ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৮ মিনিট আগে
শিরোনাম

মার্চ মানে স্বাধীনতা, মার্চ মানে বঙ্গবন্ধু

  বিশ্বজিত রায়

প্রকাশ : ০২ মার্চ ২০২০, ১১:২১  
আপডেট :
 ০২ মার্চ ২০২০, ১১:৩৭

মার্চ মানে স্বাধীনতা, মার্চ মানে বঙ্গবন্ধু

এসেছে মহান স্বাধীনতার মাস মার্চ। যে মাসে বপন করা হয়েছিল বঙ্গ স্বাধীনতার বীজ, রচিত হয়েছিল যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মহাকাব্যিক স্বাধীনতাপত্র। পরাধীন বাঙালীকে শাণিত করার মুক্তিমন্ত্র পাঠ করা হয়েছিল এ মাসেই। বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে (তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দান) বজ্রকণ্ঠের দামামা সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এই মার্চেই। বঙ্গবন্ধুর ইস্পাত কঠিন ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে অপারেশন সার্চ লাইটের নামে নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাক প্রেতাত্মা গোষ্ঠী। ধূর্ত পাকবাহিনী বাঙালীর হৃদস্পন্দন বঙ্গবন্ধুকে পাকড়াও করে নিয়ে যায় তাদের আয়ত্তে। কিন্তু বসে থাকেনি বাঙালী। বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যে ভর করে পীড়িত বাঙালী এ মাসেই স্বাধীনতা যুদ্ধে শামিল হয়। তাই মার্চ ঐতিহাসিক মানদণ্ডে বিশেষ অর্থবহ। স্বাধীনতার মহান এ মাসটিতে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের গুরুত্বারোপ করতে চাচ্ছি।

বাঙালীর মুক্তি ও বঙ্গ রাজনীতির পরিশুদ্ধ মানুষটি হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাকে রাজনীতির কবি বলা হয়ে থাকে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু আন্দোলন, মুক্তি, মানবতা, শান্তি, সংগ্রাম, স্বাধীনতা, স্বাধিকার, সর্বোপরি রাজনীতির এক মহাকবি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। পরিপক্ব রাজনীতির সুদক্ষ নেতৃত্ব দিয়ে একটি জাতিকে চিরমুক্তি দিতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গ বাস্তবতার ঐতিহাসিক মানদণ্ডে বঙ্গবন্ধুই একমাত্র ব্যক্তি যিনি হাজার বছরের বঞ্চিত বাঙালীর দীর্ঘ বঞ্চনা ও মুমূর্ষু যাতনা ঘুচিয়ে পরাধীনতার পিঞ্জর থেকে বের করে বাঙালী জাতিকে স্বাধীনতার স্বাদ পাইয়ে দেয়ার সর্ববৃহৎ কাজটি সম্পাদনের মাধ্যমে জাতির জনকের আসনে সগৌরব ও দোর্দ- প্রতাপে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন। আর পৃথিবীর ময়দানে হার না মানা বীরত্বে বাঙালী জাতিসত্তার গৌরবান্বিত পরিচয়কে তুলে ধরতে যেমন সাহস-শক্তি জুগিয়েছিলেন তেমনি নিজেকে এক অনন্য অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার সমুন্নত বিরল চিরঞ্জীব উপমা রেখে যান দুর্লভ ক্ষমতার অধিকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

একাত্তরের মার্চে চরম মূল্য দিয়ে কেনা স্বাধীনতার সুস্থ বীজ বপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতা সংগ্রাম সংঘটিত হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে মার্চের ৭ তারিখ রেসকোর্স ময়দানে তিনি যে ঐতিহাসিক, অবিস্মরণীয় ভাষণ প্রদান করেছিলেন সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি পেয়ে যায় তার নিজস্বতা। বাঙালী পায় যুদ্ধে যাওয়ার পূর্ণাঙ্গ শক্তি ও সাহস। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ তখনকার সার্বিক পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছিল। তৎকালীন পূর্ব বাংলার পাশাপাশি পাক পশ্চিমা শক্তি ও বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল জাতির জনকের পরিপাটি বজ্রনিনাদ। বঙ্গবন্ধু তার কাব্যিক বক্তব্যে অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে বাঙালীকে যুদ্ধে নামার সকল প্রস্তুতি, নির্দেশনা, শত্রুশক্তির বিরুদ্ধে সাবধানী হুঙ্কারসহ দূরদর্শী দাবি উত্থাপন এবং বীরত্বমাখা কণ্ঠে দিয়ে যান স্বাধীনতার ডাক, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।’ বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণই বাঙালী মুক্তির পথ দেখিয়ে দিয়েছে। দাপটের ব্যাপকতা ছড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী কথামালা পরাধীন বাংলা, বৈশ্বিক পরিম-ল ও দুশমন দলের কাছে ভিন্ন ভিন্ন বার্তা দিতে পেরেছে। তখন রাজনীতির ময়দানে কেবল বঙ্গবন্ধুর নামই বার বার উচ্চারিত হয়েছে। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বিস্ফোরিত এ বক্তব্য দেশ-দেশান্তরে তুলেছে ঢেউ।

বঙ্গ ভূখণ্ডে পরাধীন রাজ্যে বসবাসরত সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর উৎকণ্ঠিত মননে মুক্তির মুক্ত পয়গাম নিয়ে হাজির হয়েছিল একাত্তরের মার্চ। চারপাশে খবর রটে। ওই দিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা সংশ্লিষ্ট ভাষণ প্রদান করবেন। প্রাণ উজ্জীবিত এই খবর বাঙালী জাতিকে আশান্বিত করে তুলে। ৭ মার্চ ভোর থেকেই মুক্তিপাগল বাঙালী হাঁটতে থাকে ঢাকার রাজপথে। দেশের আনাচে-কানাচে, পাড়া-মহল্লা, গাঁয়ের মেঠো পথ পেরিয়ে লাখ লাখ উপেক্ষিত প্রাণ গিয়ে জড়ো হয় বঙ্গ রাজধানীর শেষ ঠিকানায়। প্রতীক্ষিত লাখো বাঙালীর উপস্থিতিতে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে দেয়া বঙ্গবন্ধুর বজ্রকঠিন ভাষণের মাধ্যমে রোপিত হয়েছিল স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আদায়ের পরিপক্ব বীজ। সেদিন বঞ্চিত বাঙালী খুঁজে পেয়েছিল মুক্তির দিশা। পরাধীন বক্ষে সঞ্চারিত হয় সাহসের স্ফুলিঙ্গ। দানা বাঁধতে শুরু করে শত্রুমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী অভিলাষ। মুক্তির উত্তে নেশা জাপটে ধরে বাঙালী জাতিকে। তখন থেকেই যুদ্ধে যাওয়ার সর্বাঙ্গীণ প্রস্তুতি কাজ করে তৎকালীন পূর্ব বাংলায়। দুশমন দলের শকুনি শক্তিকে চিরতরে নির্মূল করার মূল্যবান রসদ পেয়ে যায় জুলুমবাজিতার কড়াল গ্রাসে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মুমূর্ষু বাঙালী। দীর্ঘ বঞ্চনা, শোষিত, নিপীড়নে নিমজ্জিত জাতির কণ্ঠে সর্বদা উচ্চারিত হয় ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর,’ ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা,’ ‘তোমার নেতা, আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব।’ ওই দিনের কাব্যিক ভাষণ বাঙালী জাতিকে যেমন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল তেমনি পৃথিবীর সমগ্র বঞ্চিত জাতির জন্য পথনির্দেশিকার দুর্লভ দলিল হিসেবে সবার সামনে উপস্থাপিত হবে সর্বদা।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পাকি অশুভ শক্তির জুলুমবাজি চেয়ারকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তারা মানসিকভাবে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পরবর্তী পাকিস্তান সেনাবাহিনী এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলেছিল, ‘চতুর মুজিব আমাদের সামনে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলেন, আমরা কিছুই করতে পারলাম না।’ আসলে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে যে রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করেছিলেন তাতে ক্ষমতাসীন পাক পশ্চিমা শক্তি শুধু মাথার ওপর অস্ত্র তাক করে মহড়াই দিয়ে গেল, কিন্তু তা ঠেকানোর মতো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কোন অনুষঙ্গই খুঁজে পেল না। শেখ মুজিবুর রহমানের সেদিনকার জনবিস্ফোরিত ক্ষমতা এবং তর্জনী, শাসক পাক শাসকগোষ্ঠীর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তখন থেকেই ধূর্ত পাকি শক্তি বঙ্গবন্ধুকে পূর্ববাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করার ফন্দি আঁটতে থাকে। সেই অশুভ চেতনার ফলস্বরূপ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ইয়াহিয়া-ভুট্টোর স্বৈরাচারী সরকার বাঙালীর হৃদস্পন্দন বঙ্গবন্ধুকে ২৫ মার্চ অন্ধকার রাতে অজ্ঞাত স্থানে তুলে নিয়ে যায়। অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ে বাঙালী। কিন্তু মুক্ত মুজিবের চেয়ে অবরুদ্ধ মুজিব যে আরও শক্তিশালী তা প্রমাণ করে দেখিয়ে দিল যুদ্ধজয়ী বাঙালী।

সামগ্রিক দিক থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অসাধারণ এ বক্তব্য বঞ্চিত বাংলায় যেমন ঝড় তুলেছিল তেমনি বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল। পাকবন্ধু যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও সৌদি আরবসহ সব মিত্রশক্তির কাছে সাবধানী বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর শির উঁচানো বক্তৃতা। ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চে বঙ্গবন্ধুর দেয়া সেই ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো। ফলে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ ইউনেস্কোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণের মধ্যে অন্যতম হিসেবে স্থান পেয়েছে। ইতিহাসবিদ ও লেখক জ্যাকব এফ ফিল্ডের লেখা ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস: দ্য স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্ট্রি’ গ্রন্থে গত আড়াই হাজার বছরে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী যুদ্ধকালীন বক্তৃতাগুলো উঠে এসেছে। সেখানে গুরুত্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে স্থান দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী নতুন করে আন্তর্জাতিক সীমানা প্রণয়নের পর প্রথম সফল মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মাধ্যমেই। বিশ্বজুড়ে যে দেশগুলো অংশগ্রহণমূলক ও গণতান্ত্রিক সমাজ এবং ভূখণ্ডের মধ্যে সব নৃগোষ্ঠী, ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে তাদের জন্য বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ভাষণ আজও প্রাসঙ্গিক।

মঞ্চ ময়দানে তিনি লাখ লাখ মানুষের উদ্বেগী উপস্থিতি, মাথার ওপর উড্ডীন অস্ত্রেশস্ত্রে তাক লাগানো শত্রুবিমানের ধূর্ত মহড়া এবং চমকানো চোখের বৈশ্বিক দৃষ্টির আকর্ষণীয় রশ্মিতে সাহস সঞ্চারিত ভঙ্গিমায় ভীতিহীন এক দুঃসাহসী উপাখ্যান তুলে ধরেন সকলের তরে। যেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও বিদ্রোহী কবি নজরুলের সহস্তে লেখা কোন স্বাধীনতাপত্র পাঠ করছেন বঙ্গবন্ধু। না, রবীন্দ্র-নজরুল কিংবা জীবনানন্দ দাশের মতো আপাদমস্তক কোন কবি নয়; রাজনীতির কবি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার বার্তাবাহী সিংহপুরুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠে অনর্গল উচ্চারিত হয়েছিল একটি কালজয়ী কাব্যকথন। যে পত্রে বর্ণিত হয়েছে বাঙালী জাতির মুক্তিবারতা। যার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি অনুচ্ছেদে ছিল সুপ্ত চেতনায় শাণিত শক্তির বিস্ফোরিত দামামা। বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় এই উপন্যাস যেমন বাতলে দিয়েছিল যুদ্ধপ্রস্তুতি ও যুদ্ধজয়ের নিপুণ নির্দেশনা তেমনি তার তর্জনী ও ইস্পাত কঠিন কথামালা শাসন করেছে বাঙালীর শাশ্বত শত্রু পাকিগোষ্ঠীদের।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মধ্য দিয়ে মার্চ মাসটি বঙ্গ ইতিহাসের অন্যতম সারথী হয়ে যায়। এ মার্চেই যেমন স্বাধীনতার পোক্ত বীজ বপন করা হয়েছিল তেমনি মার্চেই শুরু হয়েছিল স্বাধীনতা চিনিয়ে আনার মহান মুক্তিযুদ্ধ। তখন থেকেই বাঙালী, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে চিরতরে মিশে গেল মার্চ মাসের নাম; যাতে করে বঙ্গবন্ধু পান অমরত্ব আর আমরা পাই স্বাধীনতা। তাই গর্বের সঙ্গেই বলতে হয়, মার্চ মানে স্বাধীনতা, মার্চ মানে বঙ্গবন্ধু।

লেখক: সাংবাদিক

  • সর্বশেষ
  • পঠিত