ঢাকা, রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৭ মিনিট আগে
শিরোনাম

অন্ধি সন্ধি ব্যাঙের আধুলি ঊনপাঁজুরে জীবন

  রাজীব কুমার দাশ

প্রকাশ : ১২ জুলাই ২০২২, ১৬:০৮

অন্ধি সন্ধি ব্যাঙের আধুলি ঊনপাঁজুরে জীবন

মা-বাবাকে ফেসবুকে জোর করে খাইয়ে দেয়া, স্নান করানো, এঁনাদের সামনে নাগিন ড্যান্স করে সবার কাছে হিরো সন্তান সেজে লাইক কমেন্টস স্টিকার নেয়ার ধান্দ পৃথিবীর সভ্য দেশে না থাকলেও এ জনপদের অসংখ্য বান্দাদের মনে আছে। কে কখন, কীভাবে অন্ধিসন্ধি ভাইরাল প্রতিযোগী মনে অংশগ্রহণ করতে বসে আছেন; তা কেউ বুঝতে পারেন না।

এ তল্লাটের বহুরূপী ধান্দাবাজ বান্দাদের মাথায় একটা চিন্তাই সব সময় বয়ে বেড়ায়- ‘এটাতে আমার লাভ-ক্ষতি খ্যাতি কতোটা বয়ে আনবে! এটাকে পুঁজি করে খ্যাতির মই বেয়ে আরো কতোটা খ্যাতিমান হতে পারব।’

খ্যাতির বিড়ম্বনা নিয়ে এ জনপদের মানুষ- চিড়িয়াখানার বেবুন, বানর, মনদটাক,নীলগাই, জলহস্তী হতেও আপত্তি নেই; বরং এঁনারা এটাকে জীবনের সেরা পাওনাকড়ি মনে -লুটেপুটে বাটনা বেটে চেটে খেয়ে নেন।

সাল মনে আছে,তারিখটা মনে পড়ছে না। মনে না থাকারই কথা! ২০০৯ সালের শেষ দিকে হবে। আমি চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানার এসআই। ইথার বেতারে হট্টগোল সংবাদ পেয়ে রেয়াজুদ্দিন বাজারে কসাই দোকান পানে সকালের আধাআধি নাস্তা শেষ করে ছুটে চলেছি। প্রথমে মনে করেছি, ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটে চলেছে। বুকটা ধক ধক করছে -কী জানি! কী হতে চলেছে। গিয়ে দেখি,মাংসের দোকানের সামনে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। উনি আমাকে কিছু বলার চেষ্টা করছেন; কিন্তু বলতে পারছেন না। বার বার বলছেন, ‘এ যে বড়ো অসভ্য কথা! আপনাকে কী করে বলি! প্লিজ বলতে পারব না।’

আমি বললাল, ‘প্লিজ আপনি সবার সামনে না বলেন, অন্তত আমাকে ফিস ফিস করে বলেন। কেউ শুনতে পারবে না।’

একটু দূরে নিয়ে ভদ্রলোক যা বললেন; এ তল্লাটে অহর্নিশ ঘটে চলা হরেক রকম অপরাধের ভিড়ে কসাইয়ের অশ্লীল শব্দবোমার অপরাধ সর্বৈব গুরুতর বলে মনে হয় নি। এ তল্লাটের সূতিকাগার পেরিয়ে মৃত্যুর দুয়ারে শ্লীল-অশ্লীল বিতর্ক প্রতিযোগী যুদ্ধে বিসিএস ডক্টরাল বাংলা সিনেমার পরিচালক পেরিয়ে, ইংলিশ একাডেমি মহাপরিচালক, চাষাভুষা, গ্রাম বাংলা শহরে শেষমেশ ডক্টরাল অশ্রাব্য অশ্লীলতাই বাজিমাত করেন।

স্রেফ অশ্লীল জ্বালানি ভরে সেফুদা ঘণ্টায় হাজার লক্ষ মাইল বেগে মিসাইল শব্দবোমা ছুঁড়ে অব্যর্থ নিশানায় হৃদয়ের বা পাশটা ছিদ্র করে লক্ষ লক্ষ ফলোয়ারের খোলা চোখের সামনে কখনো খোলা গায়ে জাঙ্গিয়া খুলতে চান; যৌবনে প্রেমিকার ক্ষুধা মেটানোর গল্প বলেন, ভাঙা খাটের গল্পে মদের গ্লাস হাতে-ছোটলোক মূর্খ, অনেক দাম, তোরা কী করে খাবি? গালমন্দ শুনিয়ে ফলোয়ারের জীবন ধন্য করে অন্ধিসন্ধি মনে ঘুম পাড়িয়ে দেন।

পুলিশ দেখে সেফুদা ডায়ালগ খ্যাত কসাই জুলফিকারের চোখগুলো অক্ষম আক্রোশ বিদ্রুপে ঢালাই কারখানার ফুটন্ত লাল গলনে টগবগ করছে। নিজেকে মনে করছে, কখনও চেঙ্গিস খান, মুহাম্মাদ ঘুরি,কখনো ভাবছে নোয়াখালি দাঙ্গার নেতা গোলাম সারোয়ার। চিরস্থায়ী শত্রু মনে কাছা মারা লুঙ্গি কোমরে প্রশ্ন করছে-

- ভাই, এটা কী অপরাধ হলো বুঝলাম না!

‘এ বাজারের আমি নামকরা কসাই, কী করে - তাকে অপমান করতে পারি? জিজ্ঞেস করেন মাংসের দাম

কত?

আমি বলেছি,পাঁচশ। উনি বলেছেন; ভেড়া না খাসি?

আমি বলেছি -খাসি।

তারপর বলছেন, খাসি হলে...ছোট ছোট ইয়েগুলো কই? আমি বলেছি -খাসির নেই, তাতে কী? আমার গুলো তো আছে।

কসাই জুলফিকার বহুমুখী চাতুর্যময় ধড়িবাজ শকুনিচোখে এটা ওটা বলে আমাকে মাপার চেষ্টা করে যাচ্ছে; আমি অসহায় পরাজিত পৃথ্বিরাজ দৃষ্টিতে তার পানে চেয়ে রইলাম। জুলফিকার চিন্তা করলো এইতো সুযোগ! পুলিশের সামনে যদি একটু হিরোগিরি করি, সামনের দিনগুলোতে মাস্তান বাবা সাজতে অসুবিধা হবে না।

‘ভাই আমি অমুক ভাইয়ের দল করি, ভাই বলেছে -পুলিশ ঠোলা ডিস্টার্ব করলে বারোটা বাজায়ে দিবে। আমার অনেক উকিল কাস্টমারও আছে। তারাও বলে গেছে,পুলিশ ডিস্টার্ব করলে জানাইতে। আপনাকে দেখে মনে হয়েছে, আপনি আমার -খুঁটির বাঁধা নিরীহ ছাগল।

আমাদের এ বাজারের ওসি-ডিসি হলো,সভাপতি সেক্রেটারি। আপনার মনে নাই? গতবছর চোরাই মোবাইল ধরে আপনাদের অমুক ভাই মোবাইল মার্কেট হতে বের হতে পারেনি। আমরা সবাই স্লোগান দিয়ে বলেছি- ‘পুলিশের মাস্তানি চলবে না, চলবে না। পুলিশের চামড়া,তুলে নেব আমরা।’

‘ফুটপাত, দোকান বন্ধ করে রাস্তার গাড়ি আটকে ভাংচুর করেছি। পরে আপনাদের বড় অফিসার এসে আমাদের সভাপতি আলো ভাইকে নিয়ে মিটিং করে পুলিশকে ছেড়েছি। পরে আলো ভাই আমাদের মিটিং করে বলেছে, এ মার্কেটে পুলিশ আসতে হলে, আলো ভাই, সেক্রেটারি মহব্বত ভাইকে জানাতে হবে। আপনাদের সিভিল টিমের চ্যাতা দারোগা মারা নেতা মন্ত্রী দাওয়াত দিয়ে এটা ওটা খাইয়েছি। আমাদের মার্কেটে যে সব সুন্দরী আন্টি, ভাবি, শালি ব্রা-প্যান্টি কিনতে আসে, আমরা মহব্বত করে হাত দেখিয়ে বলি,আপা আপনার সাইজ কত? সাইজ না বললে বিক্রি করি না। দোকানের সামনে হেঁটে গেলে বলি, ভাবি -আমার দোকানে আসেন কেনাকাটা করে অনেক রাতের সুখ পাইবেন। অনেক ভাবি রাগ করে প্রতিবাদী হলে বলি, রাতের ঝাড়ি কম হয়েছে বুঝেছি -নাম্বারটা দেন ভাবি।’

নাদিয়া আপা, বিন্দিয়া ভাবি, সেফুদার মতো, আমিও সবকিছু ভাইরাল করি। পাঁঠাগুলো কেটে তাদের অন্ডকোষ খুলে দেখি। বেশি দামে নেতা ডালিমের কাছে বিক্রি করি।

কসাই জুলফিকার হঠাৎ চেঁচিয়ে বলেন, আপনি যে আমাদের মার্কেটে এসেছেন, আমাদের বণিক সমিতি জানে?

বণিক সমিতির নেতারা আসলেন। সভাপতি বলেন, ভাই আপনার কথা নাই, বার্তা নাই- কোন এক পাতি কবির কথায়, আমাদের মহান কবি জুলফিকারকে অপমান করবেন,তা এ বণিক সমিতি মেনে নিতে পারে না।

এতোক্ষণ যা ছিলাম -এবার পড়েছি মহাবিপদে! একদিকে কবি সামলে নিরাপদে ফিরে আসা, অন্যদিকে অবশিষ্ট সন্মান যতোটুকু আছে, তা অক্ষত রেখে কসাই কবি জুলফিকার সামলিয়ে ফিরে দেখা।

জুলফিকার কসাই একলাফে কবি হলেন। আমি কৌতুকী হলাম! সভাপতিকে বললাম, ভাই,কী জানি বললেন?

- কেন? আপনার বিশ্বাস হয় না?

না।

-ও হচ্ছে মাংস কবি! মাংসের পিস করার সময়, নিজের লেখা অশ্লীল কবিতা বলেন। তা আবার ফেসবুকে লাইভ করেন। হাজার হাজার দর্শক হা-হা লাভ রিয়েক্ট দেন। হেসে হেসে কবিকে ধন্যবাদ দেন। ওর দোকানে প্রচুর ভিড় লেগে থাকে। এক কথায় -ওর লক্ষের উপরে ফলোয়ার। আমার মার্কেটে আরও প্রচুর কবি পাবেন। কেউ উষ্মধ্বনি, কেউ শিস ধ্বনি দেয়, কেউ ব্রা কবি, কেউবা আবার আন্টি-ভাবির প্যান্টি কবিতা লিখেন।

- আপনার বিশ্বাস হয় না?

আমি বললাম: কী যে বলেন?

- এই জুলফিকার, তোমার মোবাইল দাও। এ কী! এক অবিশ্বাস্য! বদ্বীপের নির্বোধ শিহরণ দেখছি না তো? জুলফিকার কবিদের কথাই ঠিক। তার লক্ষাধিক ফলোয়ার।

এবার একুশে পদকের ঘরে কড়া নাড়া কবি হিম্মত শাহরিয়ার কৌশিকের পেইজ দেখার পালা! কৌশিক বিড় বিড় করে অষ্ফুট স্বরে বলেন, ‘আমাদের অন্ধি সন্ধি ব্যাঙের আধুলি ঊনপাঁজুরে মার্কা জীবন।’

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কবি,পুলিশ পরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ। মেইল:rajibkumarvandari800 @gmail.com

বাংলাদেশ জার্নাল/আরকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত