ঢাকা, রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৬ মিনিট আগে
শিরোনাম

ঢাকার কোয়ারেন্টিনে থাকা দুই উহান-ফেরতের গল্প

  জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২০, ১৮:৪৪  
আপডেট :
 ০৮ মার্চ ২০২০, ১৮:৪৯

ঢাকার কোয়ারেন্টিনে থাকা দুই উহান-ফেরতের গল্প
ফাইল ছবি

করোনাভাইরাস বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার কারণে সব দেশকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার তাগিদ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এই রোগ এখন ১০৩টির বেশি দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে এবং আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ১৯৫ জন।

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছে বাংলাদেশের সরকার। এজন্য ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানে বিশেষ কোয়ারেন্টিন সেন্টার তৈরি করা হয়েছে।

পাশাপাশি আক্রান্ত দেশগুলো থেকে যারা বাংলাদেশ সফরে আসবেন, তাদেরকে দু’সপ্তাহ স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টিনে থাকার পরামর্শ দিয়েছে আইইডিসিআর।

গত পহেলা ফেব্রুয়ারি চীনের উহান থেকে ৩১২জন বাংলাদেশি ফেরত আসেন, তাদের ঢাকার আশকোনা হজ্ব ক্যাম্প ও সিএমএইচের কোয়ারেন্টিনে দুই সপ্তাহ রাখা হয়।

সেখানে তাদের সময়টা কেমন কেটেছে? তা বর্ণনা করেছেন দুইজন বাংলাদেশি নারী। তাদের একজন আশকোনার হজ্ব ক্যাম্পে ছিলেন, আরেকজন ছিলেন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল বা সিএমএইচে। তাদের নাম পরিচয় এখানে প্রকাশ করা হয়নি।

আশকোনা হজ্ব ক্যাম্পে যিনি কোয়ারেন্টিনে ছিলেন:

চীনের উহান থেকে ৩১শে জানুয়ারি আমরা বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হই। সাধারণত আমার বাসা থেকে বিমানবন্দর যেতে আধঘণ্টা সময় লাগে। কিন্তু সেদিন একটু পরপরই আমাদের গাড়ি থামিয়ে চেক করা হচ্ছিল। আমার উহান ছাড়ার অনুমতি আছে কিনা, সেটা দেখা হচ্ছিল। ফলে বিমানবন্দর পর্যন্ত যেতে আমাদের প্রায় আড়াই ঘণ্টা সময় লেগে যায়।

সেখানেও আমাদের আরেক দফা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এরপর আমরা বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হই।

আগেই আমরা জানতাম যে, দেশে ফেরার পর আমাদের কিছুদিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। তাই আমাদের একটা মানসিক প্রস্তুতি ছিল। তা নিয়ে আমাদের কোন আপত্তিও ছিল না। কারণ আমরাও চাই, আমাদের কারণে কোনভাবে রোগটি আমাদের দেশে ছড়িয়ে না পড়ে।

বিমান থেকে নামার পর আমাদের আশকোনার হজ্ব ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।

আরো পড়ুন: করোনা মোকাবিলায় ২ কোটি ডলার সহায়তা দেবে চীন

সেখানে গিয়ে দেখি, মেঝেতে ঢালাওভাবে অনেক বিছানা রাখা হয়েছে। একেকটি কক্ষে প্রায় ৪০ জন করে থাকতে হচ্ছে। আমরা আশা করেছিলাম, আমাদের পরিবারগুলো অন্তত আলাদা রুম পাবে। কিন্তু সেটা হয়নি।

আমার সঙ্গে আমার দুই শিশু সন্তান আর স্বামী ছিলেন। আমাদের মতো এরকম আরো অনেক পরিবার ছিল। প্রথম দিনটি সবাই মিলে সেই গণরুমে একসঙ্গেই থাকা হয়। প্রথম দিনটা একটু কষ্টই লাগছিল। কিন্তু আমরা মেনে নেয়ার চেষ্টা করছিলাম যে, দেশের স্বার্থে সেটা আমাদের মেনে নিতে হবে।

পরেরদিকে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর আমাদের পরিবারগুলোকে একটি কক্ষ দেয়া হলো। সেটাও বড় একটি কক্ষ। আর ব্যাচেলররা ছিলেন আরেকটি কক্ষে।

আমাদের চারজনের জন্য মেঝেতে ম্যাট্রেস দেয়া ছিল। সেগুলো আমরা এক করে নিলাম। সেগুলোকে ঘিরে আমরা সবগুলো পরিবার আলাদা আলাদা ভাবে চাদর ঝুলিয়ে নেয়, ফলে পরিবারের জন্য একটু প্রাইভেসি তৈরি করা হলো। জনপ্রতি একটা করে মেঝেতে বিছানো তোষক, চাদর, বালিশ, কম্বল, মশারি দেয়া হয়েছিল।

তবে হজ্ব ক্যাম্পের গণ টয়লেটগুলোই আমাদের সবাইকে ব্যবহার করতে হতো। সেখানে ছেলে-মেয়ে-শিশু বলে আলাদা কোন ব্যাপার নেই।

তবে খাবার খুব ভালো ছিল। সকালে রুটি, ডিম, কলা দেয়া হতো। এগারোটার দিকে কলা, লেক্সাস বিস্কিট, সিঙ্গারা, পুরি ইত্যাদি নাস্তা দিতো। দুপুরে দিতো মাছ, ডাল, ভাত। কখনো কখনো সবজি থাকতো।

বিকেলে দিতো ড্রাই কেক,কলা। প্রতিদিন রাতের খাবারে থাকতো মুরগির মাংস, ডাল, ভাত। আমাদের রুমের সামনে একটি টেবিলে জনপ্রতি প্যাকেট করা খাবার রেখে যাওয়া হতো। যারযার পরিবারের খাবার সবাই নিয়ে আসতো। পানির জন্য মিনারেল ওয়াটারের বোতল দেয়া হতো।

আরো পড়ুন: বাংলাদেশে করোনা এসেছে যেভাবে​

তবে আমার ছোট ছেলেটার খাবার খেতে একটু কষ্ট হতো। ওরা চীনের খাবারে অভ্যস্ত ছিল, বাংলাদেশের খাবার ঠিকমতো খেতে পারছিল না। টয়লেটেও সমস্যা হতো।

প্রচুর মশা ছিল। সেই মশা মারার জন্য যখন ঔষধ দিতো, সেটাও তাদের জন্য সমস্যা তৈরি করতো। তবে বাচ্চাদের সঙ্গীর অভাব ছিল না। একটি কক্ষে অনেক বাচ্চা একসঙ্গে থাকায় তারা বেশ হৈচৈ করে সময় কাটাতো। উহানে থাকার কারণে তারা অনেকে একে অপরকে চিনতোও।

তবে আমাদের কোন জিনিসের দরকার হলে, টাকা দিয়ে সেটা বাইরে থেকে কিনে আনানো যেতো। সকাল ১১টার মধ্যে টাকা জমা দেয়া হলে, সেটা বাইরে থেকে কিনে এনে দেয়া হতো। আমরাও টুকটাক জিনিসপত্র কিনে আনিয়েছিলাম।

কিন্তু আমি ও আমার স্বামী মানসিকভাবে একেবারেই ভালো ছিলাম না। বাচ্চাদের নিয়ে চিন্তা করতে হতো, মশার কামড় - পরিবেশটাও ততটা ভালো লাগতো না। এককথায় বলা যায়, মানসিকভাবে খারাপই ছিলাম।

আরো পড়ুন: দেশে করোনা: স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার মতো পরিস্থিতি হয়নি

১৪ দিন যখন শেষ হলো, তখন মনে হলো সবাই যেন একটা রিলিফ পেলাম। ১৫ই ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার দিকে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে সরাসরি গ্রামের বাড়িতে চলে যাই।

এরপরে কয়েকবার ঢাকা থেকে ফোন করে আমাদের খোঁজখবর নেয়া হয়েছে। কোন অসুস্থতা আছে কিনা, কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা জানতে চাওয়া হয়েছে।

সিএমএইচ-এ কোয়ারেন্টিনে থাকা একজনের গল্প

উহানেও আমরা অনেকটা কোয়ারেন্টিনের মধ্যে ছিলাম। কারণ সেখানে সবাইকে যার যার বাসায় থাকতে বলা হয়েছিল। কেউ বাইরে বের হতাম না। মাঝে মাঝে স্বাস্থ্যকর্মীরা এসে পরীক্ষা করে যেতেন, কারো জ্বরজারি হয়েছে কি না। সবাই সুস্থ আছে কি না।

আরো পড়ুন: চীনে করোনা ভাইরাস, যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র

পহেলা ফেব্রুয়ারি আমরা বাংলাদেশে আসার পরেই আমাদের সরাসরি আশকোনার হজ্ব ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর ঢালাও বিছানা- পরিবেশ দেশে সত্যিই আমাদের মন খারাপ হলো। কোয়ারেন্টিন মানেতো প্রত্যেককে আলাদা করে রাখার কথা। কিন্তু এখানে গণরুমের মতো একেকটি কক্ষে একসঙ্গে অনেকের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একজনের রোগ থাকলে সেটা তো অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়বে।

খাবার-দাবার, আয়োজন ভালো। কিন্তু পরিবার নিয়ে এতোবড় গণরুমে, এতো মানুষের মধ্যে মেঝেতে বিছানো তোষকে করে ঘুমানো- সব মিলিয়ে পরিবেশটা আমার খারাপ লাগছিল।

সেখানে একরাত থাকার পর, আমরা আপত্তি জানাই।

এরপর আমাদেরসহ আরো কয়েকটি পরিবারকে সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হাসপাতালের একটি কক্ষে আমাকে ও আমার দুই সন্তানকে থাকতে দেয়া হয়।

আরো পড়ুন: করোনায় করণীয়​

এখানকার পরিবেশ সত্যিই ভালো ছিল। ছোট কক্ষটিতে দুইটি খাট, ছোট্ট একটা টেবিল ছিল। দুইটি খাট একত্র করে আমি ও আমার দুই সন্তান পরের দুই সপ্তাহ সেখানে থাকি।

তবে টয়লেট বাইরে ছিল। পাশের আরেকটা কক্ষে আমাদের মতোই আরেকটা পরিবার থাকতো।

আমার বড় মেয়েটির বয়স দশ বছর। ও খানিকটা অস্থির হয়ে পড়ছিল। কারণ এরকম একটি কক্ষে এভাবে আটকা থাকা কারোই ভালো লাগছিল না। রুমে কোন টিভি না থাকলেও ওয়াইফাই সুবিধা ছিল। এছাড়া টেলিফোনে আমার স্বামীর সঙ্গে (তিনি বাংলাদেশেই ছিলেন), আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে নিয়মিত কথা হতো।

আরো পড়ুন: করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচতে যা করবেন

তবে প্রথম সাতদিন আমরা রুমের বাইরেই বের হয়নি। তাদেরও হয়তো একটা ধারণা ছিল যে, আমরা সবাই হয়তো আক্রান্ত। সপ্তাহখানেক পর আমার মেয়েটা করিডরে স্কেটিং করতো।

তারা পাঁচবেলা খাবার দিতো। সকালে থাকতো পাউরুটি, বাটার, জেলি, জুস, ডিম ইত্যাদি। এগারোটার দিকে এককাপ করে দুধ, কোনদিন সেমাই, কমলা দিতো। দুপুরে মাংস, ডাল, ভাত থাকতো। বিকালে দেয়া হতো বিস্কিট চা। রাতে একবাটি করে সবজি, মাছ অথবা মাংস দিতো। অনেক সময় কলিজা থাকতো। সেই সঙ্গে থাকতো ভাত আর ডাল।

কেউ কোন ক্রুটি করেনি। কিন্তু আমার মানসিক অনেক চাপ গেছে। ওই সময়ে আসলে দরকার ছিল কেউ আমার বাচ্চাদের দেখবে, আমার একটু রেস্ট হবে। কিন্তু সেটা হয়নি। সবসময় সবার সঙ্গে কথা হতো, কিন্তু বাইরে আসার যে আকুতি, সেটা কমেনি।

আরো পড়ুন: চীনে করোনা ছড়িয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ!​

যেদিন আসার কথা, সেদিন আবার আমাদের আশকোনায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটা অনুষ্ঠান করে আমাদের একটা মেডিকেল সার্টিফিকেট দেয়া হয়, কিছু উপহার দেয়া হয়।

বলা হয়েছিল, পরের দশদিনও আমাদের নজরদারিতে রাখা হবে। তবে পরে আর আমাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়নি। তবে ওনাদের ফোন নম্বর দিয়ে দিয়েছিলেন। যাতে আমাদের কারো দরকার হলে তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারি।

আরো পড়ুন: বাংলাদেশে করোনা, তিন রোগী শনাক্ত​

তবে আমি যে কয়েকদিন ছিলাম, আমি চেষ্টা করেছি সেখানে থাকার। কারণ এটা আমার দেশের জন্য, আত্মীয়স্বজনের জন্য সবার স্বার্থেই ভালো। আমার কষ্ট হলেও সেখান থেকে বেরিয়ে আসার কথা মনে হয়নি। সূত্র: বিবিসি বাংলা।

বাংলাদেশ জার্নাল/এইচকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত