ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৭ মিনিট আগে
শিরোনাম

‘ওরা আমার যৌনাঙ্গ পুড়িয়ে দিয়েছে’

  মৌলভীবাজার প্রতিনিধি

প্রকাশ : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৮:৫৬

‘ওরা আমার যৌনাঙ্গ পুড়িয়ে দিয়েছে’

সৌদি আরব থেকে ফিরে নিজের ওপর রোমহর্ষক নৃশংস নির্যাতনের বর্ণনা দিলেন মৌলভীবাজারের এক তরুণী। নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে মূর্ছা যান ওই তরুণী। মানসিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। তার গোপনাঙ্গসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে বলেও জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে কাজে গিয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হন ২২ এ বছর বয়সী এক বাংলাদেশি নারী। পরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বাড়ি ফিরেছেন তিনি। তার বাড়ি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী বনগাঁও গ্রামে। অর্থের অভাবে তার চিকিৎসা করাতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন স্বজনরা। সৌদি আরবে নির্যাতনের বিবরণ শুনলে গা শিউরে উঠে।

গত ২৬ নভেম্বর এই নারী সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরেন। দুই দিন পর ২৮ নভেম্বর শ্রীমঙ্গলের মুক্তি মেডিকেয়ার প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। অর্থের অভাবে ভালোভাবে চিকিৎসা করতে না পেরে ০১ ডিসেম্বর বিকালে ছাড়পত্র না নিয়েই বাড়ি চলে যান তার পরিবারের সদস্যরা।

মুক্তি মেডিকেয়ার প্রাইভেট হাসপাতালের সেবক পংকজ তালুকদার জানান, ‘চিকিৎসক সাধন চন্দ্র ঘোষ ও প্রধান সেবিকা দীপ্তি দেব ওই নারীকে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। তিনি হাসপাতালে ভর্তির সময়ই মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন।’

তবে চিকিৎসক সাধন চন্দ্র ঘোষ ও প্রধান সেবিকা দীপ্তি দেব জানান, ওই নারীর যৌনাঙ্গসহ পোড়া ও আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ক্ষতগুলো সারতে একটু সময় লাগবে। শারীরিক নির্যাতনে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাকে মানসিক চিকিৎসাও দেওয়া প্রয়োজন।

নির্যাতিত নারীর স্বামী জানান, ‘সরকারের সহায়তায় গত ২৬ নভেম্বর আমার স্ত্রী দেশে ফিরে এসেছে। বাড়ি ফেরার পর নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এরপর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছে আধমরা হয়ে। টাকা রোজগারের আশায় গেল, একটি টাকাও দেশে পাঠাতে পারেনি। এখন প্রাণ নিয়েই টানাটানি।’

তিনি আরও জানান, ‘গত বছর আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের ৭-৮ মাস পর স্থানীয় দালাল মোস্তফা কামালের প্রলোভনে চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল সৌদি আরবে পাড়ি দেয় আমার স্ত্রী। নেওয়ার সময় দালাল বলেছিল গৃহকর্মীর কাজের ভিসা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সৌদি আরবের দাম্মামে পৌঁছানোর পর একপর্যায়ে আমার স্ত্রী জানতে পারে ৩-৪ লাখ টাকায় তাকে যৌনকর্মী হিসেবে বিক্রি করা হয়েছে। যৌনকর্মীর কাজে রাজি না হলে তার ওপর চালানো হয় নানাভাবে নির্যাতন। তাকে একটি কক্ষে আটকে রেখে প্রতিদিন চালানো হতো যৌন নির্যাতন। জ¦লন্ত সিগারেট দিয়ে শরীরে ছ্যাঁকা দিয়েছে। পিটিয়ে হাত-পা ও উরু জখম করেছে। প্রতিদিন দলবেঁধে ৪/৫ জন মিলে ধর্ষণ করেছে। নির্যাতনের সময় সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতো। একপর্যায়ে সৌদি আরবের পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আদম ব্যবসায়ী মোস্তফাকে বিষয়টি জানালে সে মিথ্যা কথা বলে উড়িয়ে দেয়। পরে কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। সরকারের চেষ্টায় ছয় মাস ২৬ দিন পর দেশে ফেরে আমার স্ত্রী। আমি বাঁশের কাজ করি, অভাব-অনটনে সংসার চলছিল। দালাল মোস্তফা তখন আমার স্ত্রীকে বিদেশে পাঠানোর প্রস্তব দেয়। প্রথমে রাজি না হলে পরে অন্যান্য দালাল দিয়ে বহু টাকা আয়ের লোভ দেখায়। মোস্তফা জানায়, নিজের মেয়ে পরিচয়ে বিদেশে পাঠাবে, সেখানে সে যত্নে থাকবে, পাসপোর্ট-ভিসা সব করে দেওয়া হবে, কোনও টাকা লাগবে না। একপর্যায়ে এসব প্রলোভনে রাজি হই। বিদেশ যাওয়ার পর প্রথম কয়েকদিন যোগাযোগ করে। পরে আমার স্ত্রী আর যোগাযোগ করতে পারেনি।’

তরুণীর ভাষ্যমতে, ‘জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে আমার বুক, গোপনাঙ্গ ও শরীরের বিভিন্ন জায়গা ওরা পুড়িয়ে দিয়েছে। তার দিয়ে বেঁধে পিটিয়ে হাত-পা ও উরুতে জখম করে দিয়েছে। দলবেঁধে ৪/৫ জন মিলে ধর্ষণ করত, তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলতাম।’

এ বিষয়ে কথা বলতে দালাল মোস্তফা কামালের বাড়িতে গেলে তার পরিবার জানায় সে বাড়িতে নেই। মোস্তফা ফোন নম্বরও দিতে রাজি হয়নি তারা।

ওই নারীর বাবা জানান- ‘বারবার দালাল মোস্তফা কামালের কাছে আমার মেয়ের খবর নিতে গিয়েছি। মোস্তফা বলেছে আমার মেয়ে সৌদি আরবে কারাগারে আছে।’

কমলগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশেকুল হক বলেন- ‘বিদেশে পাঠানোর কাছে মোস্তফা নামের একজন ইউপি সদস্য জড়িত বলে পরিবারের অভিযোগ। ঘটনা প্রমাণিত হলে আমরা বিভাগীয় ব্যবস্থা নিবো। আর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মামলার প্রস্তুতি চলছে। এর আগে সৌদি ফেরত নারীকে আমরা সুস্থ করতে চাচ্ছি।’

ইউএনও আরও বলেন- ‘বর্তমানে চিকিৎসার খরচ আমরাই বহন করছি। উপজেলা স্বাস্থ্য ও প: প: কর্মকর্তার নেতৃত্বে গৃহবধুর চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা আমি নিজেই করবো।’

প্রসঙ্গত, গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সৌদি আরবে গিয়ে বাংলাদেশের নারীদের নির্যাতনের শিকার হওয়ার খবর আসছে গত কয়েক বছর ধরেই। এ বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে ৮৫০ জন নারী দেশে ফিরে যৌন নিপীড়নসহ নানা অভিযোগের কথা তুলে ধরায় অধিকার সংগঠনগুলোও সরব হয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে সৌদি আরবে বাংলাদেশি নারী শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন বন্ধে পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে যৌথভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলেছে সংসদীয় কমিটি।

  • সর্বশেষ
  • পঠিত