ঢাকা, শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২০ মিনিট আগে
শিরোনাম

চট্টগ্রামের ৬১ বধ্যভূমির নেই কোনও স্মৃতিচিহ্ন!

  চট্টগ্রাম প্রতিনিধি

প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:৪৭

চট্টগ্রামের ৬১ বধ্যভূমির নেই কোনও স্মৃতিচিহ্ন!
ছবি: প্রতিনিধি

সত্তরের নির্বাচনে জয়ী তৎকালীন পূর্ব বাংলার প্রিয়মুখ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জনস্রোতে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়— তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।’ তার সেই বক্তব্যের অনুপ্রেরণায় সাত কোটি বাঙালি একত্রিত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ চাইলো।

এর পরপরই পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর হামলা চালায়, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হয় জেলে। তারই নির্দেশ ও পরিকল্পনা অনুযায়ী পরবর্তীতে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়। এ ঘোষণায় সমগ্র পূর্ব বাংলার সর্বসাধারণ নেমে পড়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে।

দীর্ঘ নয় মাসের সেই যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হন, সম্ভ্রম হারান দুই লাখ মা-বোন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গণকবর রচনা হয় চট্টগ্রামে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও চট্টগ্রামের অধিকাংশ বধ্যভূমি অরক্ষিত রয়ে গেছে। এছাড়া এই বাণিজ্যিক নগরীতে হয়নি কোনো স্মৃতিসৌধ।

জানা যায়, নগরীর ৬১টি বধ্যভূমির মধ্যে পাহাড়তলীতে ১৫টি, লালখান বাজারে ৬, হালিশহরে ৫, গোসাইলডাঙ্গায় ৫, আন্দরকিল্লায় ৪, বাকলিয়ায় ৩, রহমতগঞ্জে ২, কাট্টলীতে ২, পতেঙ্গায় ২, বন্দর এলাকায় ২, কাটগড়ে ২, মুরাদপুরে ২, নাসিরাবাদে ২, মাদারবাড়িতে ২, পাঁচলাইশে ২টি এবং চন্দনপুরা, জয়পাহাড়, চান্দগাঁও, ষোলোশহর ও রামপুরায় একটি করে রয়েছে।

এর মধ্যে পূর্ব পাহাড়তলী ও হালিশহর মধ্যম নাথপাড়া এলাকায় বধ্যভূমিতে স্মৃতিচিহ্ন আছে। বাকিগুলোর কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। তবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পেছনের বধ্যভূমিতে স্মৃতিচিহ্ন নির্মাণ করতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)।

উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বধ্যভূমি হলো−মহামায়া ডালিম হোটেল বধ্যভূমি, গুডসহিল বধ্যভূমি, পশ্চিম পাহাড়তলী বধ্যভূমি, দক্ষিণ বাকলিয়া মোজাহের উলুম মাদরাসা বধ্যভূমি, চাক্তাই খালপাড় বধ্যভূমি, চামড়ার গুদাম চাক্তাই খাল পাড় বধ্যভূমি, তুলশি ধাম সেবায়েত মন্দির বধ্যভূমি, হাইওয়ে প্লাজা ভবন বধ্যভূমি, বাটালী পাহাড়ের রেলওয়ে বাংলো বধ্যভূমি, পাঁচলাইশ সড়কের আল বদর বাহিনী ক্যাম্প বধ্যভূমি, চট্টগ্রাম জেনারেল পোস্ট অফিস বধ্যভূমি, সিআরবি নির্যাতন কেন্দ্র বধ্যভূমি, চন্দনপুরা রাজাকার ক্যাম্প বধ্যভূমি, সার্কিট হাউজ বধ্যভূমি, বন্দর আর্মি ক্যাম্প বধ্যভূমি, রেলওয়ে ওয়ার্কশপ বধ্যভূমি, প্রবর্তক সংঘের পাহাড় বধ্যভূমি, সদরঘাট রাজাকার ক্যাম্প বধ্যভূমি ও ঝাউতলা বিহারী কলোনি বধ্যভূমি।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও ইতিহাস সংরক্ষণে নিজের ভূমিকা সম্পর্কে ড. গাজী সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘ফয়েস লেকের পাহাড়ের উপরে একজন পাকিস্তানি আর্মি ক্যাপ্টেনের বাংলো ছিল। সেখানে যুদ্ধের সময় এমন কোনো নৃশংসতা নেই যে, হয়নি। পরে এটি কনকর্ডের পার্ক হয়। এরপর ১৯৯৮ সালে রায়েরবাজর বধ্যভূমি ও পাহাড়তলী বধভূমির জন্য জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে সব কাজের বাজেট হয়। কিন্তু সেখানেও একটি পক্ষ জমি দখল করে। ওটা নিয়ে আমি মামলা করার কারণেই এখন পর্যন্ত তাদের কাজ আটকে আছে। এছাড়াও চট্টগ্রামের সব বধ্যভূমি অনেক কষ্ট করে খুঁজে সেই স্থানের বিবরণ ও তার ইতিহাস নিয়ে একটি বই লিখে, সেটিও নিজের পয়সায় ছাপাতে হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বধ্যভূমি সংরক্ষণ নিয়ে কারো কোনো তাগিদ না থাকায় এ কাজ আটকে আছে। আমি কতটুকুই বা পারি! আসলে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা যতদিন নিরসন না হবে, ততদিন এসবের কিছুই হবে না।’

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিট কমান্ডার মোজাফ্ফর আহমেদ বলেন, ‘দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার এত বছর পরও চট্টগ্রামে কোনও বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা হয়নি। আমরা অসংখ্য চিঠি চালাচালি করেছি। বধ্যভূমি সংরক্ষণের দাবিতে অনেক মিছিল-মিটিং করেছি। প্রশাসনকে বধ্যভূমির তালিকা দিয়েছি। যখন তালিকা দিই তখন একটু তোড়জোড় শুরু হয়। এরপর আবার থেমে যায়। বধ্যভূমি সংরক্ষণের প্রশাসনের তেমন কোনও আগ্রহ নেই। বধ্যভূমি হোক আমলারা এটা চায় না। প্রশাসনের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী না, এমন কিছু আমলা ঘাপটি মেরে আছে। এ কারণে বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা হচ্ছে না।’

চট্টগ্রামে মোট ১১১টি বধ্যভূমি রয়েছে। তারমধ্যে নগরীতে রয়েছে ৬১টি। বাকি ৫০টি রয়েছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায়।

জানা গেছে, উপজেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমিটি হচ্ছে মিরসরাই রেলস্টেশন সড়কের লোহারপুল এলাকায়। স্বাধীনতার ৪৯ বছরে এই বৃহত্তম বধ্যভূমি এলাকায় চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের উদ্যোগে তিন লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ।

বর্তমানে দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিরসরাই রেলস্টেশনের লোহার পুল। এখানে হানাদাররা মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে লাইন দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে নৃশংসভাবে হত্যা করত। পরে নিচের খালে ভাসিয়ে দেয়া হতো নিরীহ গ্রামবাসী ও মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ।

এ ছাড়া করেরহাটের পাহাড়িয়া লোহারপুল, করেরহাটের ফেনী নদীর পার, হিঙ্গুলী সেতু সংলগ্ন, মিরসরাই সদরের অছি মিয়ার পুল, হিঙ্গুলী কোর্টের পাড়, ছুটি খাঁ দিঘির পাড়, মস্তাননগর হাসপাতাল, ঝুলনপোলসহ অর্ধশতাধিক স্থানে নিরীহ মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে গণকবর দেয়া হয়। মিরসরাই রেলস্টেশন এলাকার একটি জমিতে শতাধিক লোককে একই স্থানে কবর দেওয়া হয়।

জানা যায়, হিঙ্গুলী ব্রীজের উত্তর পাশের বধ্যভূমিতে নুরুল হুদা মেম্বার, মিয়া সওদাগর, মুন্সি মিয়া, আমিন মিয়া, আবু তাহের, আবুল কালাম ও তার ভাই সিদ্দিক আহম্মদ, মকবুল আহম্মদ, সাবিদ আলী, খায়েজ আহম্মদ, নুর আহম্মদ, হোরা মিয়া, দলিলুর রহমান, সিদ্দিক আহম্মদ, উপেন্দ্র বাবুসহ অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে হানাদার বাহিনী হত্যা করে। পার্শ্ববর্তী হিঙ্গুলী কোর্টের পাড় ও জামালপুর বধ্যভূমিতে অর্ধশতাধিক লোককে হত্যা করে ফেলে দেয়া হয়।

মিরসরাই উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার কবির আহম্মদ জানান, ‘চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ বরাবরে একটি তালিকা পাঠানো হয়েছে। সরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়া হলে বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা যাবে। যাঁরা দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে গেছেন তাদের শেষ স্মৃতিটুকু রক্ষা করা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব।’

বাংলাদেশ জার্নাল/ওএফ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত