মরণে জড়ো হয়েছেন অনেকেই। বড় ভাইকে হারানো আরিফ উদ্দিন বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, আমাদের স্বজন হারানোর এক বছর হয়ে গেলেও এই এলাকার কোনো পরিবর্তন হয়নি। আগের মতই চলছে কেমিক্যাল ব্যবসা। এই ব্যবসা বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এই অবস্থা চলতে থাকলে এক বছর আগের ঘটনা যে কোনো দিন আবারো ঘটে যেতে পারে। আজ আমি আছি। সেদিন হয়ত আমিও থাকব না।

চুড়িহাট্টার আগুনে পুড়ে যাওয়া ওয়াহেদ ম্যানশন ভবনের পাশেই বাস করেন আহমেদ সঙ্গিত। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে আমরা বিকট একটা শব্দ শুনতে পাই। মেশিনের এমন বিকট শব্দ আর চারদিকে ধোয়া দেখতে পাওয়ার কারণে সবাই ভেবেছিল আগুন লেগেছে। এই ঘটনায় এলাকায় আতংক ছড়িয়ে পরে। আশেপাশের সবাই বাসা থেকে রাস্তায় বের হয়ে আসে। তিনি আরো বলেন, পরে আমরা খোঁজ নিয়ে দেখি রাস্তা মেরামতের জন্য পরিষ্কার করছিল। এই মেশিনের শব্দ আর ধোয়ায় সবাই আগুন ভেবে রাস্তায় নেমে আসে।

বৃহস্পতিবার বিকালে ১৩ বছেরের তারিকুল ইসলাম তামিমের পরিবারের সবার একটি ছবি নিয়ে চুড়িহাট্টার মোড়ে আসেন তামিমের খালা নাসিমা আক্তার। তিনি বলেন, বাবা-মা মারা যাওয়ার পর নানা ও খালার সাথে থাকছে তামিম। প্রায় রাতে ঘুমানোর আগে বাবামার বিষয়ে জানতে চায় সে।

বাবা রাশেদুল ইসলাম ও মা সোনিয়া ইসলামের বড় আশা ছিল ছেলে জি পি এ ৫ পাবে। ছেলে তামিম ঠিকই জেএসসিতে জি পি এ ৫ পেয়েছে। কিন্তু বাবা মা সেই আনন্দের কথা জানতে পারেনি। কথাগুলো বলার সময় নাসিমা আক্তারের চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিলো। বোনের ছেলেকে নিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখেন। বাবা মায়ের প্রত্যাশার বাস্তবায়ন করবেন। ডাক্তার হয়ে তামিম বাবা-মায়ের স্বপ্নপূরণ করবে।

সেই ভয়াভয় দিনের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে তার খালা বলেন, তামিমের মা-বাবা তার এক বন্ধুর বাসায় জন্মদিনের উৎসবে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। তাদের সাথে ছিলো তামিম ও তার ছোট ভাইও। রিকশা চুড়িহাট্টা মোড়ে পৌঁছাতেই আগুন জ্বলে ওঠে। আগুনের গোলা তাদের উপর এসে পড়ে। তখনই রিকশা থেকে তামিমকে তার বাবা ধাক্কা দিয়ে পিছনের দিকে ঠেলে দেন। এতে পড়ে গিয়ে আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যায় সে। কিন্তু আগুনের গোলা কেড়ে নেয় তার মা-বাবা আর ছোট ভাইয়ের প্রাণ। ঘটনার পুরোটাই মনে আছে তামিমের। তবে এখন আর মনে করতে চায় না সে। ওই দিনের কথা মনে পড়লে বাবা-মায়ের কথা ভেবে নীরবে চোখের পানি ফেলে এতিম।

ব্যবসায়ী স্বপন আলী বলেন, সেই দিন এই ভবনের পাশেই একটি হোটেলে আমি পানি পান করছিলাম। এমন সময় হঠাৎ একটি বিকট শব্দ শুনতে পাই। মুহূর্তের মধ্যে পুরো এলাকা আগুনে ছেয়ে যায়। আমার সামনেই কয়েকজন সেই আগুনে পড়ে থাকে। তারা চেষ্টা করেও আর বের হয়ে আসতে পারেনি। আমি দূর থেকে দাড়িয়ে দেখছিলাম মানুষগুলো বাঁচার জন্য ছোটাছুটি করছিল। তাদের পুরো শরীরে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছিল। আগুনের তেজ এত বেশি ছিল যে মাত্র ১০ সেকেন্ডের মধ্যেই সবাই নিস্তেজ হয়ে যায়।

তিনি আরো বলেন, এই ঘটনার সময় জায়গাটিতে যানজট লেগেছিল। কোনো গাড়িই এগুতে পারছিল না। যার ফলে চাইলেও কেউ দৌড়ে বের হতে পারছিল না। অনেকেই চেষ্টা করলেও আগুনে পুড়ে মারা যায়।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী বলেন, বর্তমানে পুরান ঢাকায় রাসায়নিক গুদামের ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন বন্ধ রয়েছে। এছাড়া নতুন করে কোনো রাসায়নিক গুদামের লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করছি, অবৈধ রাসায়নিক গুদামগুলো সরিয়ে ফেলার।

প্রসঙ্গত, গতবছর ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টায় চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশন নামে একটি ভবনে আগুন লাগে। এত ৭০ জনের লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, তারা ৭৮টি মৃতদেহ পেয়েছেন। এ ঘটনায় ভবন মালিকের নামে মামলা হওয়ায় তিনি কয়েকদিন জেল খেটে জামিনে ছাড়া পান।

বাংলাদেশ জার্নাল/আরকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত