ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৭ মিনিট আগে
শিরোনাম

সোমেশ্বরীর জলে

  মাইন সরকার

প্রকাশ : ০৭ জুলাই ২০১৯, ২১:২০

সোমেশ্বরীর জলে

সীমান্ত শব্দটা শুনলেই মনটা জানি কেনো নাড়া দিয়ে ওঠে, কেনো জানি হৃদয়ে আগুন ধরে যায়, কে যেনো হাজার বছর ধরে আমাকে দেখবে বলে বসে থাকে সেখানে। আমাকে পাওয়ার আশায় কার যেনো হৃদয় পুড়ে।

সীমান্তে যাচ্ছি হাওড় এক্সপ্রেস ট্রেন ধরে, প্রথমে যাবো নেত্রকোনা তার পর সুশং দূর্গাপুর কবি বন্ধু দুনিয়া মামুনের বাগান বাড়িতে। সারাদিন ঘুরবো গারো পাহাড়, সোমেশ্বরী নদী ও সাদামাটির দেশ বিরিশিরি। আমি আগেও একবার ওঠেছিলাম এই ট্রেনে এটা হলো রাতের ট্রেন। রাত এগারোটা পঞ্চাশ মিনিটে ছাড়ে কমলাপুর থেকে। আগে একবার এই ট্রেনে ওঠে ময়মনসিংহ নেমেছিলাম রাত তিনটায়-জয়দেবপুর হয়ে গফরগাঁও হয়ে ময়মনসিংহ তারপর নেত্রকোনা। রাতে ভ্রমণ করার মাঝে একটা আলাদা ভাব আছে তাই রাতের ট্রেনে আমি অনেক ওঠেছি। কাল পাহাড়ে উঠবো মন ভরে খাবো পাহাড়ি হাণ্ডি।

বাংলাদেশের এক অপরূপ লীলা ভূমি হলো সাদামাটির পাহাড় বা চিনামাটির পাহাড়, অন্য কোনো জেলায় সাদামাটির পাহাড় নেই। কেনো জানি বিরিশিরি নাম শুনলেই আমার মনে পরে জানি কার কথা! এতো লোকের ভীড়েও তাকে মনে পরে, যাকে মনে পরে সে বিরিশিরি গিয়েছে কিনা আমি জানি না। যদিও তার জন্ম ভূমি বিরিশিরির আশপাশেই। আমি নরসিংদীর মানুষ গায়ের রঙ বাদামি, হাসলে গালে টোল পরে না। তার কি হাসলে গালে টোল পরে? না পরে না। তার ঠোঁটের ওপরে ডান দিকে তিল আছে কী না আমি তার কী জানি।

এখন বিমানবন্দর এসে ট্রেন থামলো। আমি ট্রেনের ভেতরই বসে আছি যাচ্ছি আমার প্রিয় সীমান্তে যাচ্ছি সোমেশ্বরী নদীর কাছে। মোটামুটি শীত আছে তাপমাত্রা ১৮ডিগ্রি হার্জ। আমাদের দেশে শীত আসলে নাকি গরীবদের একটু কষ্ট হয় আর যাদের এ রাষ্ট্রে ঘর- বাড়ি নেই। পেপার বিছিয়ে ফুটপাতে ঘুমায় তাদের কিন্তু শীত করে না, তাদের শীত নেই! আমাদের মহামান্য মহোদয় দেশের কতো উন্নয়ন করছেন পদ্মা ব্রিজ, মেট্রো রেল, প্রযুক্তি, প্রতি গ্রামে মহল্লায় মাদ্রাসা, মসজিদ হচ্ছে তবুও এই রাজ্যে এক শ্রেণির মানুষ এখনও ঘুমায় ফুটপাতে, কংক্রিটের বেঞ্চিতে। আরেক শ্রেণি পুঁজিবাদী মহল পুঁজির ফাঁদে জনতার বারোটা বাজায়।

এই রাষ্ট্র উন্নয়নের রোল মডেল, সমাজ বা রাষ্ট্র বদলে দেবালয় থেকে শক্তিশালী মাধ্যম পাঠাগার, প্রতি মহল্লায়, গ্রামে মসজিদ, মন্দির হয় তবুও পাঠাগার প্রতিষ্ঠা হয় না এই রাষ্ট্রে।

এ মাটি উর্বর এখানে ফসল ফলে আর যে কৃষক ফসল ফলায় তার মূল্যায়ন টুকুও করতে পারে না এদেশের মানুষ। অনেক কৃষকের ছেলেকেও আমরা অপমানিত করি, ছোটো করে দেখি বলি কৃষকের ছেলে।

মাননীয় মহোদয় অল্প সংখ্যক মানুষের কাছে জিম্মি হয়ে আছি আমরা। আমাদের অনেকের আজকাল কথা বলাও নাকি মহাপাপ।

কবি আবুল হাসান লিখেছিলেন-

‘মৃত্যু আমাকে নিবে তবুও জাতি সংঘ আমাকে নিবে না

আমি তাই আমার মৃত্যুর আগে কবিদের সুধী সমাবেশে

বলে যেতে চাই, সুধী বৃন্দ ক্ষান্ত হন

গোলাপ ফুলের মতো শান্ত হন।’

যাচ্ছি প্রকৃতির ডাকে, প্রকৃতির কাছে গেলেই মন ভালো হয়। বেদনা উৎপাদন হয় না, জেগে ওঠে মন জেগে ওঠে শিরা উপশিরা।

এবার যাত্রা পথে আমার সাথে আছেন আমার এক প্রিয় মানুষ- কবি প্রদীপ দত্ত, যিনি খুব সরল এবং সাহসী মানুষ।ঐদিকে অপেক্ষায় আছে কবি বন্ধু দুনিয়া মামুন,

আবার আলিফের সাথে দেখা হবে ভুলেও ভাবিনি কখনও। আলিফ নেত্রকোনার বর স্টেশনের একজন চা দোকানি। গত দু বছর আগে এমনিই এক শীতের সকালে তাঁর দোকানে চা খেয়েছিলাম।আলিফ আমাকে দেখে চিনেনি। কত মানুষ প্রতিদিন চা খেতে আসে এখানে।আগের মতো এবারও আলিফের দোকানে চা খেলাম।তারপর চলে গেলাম কোড স্টেশনে মুক্তিযোদ্ধা গেস্ট হাউজে, চার ঘণ্টা থেকে চলে গেলাম বাইক নিয়ে গন্তব্যে। গন্তব্য সুসং দূর্গাপুর দুনিয়া মামুনের বাগান বাড়ি। যেতে হলো চির সবুজ গ্রামীণ মেঠো পথ পূর্বধলার উপর দিয়ে -চারদিকে শুধু ফসলি জমি আর এখানে জমির দামও খুব কম। শিল্প কারখানা নেই । সুগভীর কংস নদী পার হলেই সুসং দুর্গাপুর। কয়লা ও পাথরের নদীর নাম সোমেশ্বরী। অনেক অনেক দিন আগের কথা। উওরে গারো পাহাড় থেকে নেমে আসা এক নদীর নাম ছিল সমসাঙ্গ। সোমেশ্বরী নদীর আদি নাম সিমসাং। সোমেশ্বর পাঠক নামে এক সিদ্ধপুরুষের নাম অনুসারে পরবর্তীতে নদীটি সোমেশ্বরী নামে পরিচিতি পায়। আবার অনেকে মনে করেন কংস সোমেশ্বরী নদীর শাখা নদী।কংস বাংলাদেশের সব চেয়ে ছোটো নদী তবুও তার টলমল জল দেখে আমার মেঘনার কথা মনে পরে,মনে পরে কবি শামসুর রাহমানের কথা তাঁর একটি গান মনে পরে।

‘স্মৃতি জলমল সুনীল মাঠের কাছে পানি টলমল মেঘনা নদীর কাছে আমার অনেক ঋণ আছে, ঋণ আছে।’

দুপুরের খাবারে কোনো কিছুই কমতি পরেনি দুনিয়া মামুনের বাসায়, তাও ভাবির নিজের হাতের রান্না, সোমেশ্বরীর ছোটো মাছ,টেংরা, কাতল, ভর্তা, ঢাল আরো কতো কি!

খাবার দাবার শেষে চলে গেলাম গারো পাহারে। আমরা যাবো বলে রোমি নামের এক গারো বন্ধু হ্যান্ডি খাবার আয়োজন করলো। সবচেয়ে মজার যে বিষয়টি গারোদের তখন উৎসব চলছে তাদের ঐতিহাসিক নিয়মে। কোনো সন্তান পৃথিবীতে আসলে প্রথমে মুখে হ্যান্ডি দিতে হয়। এ এক আজব নিয়ম তাদের। সবাই বসে হ্যান্ডি খাচ্ছে প্রকৃতির লীলাভূমিতে পৃথিবীর ডাকে তখন হাজার বছরের সন্ধ্যা নেমে এসেছেো, কাছে ইন্ডিয়ান পাহাড় নুয়ে আছে আর উঁকি দিয়ে চেয়ে আছে মাঘের চাঁদ। আয়োজনে কোনো কমতি নেই। কেউ একজন বলছে কবি সাহেব ঐ যে দেখা যায় পাহাড়! ঐ পাহাড়ে একসময় হাতি নামতো এখনও নামে দল বেঁধে। খুব ইচ্ছে ছিলো হাতি দেখার কিন্তু আকাশে তখন অন্ধকার আর গারোদের যাপিত জীবন কেমন মনের ভেতর দোল খেয়ে ওঠে।

মধ্যরাত পর্যন্ত গল্প চলছিলো আমাদের। সাথে ইন্ডিয়ান নাম্বার ওয়ানও চলছে আড্ডায়। কথা হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্র নৈতিক সংকট নিয়ে। পরদিন সকালে চলে গেলাম সোমেশ্বরী নদী পার হয়ে চিনামাটির পাহাড় আর নীল পানি দেখতে। তখন দিগন্তের আকাশে প্রচণ্ড রোদ তার পর আবার জায়গার জায়গায় লেখা ‘বিপদজনক এখানে গোসল করা নিষেধ।’ সাঁতার জানি বলে নেমে গেলাম ইচ্ছে মতো সাঁতার কাটলাম বিপদজনক সুগভীর জলে..।

কংস নদী পাড় হলেই পূর্বধলা। ভারতের মেঘালয় ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এ নদী কংসাই বা কংসবতী নামেও পরিচিত। ভারতের শিলং মালভূমির পূর্বভাগে তুরার কাছে গারো পাহাড়ে এ নদীর উৎপত্তি। কংস ও সোমেশ্বরীর মিলিত স্রোত বাউলাই নদী নামেও পরিচিত। কংস নদীর পাশে উভয় প্রান্তে দুটি বাজার রয়েছে।একটি জারিয়া ও অপরটি ঝানজাইল আর জারিয়াই হলো বাংলাদেশের শেষ রেলওয়ে স্টেশন।

পূর্বধলার কাচা রাস্তায় নির্মিত হয়েছে বিপ্লবী কর্নেল তাহের সড়ক- সড়কের মাঝ পথে বাইক থেকে নেমে চা খেলাম। তখন আমার বিপ্লবী কর্ণেল আবু তাহের এর কথা মনে পরতে লাগলো-যে কর্নেল আবু তাহের একজন বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধা, সামরিক বাহিনীর কর্নেল এবং বামপন্থী তুখড় নেতা, আমাদের জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতা যুদ্ধে কর্নেল আবু তাহের ১১ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন।

ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে কর্নেল আবু তাহের এর শেষ উক্তি ছিলো-‘নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে আর কোনো বড় সম্পদ নেই।’ তাহের সেদিন প্রানভিক্ষা না চেয়ে প্রকৃত বীরের মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন।

চা খেয়ে বাতাস খেতে খেতে চলে এলাম শ্যামগঞ্জ মোড়ে, পূর্বধলা, শ্যামগঞ্জ এবং গৌরীপুর মোহনায়।

তখন শ্যামগঞ্জ হলি সিনেমার পাশে রিকশা সাইকেল ও ছাগলের হাটে এলাম। তখন সাইদুল ভাই আমাদেরকে রিসিভ করলেন। সাইদুল ভাই এর পরিচিত মুছলেউদ্দিন খান সেখানে রিকশা বিক্রি করছিলেন আর আমরা যেয়ে দেখি রিকশা বিক্রি হয়ে গেছে ষোলো হাজার টাকা।

রিকশা বিক্রির টাকায় মুছলেউদ্দিন তিনটি শাড়ি কিনলেন কারণ বাকি টাকাটা তিনি গাঁজা খেয়ে উড়িয়ে দিবেন বলে তার ধারনা। তাই আগেই তার তিন বউয়ের জন্য তিনটি শাড়ি কিনে নিলো। আহা কত চমৎকার এই শ্যামগঞ্জের মানুষের জীবন!

এই মাটিতেই জন্ম হয়েছিলো কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ, জাফর ইকবাল, বিচারপতি শাহাউদ্দিন ও বিখ্যাত শিল্পী, গীতিকার জালাল খান এর মতো মানুষের।

শ্যামগঞ্জের পাশের উপজেলাই গৌরাঙ্গ শাহার জমিদার বাড়ি যা নির্মিত কংস নদীর ওপর। তাদের মধ্য থেকে তখন কেউ একজন বলে ওঠলো আজ নেংটার মেলা, কবি সাহেব চলেন মেলা দেখে যাই তিনদিন হবে এই মেলা। আমিও তাদের কথা মতো চলে এলাম। মাজার গেইটে এসে দেখতে পাই বড় করে লেখা’ নদীয়ার চাঁদ নেংটা বাবার মাজার শরীফ।শ্যামগঞ্জ বাজার থেকে তিন মিনিট হেঁটে এলাম। দিনটি অজানাই ছিলো এসে দেখলাম এই মিলন মেলা।

তখন সাইদুল ভাই বলতে শুরু করলেন- নেংটা বাবার কাছে যারা আইতো কেউ না কেউ কিছু চাইতো।আর বাবার দেওয়ার ইচ্ছা থাকলে বলতো একমন গাঞ্জা লইয়া আয় নয়তো একমন তার। শ্মশানে নেংটা বাবা যেখানে থাকতো সেটা ছিলো তার দিয়ে পেছানো আগুনের ঘর।আর এই কুণ্ডলী পাকানো তারের ছোটো ঘরে অগ্নিকুণ্ড জ্বলে আছে অবিরাম।

আমি ঢুকতে যেতেই বাধা হয়ে দাঁড়ালো আগুনের ধোঁয়া, তখন কেউ একজন বললো বসে পরেন তখন বসতে যেয়ে দেখলাম আগুনের তাপ কমে এসেছে আর ধোঁয়ার কুণ্ডলী ঘুরছে বন্ধ তারের ঘরের ভেতর।

  • সর্বশেষ
  • পঠিত