ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

করোনা-বন্যায় অস্তিত্ব সঙ্কটে টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্প

  টাঙ্গাইল প্রতিনিধি

প্রকাশ : ২২ আগস্ট ২০২০, ২১:৪০  
আপডেট :
 ২২ আগস্ট ২০২০, ২২:১২

করোনা-বন্যায় অস্তিত্ব সঙ্কটে টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্প

টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পের সাথে জুড়ে আছ দেশের ঐতিহ্যের সুনাম। কিন্তু করোনা আর বন্যায় চরম অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প। ইতোমধ্যেই এ শিল্পের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে তাঁত বোর্ডের দেয়া ক্ষুদ্র ঋণ তাঁতিদের ভাগ্য উন্নয়নে তেমন কোন প্রভাব ফেলছে না। এ শিল্প রক্ষায় সুদমুক্ত ঋণসহ বাজার সৃষ্টিতে সরকারি ভূমিকা প্রত্যাশা করেছে সংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়, টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারের জন্য বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের দুইটি বেসিক সেন্টার রয়েছে। জেলার ঘাটাইল, মধুপুর, ধনবাড়ী, গোপালপুর, কালিহাতী ও ভূঞাপুর উপজেলার জন্য কালিহাতীর বল্লায় একটি আর দেলদুয়ার, বাসাইল, মির্জাপুর, নাগরপুর, সখীপুরসহ সদর উপজেলার জন্য বাজিতপুরে রয়েছে একটি বেসিক সেন্টার। বাতাঁবো’র বাজিতপুর ও বল্লা এ দুইটি বেসিক সেন্টারের ৪৯টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতি আর ৪টি মাধ্যমিক তাঁতি সমিতি রয়েছে। এসব সমিতির চার হাজার ৩৯১টি তাঁত ফ্যাক্টরি মালিকের ২৭ হাজার ৯৩১টি তাঁত চালু বা সচল এবং দুই হাজার ৬৭৩টি তাঁত আগে থেকেই বন্ধ বা অচালু রয়েছে।

করোনার কারণে গত ২৬ মার্চ থেকে সরকারি নির্দেশনায় কল-কারখানা-ফ্যাক্টরি বন্ধ ঘোষণা করায় চালু তাঁত ফ্যাক্টরিগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে জেলার তাঁতশিল্পে প্রতিদিন গড়ে এক কোটি ৮৭ লাখ ৫৬ হাজার ৪০০ টাকা ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে থাকে।

করোনা মহামারীর সঙ্গে বন্যার করাল থাবা জেলার এই তাঁতশিল্পকে চরম অস্তিত্ব সঙ্কটে ফেলেছে। করোনায় বন্ধ হয়ে যাওয়া ফ্যাক্টরিতে তাঁত মালিকদের বিনিয়োগ বিনষ্ট হচ্ছিল। এর সঙ্গে বন্যার পানি এসে ফ্যাক্টরিতে চালু তাঁত, তাঁতে থাকা সুতার ভিম, কাপড় ও সরঞ্জামাদী প্রায় সবই বিনষ্ট হয়েছে। এর ফলে পরিবর্তী পরিস্থিতিতে তাঁতশিল্পের ঘুরে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে।

বাতাঁবো’র টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বাজিতপুর বেসিক সেন্টার সূত্রে জানা যায়, এ সেন্টারের ৩২টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতি ও তিনটি মাধ্যমিক সমিতির দুই হাজার ২৬৭ তাঁত মালিকের মোট ১২ হাজার ৪২৯টি তাঁত রয়েছে। এর মধ্যে দুই হাজার ৬৭৩টি তাঁত আগে থেকেই বন্ধ বা অচল এবং ৯ হাজার ৭৫৬টি তাঁত চালু ছিল। এ বেসিক সেন্টারের তাঁতগুলোতে মিহি সুতার ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরি হয়। হিসাব অনুযায়ী করোনা মহামারির কারণে সরকারি নির্দেশনা মেনে বন্ধ রাখা প্রতি তাঁতে ৮০০ টাকা হারে প্রতিদিন গড়ে ৭৮ লাখ ৪ হাজার ৮০০ টাকা ক্ষতি হচ্ছে।

কালিহাতী উপজেলার বল্লা বেসিক সেন্টারের তথ্যমতে, এ সেন্টারের ১৭টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতি ও একটি মাধ্যমিক তাঁতি সমিতির অধীনে দুই হাজার ১২৪টি তাঁত ফ্যাক্টরি মালিকের ১৮ হাজার ১৭৫টি তাঁত রয়েছে। এ বেসিক সেন্টারের তাঁতগুলোতে অপেক্ষাকৃত মোটা সুতার শাড়ি উৎপাদিত হয়ে থাকে।

বেসিক সেন্টারের হিসাব মতে, গত মার্চের ২৬ তারিখ থেকে করোনার কারণে ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকায় প্রতিটি তাঁতে দৈনিক ন্যূনতম ৬০০ টাকা হারে প্রতিদিন গড়ে এক কোটি ৯ লাখ ৫ হাজার টাকা করে ক্ষতি হচ্ছে। দুটি বেসিক সেন্টারের অধীনে তাঁত ফ্যাক্টরিগুলো সে হিসেবে করোনার কারণে বন্ধ থাকায় প্রতিদিন গড়ে এক কোটি ৮৭ লাখ ৯ হাজার ৮০০ টাকা করে ক্ষতির শিকার হচ্ছে।

গত ২৬ মার্চ থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত করোনায় টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পে ২৫৬ কোটি ৩২ লাখ ৪২ হাজার ৬০০ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে নয়া দুর্যোগ হিসেবে সাম্প্রতিক বন্যা তাঁতশিল্পে হানা দিয়েছে। বন্যা তাঁতশিল্পের তাঁত, কাপড়, তানা ও সরঞ্জামাদীসহ সবকিছু ভাসিয়ে দিয়েছে। প্রায় দেড় মাস পানি থাকায় তাঁতশিল্পের কাঁচামাল নষ্ট হচ্ছে।

টাঙ্গাইলের তাঁত মালিক, শ্রমিক, বেসিক সেন্টারের কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনা মহামারীর সাথে বন্যার দুর্যোগ যোগ হয়ে টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে। শাড়ি ব্যবসার জন্য পয়লা বৈশাখ, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা ও দুর্গাপুজা প্রধান মৌসুম। পয়লা বৈশাখে কোনো শাড়ি বিক্রি হয়নি। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার জন্য নতুন শাড়ি বানানো হয়নি। উৎসবের জন্য যেসব শাড়ি আগেই তৈরি করে মজুদ করা ছিল সেগুলোও বিক্রি হয়নি।

বৈশাখে শাড়ি তৈরিতে ১০৭ কোটি ১৩ লাখ ৬০ হাজার টাকার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। শাড়িপ্রতি গড়ে ১০০ টাকা লাভে বিক্রি হলে ৮ কোটি ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকার মতো লাভ হতো। ঈদুল ফিতরে সবচেয়ে দামি শাড়ি তৈরি ও বেশি শাড়ি বিক্রি হয়। ঈদুল ফিতরে শাড়ি উৎপাদনে কোন লক্ষ্যমাত্রাই নির্ধারণ করা হয়নি। একই অবস্থা ছিল ঈদুল আযহায়। আগামি দুর্গাপুজায়ও একই অবস্থা বিরাজ করার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে কেউ কেউ পৈত্রিক পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় গিয়েও তেমন সুবিধা করতে না পেরে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। তাঁতিদের ধারণা, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় লাভ-লোকসান তো পরের হিসাব, এ শিল্পের অস্তিত্ব নিয়েই তারা শঙ্কিত।

টাঙ্গাইল শাড়ির রাজধানী পাথরাইলের শাড়ি প্রস্তুতকারক ও ব্যবসায়ী নীল কমল বসাক বলেন, করোনা ও বন্যা তাঁতশিল্পের মহাক্ষতি করেছে। সরকারি প্রণোদনা প্রদানের পাশাপাশি তাঁত শাড়ির বাজার তৈরিতেও সরকারের ভূমিকা প্রত্যাশা করেন তিনি।

টাঙ্গাইল জেলা তাঁতিলীগের সহ-সভাপতি কালাচাঁদ বসাক বলেন, করোনা মহামারী ও বন্যায় ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপাদন অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ শিল্প আদৌ থাকবে কি-না সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সুদমুক্ত ঋণ ও সরকারি প্রণোদনা না পেলে তাঁতিরা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।

টাঙ্গাইল শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোং এর মালিক রঘুনাথ বসাক বলেন, করোনা মহামারী ও বন্যার ভয়াবহ দুর্যোগে জেলার তাঁত শিল্পে স্থবিরতা নেমে এসেছে। সুদমুক্ত ঋণ, প্রণোদনার পাশাপাশি সরকারের কাছে পাঁচ দফা সুপারিশনামা উপস্থাপন করেন তিনি।

সুপারিশনামায় রয়েছে, শাড়ির নতুন নতুন বাজার তৈরি করা, সুদমুক্ত ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা, বিদেশ থেকে শাড়ি আমদানি বন্ধ করা, দেশি পণ্য বিশেষ করে সালোয়ার-কামিজের পরিবর্তে শাড়ি ব্যবহারে উৎসাহিত করা, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিণ্ট মিডিয়ায় দেশীয় শাড়ি ব্যবহারে জনমত তৈরি করা ইত্যাদি।

টাঙ্গাইল সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোফাখখারুল ইসলাম বলেন, করোনা মহামারীর সাথে বন্যার ভয়াবহতা যোগ হয়ে জেলার তাঁতশিল্পকে চরম অস্তিত্ব সঙ্কতে ফেলেছে। গত ২৬ মার্চ থেকে জেলার সব তাঁত ফ্যাক্টরি বন্ধ। তাঁত মালিক ও এর সাথে জড়িত প্রায় দেড় লাখ মানুষ কর্মহীন অবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। যারা একসময় দান-অনুদান বিতরণ করেছেন, তারাও এখন নিজেদের পরিবারের মৌলিক চাহিদা পুরণ করতে পারছে না। করোনা শুরু হওয়ার আগে তাঁতিদের উৎপাদিত পণ্য ঘরে থেকে বিনষ্ট হচ্ছে, কোথাও বিক্রি হচ্ছে না। সুদমুক্ত ঋণ ও সরকারি প্রণোদনা ব্যতিত এ সঙ্কট থেকে তাঁতিদের মুক্তির পথ নেই।

বাতাঁবো’র কালিহাতী বল্লা বেসিক সেন্টারের লিয়াজো অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) ইমরানুল হক বলেন, এ অঞ্চলের তাঁতিরা সাধারণত তুলনামূলক মোটা সুতায় তৈরি শাড়ি উৎপাদন করে থাকে। করোনার সাথে বন্যা যোগ হয়ে এ শিল্পে মহাদুর্যোগ সৃষ্টি করেছে। ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকায় একদিকে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, অপরদিকে প্রতিটি তাঁতি পরিবারে অর্থাভাব দেখা দিয়েছে। তারা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁতিদের মাঝে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করছেন। কিন্তু তা এই মুহূর্তে তাঁতিদের উল্লেখযোগ্য উপকারে আসছে না। তিনি তাঁতিদের প্রণোদনা দেয়ার জন্য জেলা প্রশাসনে তালিকা পাঠিয়েছেন।

টাঙ্গাইল সদরের বাজিতপুর বেসিক সেন্টারের লিয়াজো অফিসার রবিউল ইসলাম জানান, তারা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁতিদের মাত্র ৫% সার্ভিস চার্জে ক্ষুদ্রঋণ দিচ্ছেন। সরকারি নির্দেশনার বাইরে তাদের কাজ করার সুযোগ নেই। শাড়ি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ কিংবা নতুন বাজার সৃষ্টিতে তাঁতিদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে।

তিনি জানান, মূলত করোনা ও বন্যায় তাঁতশিল্পকে ধসের মুখে ফেলেছে। বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারলেও করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে এ শিল্প মহাসঙ্কটে পড়বে এমনটাই শঙ্কা করছেন তিনি।

এ বিষয়ে তাঁতি লীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী সভাপতি সাধনা চন্দ্র গুপ্তা বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, করোনার কারণে তাঁত শিল্পের অবস্থা ভালো নয়। তাদের সহায়তা করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

তাঁতি লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক খগেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, আমরা তাঁত শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করছি। তাঁত ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা/আর্থিক সহায়তার জন্য বস্ত্রমন্ত্রীকে ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিহিত করেছি। শুধু টাঙ্গাইলেই নয়, সিরাজগঞ্জ, পাবনাসহ সারাদেশের তাঁতশিল্প যেন আর্থিক সহায়তা পায়, সেজন্য আমরা কাজ করছি।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত