ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

শিক্ষকদের রঙের রাজনীতি কাদের স্বার্থে?

শিক্ষকদের রঙের রাজনীতি কাদের স্বার্থে?
ফাইল ফটো

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের দলভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে সমালোচনা দীর্ঘদিনের। বলা হচ্ছে, শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের যে আধিপত্যের রাজনীতি, শিক্ষক প্রশাসন সেখানে এর বিপরীতে অবস্থান না নিয়ে বরং অনেকক্ষেত্রেই সহযোগীর ভূমিকা নিয়ে থাকে।

ভিসিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পেতে কিংবা পদ ঠিক রাখতে শিক্ষকরা আরো বেশি করে রাজনীতিতে জড়াচ্ছেন। কিন্তু শিক্ষকদের এভাবে রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখছে না। বরং শিক্ষার পরিবেশে আরো নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ৩টি দল; সাদা, নীল আর গোলাপী। এই তিনটি দল তিন ধরনেরর রাজনৈতিক আদর্শ অনুসরন করে থাকে। সাদা দলের ব্যানারে যেসব শিক্ষক রয়েছেন তারা বিএনপি পন্থী, নীল দল আওয়ামী পন্থী এবং গোলাপী দল বামপন্থী হিসেবেই পরিচিত।

বাংলাদেশের বড় বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকরা এভাবেই বিভিন্ন নামে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে রাজনীতি করে থাকেন। এতদিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে নানা সমালোচনা হলেও এখন শিক্ষকদের রাজনীতি নিয়েও সমালোচনা সমালোচনা হচ্ছে। মনে করা হচ্ছে, বুয়েটে আবরার হত্যাকাণ্ড এবং এর পেছনে ছাত্রলীগের যে আধিপত্যের রাজনীতি এজন্য সেখানকার শিক্ষক প্রশাসনেরও দায় আছে। বুয়েটের শিক্ষকরা ইতোমধ্যেই শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের ঘোষণা দিলেও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এর কোন প্রভাব নেই।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক রাজনীতি কার স্বার্থে সেই প্রশ্ন এখন নতুন করে উঠছে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও।

তানজিল নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলছেন, ছাত্রনেতাদের মতো শিক্ষকরাও প্রশাসনিক পদ-পদবি পাওয়ার জন্যই রাজনীতি করেন বলে তার কাছে মনে হয়। তার মতে, শিক্ষক রাজনীতি শিক্ষার্থীদের আসলে কোন কাজে আসে না।

তিনি বলেন, ‘স্যারেরা তো এখন শিক্ষার্থীদের পক্ষে কোন কথা বলেন না, শিক্ষার্থীদের পাশেও থাকেন না।’

বাংলাদেশে সাধারনতঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন। আর শিক্ষক প্রশাসনও নিয়ন্ত্রণে থাকে সরকারি দলের অনুগত শিক্ষকদের হাতে। গত প্রায় তিন দশক ধরেই ঘুরে ফিরে এ চিত্রই দেখা যাচ্ছে।

বলা হয়ে থাকে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই ভিসি, প্রো-ভিসি, প্রক্টরসহ সকল প্রশাসনিক পদ এক ধরণের ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যায় ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী শিক্ষকদের মধ্যে। এমনকি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতেও অনেক ক্ষেত্রে দলীয় পরিচয়ই মুখ্য হয়ে ওঠে।

শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মনে করেন, এখন দলভিত্তিক যে শিক্ষক রাজনীতি সেখানে আদর্শই মুখ্য নয়, বরং লোভের সংস্কৃতিটাই মুখ্য।

তিনি বলেন, ‘৮০'র দশকেও আমরা দেখেছে শিক্ষকদের মধ্যে আদর্শিক ভিন্নতা এবং ব্যবধান ছিলো। কিন্তু সেই রাজনীতি তখন দলীয় রাজনীতি ছিলো না। সেটা ছিলো গণমানুষের কল্যাণে, শিক্ষার কল্যাণে। তারপর যেটি হলো, দেশে গণতান্ত্রিক সরকারগুলো এলো এবং এসেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দখলের চেষ্টা করতে থাকলো। ছাত্রদেরকে প্রথমে দলে নেয়া হলো। ছাত্র সংগঠনগুলো হয়ে গেলো ঐ বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মাঠের কর্মীদের একটা সম্মিলন। শিক্ষকদেরও সেভাবে নেয়া হলো।’

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সর্বশেষ যে আন্তর্জাতিক র‍্যাংকিং সেখানে বাংলাদেশের একটিমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান হয়েছে। সেটাও ১ হাজারেরও বাইরে। যে ৫টি ক্যাটাগরিতে টাইমস হায়ার এডুকেশন নামে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‍্যাংকিং তৈরি করে সেখানে পাঠদান এবং গবেষণা -এই দুইটি ক্যাটাগরিতেই সবেচেয়ে কম স্কোর পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পাঠদান ক্যাটাগরিতে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাপ্ত স্কোর ১০০'র মধ্যে ১৬ আর গবেষণায় ৮.৮। অথচ পাঠদান ও গবেষণা এই দুটি অনেকাংশেই শিক্ষক নির্ভর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ও মান নিয়ে যে প্রশ্ন উঠছে তার পেছনে শিক্ষক রাজনীতির একটা দায় আছে।

তিনি বলেন, ‘শিক্ষকদের মৌলিক কাজ দুটি-পড়ানো এবং গবেষণা। এখন পড়াতে হলে তো আগে পড়তে হবে। শিক্ষকরা যদি অধ্যয়নের সময়টুকু রাজনীতির পেছনে ব্যয় করেন, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবেন, কোথায় গেলে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে পারবেন সে সবের জন্য তদবিরে ব্যস্ত থাকেন তাহলে তিনি পড়বেন কখন আর গবেষণাই বা করবেন কখন?’

তবে শুধু যে শিক্ষা এবং শিক্ষকের মানের কারণেই শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে তা নয়। বরং সাম্প্রতিককালে দুর্নীতি, অনিয়মসহ নানা কারণেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রশাসন বিতর্কের মুখে পড়েছে। অন্যদিকে শিক্ষকদের সমিতিগুলো থেকেও অন্যায়ের প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে না।

শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মনে করেন, রাজনৈতিক বিবেচনা বাদ দিয়ে শিক্ষকদের যেভাবে ন্যায়ের কথা বলা দরকার ছিলো সেটা নেই।

তিনি বলছেন, ‘আমাদের এখানে নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে সেগুলো যদি শিক্ষকরা সংঘবদ্ধভাবে দেখিয়ে দেন, যদি ছাত্রদের নিয়ে তারা সমাজের নানা অনাচার প্রতিহত করেন, শিক্ষানীতি নিয়ে নয়ছয় হচ্ছে, এতোগুলো পরীক্ষা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে তার তো কোন প্রতিবাদ দেখি না। সেখানে শিক্ষকদের ভূমিকা রাখার আছে। সেগুলো না করে যদি আমরা টেন্ডার ভাগাভাগিতে লিপ্ত হই আর আর ছাত্রলীগ-ছাত্রদল যদি আমাদের আর্দশ হয়, সেটা তো উচিত না। দেখা যাচ্ছে এখন ছাত্র নেতারাই শিক্ষকদের পরিচালিত করছে।’

কিন্তু শিক্ষক সংগঠনগুলো কেন দলীয় রাজনীতির বাইরে আসতে পারছে না এমন প্রশ্নে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি'র সভাপতি এ এস এম মাকসুদ কামাল অবশ্য বলছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ ধারণ করা কোন অপরাধ নয়। কিন্তু কোনো কোনো শিক্ষক দলীয় কর্মীর মতো আচরণ করছেন, এরকম শিক্ষকদের কারণেই সবার উপর দোষ আসছে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত