ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের নামে মিয়ানমারের ছলচাতুরি

  জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০১৮, ০০:৩৬

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের নামে মিয়ানমারের ছলচাতুরি
ফাইল ছবি

গত ২৫ আগষ্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইনে অভিযান শুরু করে। সেই থেকে এ পর্যন্ত সাত লাখ রোহিঙ্গা এসেছে বাংলাদেশে। তাদের ফিরিয়ে নেয়ার কোনো উদ্যোগ না নিয়ে কার্যত বরং ছলচাতুরিতেই এক বছর পার করেছে মিয়ানমার।

প্রথমদিকে লুকিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করলেও পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়ার ঘোষণা দেন। তারপর রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত প্রায় খুলেই দেয়া হয়। প্রতিদিনই হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসতে শুরু করেন। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের হিসাব অনুযায়ী, মিয়ানমারে জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১০ লাখে দাঁড়িয়েছে। কেবল ২০১৭ সালের আগষ্ট থেকে এ পর্যন্ত ৭ লাখ ৭ হাজার রোহিঙ্গা এসেছে বাংলাদেশে।

রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার পর থেকেই তাদের ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক তৎপরতা শুরু করে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল থেকে শুরু করে বহু রাষ্ট্রের প্রধানও বাংলাদেশ সফর করেছেন, দেখেছেন রোহিঙ্গাদের দুর্বিষহ জীবন। সবার পক্ষ থেকেই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে অনুরোধ করা হয়েছে। চাপ দেয়া হয়েছে। এসব চাপের প্রেক্ষিতে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আশ্বাস দিলেও চাতুর্যপূর্ণ কথাবার্তা আর ছলচাতুরি করে শুধুই সময়ক্ষেপণ করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাখাইন রাজ্য সফর করেছেন। সেখানে দুই দেশের মধ্যে গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু তারপরও রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো শুরুই করা যায়নি।

মিয়ানমারে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন অনুপ কুমার চাকমা। তিনি বলেন, ‘আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো রোহিঙ্গাদের একটা নির্ভূল তালিকা তৈরি করা। আমাদের কাছে তারা যে তথ্য দিচ্ছেন, তার মধ্যে অনেক ভুল। এই ভুল তথ্যসম্বলিত তালিকা যখন পাঠানো হচ্ছে, মিয়ানমার তা গ্রহণ করছে না। প্রথম দফায় আমরা ৮ হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা দিয়েছি। সেখান থেকে হয়ত এক হাজার রোহিঙ্গাকে তারা ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে। সঠিক তথ্য ছাড়া তাদের ফেরত পাঠানো কঠিন।’

গত বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা করে বিদ্রোহীরা। মিয়ানমার সরকার দাবি করে, রাখাইন রাজ্যে দেড়শ'র মতো মুসলিম জঙ্গি একযোগে হামলা চালানোর পর অন্তত ৭০ জন নিহত হয়েছে। মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি'র কার্যালয় থেকে বলা হয়, নিহতদের মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ জন সদস্য রয়েছে। এর মাত্র এক দিন আগেই আনান কমিশন রিপোর্টে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সব ধরনের বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়ারও আহ্বান জানানো হয়েছিল। তবে এর আগে থেকেই সেখানে ব্যাপক সেনা অভিযান চলছিল। বিদ্রোহীদের হামলার পরপরই পূর্ব-পরিকল্পিত ও পদ্ধতিগত সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। পালাতে শুরু করে রোহিঙ্গারা। বাংলাদেশে নামে রোহিঙ্গাদের ঢল।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা কেমন আছেন জানতে চাইলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা রশিদ উদ্দিন বলেন, ‘ক্যাম্পে আশ্রিত জীবন আর কেমন হবে, চলে যাচ্ছে। বেঁচে আছি এই তো বেশি। বাবা-মা জন্ম দিয়েছে সত্যি, কিন্তু বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ আমাদের বাবা-মা। তারা আমাদের দ্বিতীয় জীবন দিয়েছে। আমরা কোনোভাবেই তাদের ঋন শোধ করতে পারব না’।

সারাদিন কিভাবে কাটে– জানতে চাইলে রশিদ বলেন, ‘কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। রিলিফের চাল, তেল, লবণ যা পাই তা দিয়ে কোনোভাবে চলে যাচ্ছে। নিজেরা বসে মাঝে-মধ্যে গল্প করি। তার মধ্যেই হয়ত মারামারি বেঁধে যাচ্ছে। সারাদিন শুয়ে-বসে কার ভালো লাগে? এভাবে কতদিন চলতে পার’?

সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, গত আগস্ট থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চালানো নৃশংসতায় নিহত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ২৫ হাজারের কাছাকাছি। ১৯ হাজার রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ৪৩ হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু গুলিতে আহত হয়েছে, অগ্নিদ্বগ্ধ হয়েছে ৩৬ হাজার আর মারধরের শিকার হয়েছে প্রায় এক লাখ ১৬ হাজার মানুষ।

‘ফোর্সড মাইগ্রেশন অব রোহিঙ্গা : দ্য আনটোল্ড এক্সপেরিয়েন্স' শীর্ষক এই গবেষণাটি করেছে অষ্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, ক্যানাডা, নরওয়ে এবং ফিলিপাইন্সের শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী ও বিভিন্ন ধরনের সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত একটি রিসার্চ কনসোর্টিয়াম।

এদিকে সর্বশেষ এক খবরে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমনপীড়নের মুখে বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়া শরণার্থী সংকটের সূচনা হওয়ার পর এক বছর হলেও রোহিঙ্গাদের পালিয়ে বাংলাদেশে আসা বন্ধ হয়নি। দুই মাস আগেও হামিদা বেগম নামে এক রোহিঙ্গা নারী তার স্বামী আর দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন কক্সবাজারের বালুখালী ক্যাম্পে। এমন আরো কিছু রোহিঙ্গার আসার খবর এসেছে।

মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসের সাবেক ডিফেন্স অ্যাটাসে মেজর জেনারেল (অব.) শহিদুল হক এ বিষয়ে বলেন, ‘এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে গিয়ে বাংলাদেশেকে এক বিশাল অর্থনৈতিক চাপের মুখে পড়তে হয়েছে। এই সংকট ২০১৯ সালের আগে কোনোভাবেই সমাধান হবে না। কারণ, ওই বছর সেখানে জাতীয় নির্বাচন। কিছু হলে এরপরই হতে পারে। আর সরকারকে চাপ দেয়ার চেয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে চাপ দিলে অনেক বেশি কাজ হবে বলে আমি মনে করি’।

এদিকে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর নিধনযজ্ঞের জন্য দায়ীদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের মুখোমুখি করতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাঁচ দেশের ১৩২ জন আইনপ্রণেতা। এক যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেছেন, রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করতে মিয়ানমার সরকার এবং দেশটির সেনাবাহিনীর ওপর চাপ বাড়াতে হবে।

বিবৃতিদাতা আইনপ্রণেতারা ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন্স, সিঙ্গাপুর ও পূর্ব তিমুরের পার্লামেন্ট সদস্য। তাদের মধ্যে ২২ জন আসিয়ান পার্লামেন্টারিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটসের (এপিএইচআর) সদস্য৷ রোহিঙ্গা সঙ্কটের এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগের দিন শুক্রবার এপিএইচআরের ওয়েবসাইটে ওই যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের অনেকেই দেশে ফেরার পর ফের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ)। গত মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক এই মানবাধিকার সংস্থার এশিয়া অঞ্চলের ডেপুটি ডিরেক্টর ফিল রবার্টসন এক বিবৃতিতে বলেছেন, দেশে ফেরা শরণার্থীদের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি মিয়ানমার সরকার দিয়েছিল, প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গাদের নির্যাতন সেই প্রতিশ্রুতিকে মিথ্যায় পর্যবসিত করেছে। এজন্য রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের আগে বিষয়টিতে জাতিসংঘের নজরদারিসহ আন্তর্জাতিকভাবে তাদের সুরক্ষা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন তিনি।

বাংলাদেশ জার্নাল/এনএইচ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত