ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি!

  সোহেল সানি

প্রকাশ : ১৬ আগস্ট ২০২২, ১৪:০৯

মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি!

রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের বলেছিলেন, ‘আপনারা কেউ লাশের সঙ্গে টুঙ্গিপাড়া যেতে চাইলে যেতে পারেন।’ কিন্তু মোশতাক দেখলেন কেউই লাশের সঙ্গে যেতে আগ্রহী নন। আরে কেউ মোশতাকের পতনের চার বছর পরও বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত করতে টুঙ্গিপাড়ায় যাননি।

এ যে ছিল নির্মম-নিষ্ঠুর এক বাস্তবতা। এতে করে মোশতাকের মনে আরও আশার সঞ্চার হয়েছিল। পতন না হলে যে, খুনী মোশতাকের আওয়ামী লীগই করতেন তার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা-এতে কোনপ্রকার সন্দেহ নেই। মাত্র ৮৩ দিনের মাথায় মোশতাক রাজত্বের অবসান ঘটবে সেটা বোধকরি তারা কেউই আঁচ করতে পারেননি, বরং মন্ত্রীত্ব নিয়েই তারা ব্যস্ত ছিলেন। মন্ত্রীদের লোভ তাদের এতোটাই পেয়ে বসেছিল যে, দপ্তর বণ্টনের সময় কেউ কেউ খুনী ফারুক-রশিদেরও দ্বারস্থ হয়েছিলেন। মোশতাক আশ্বস্ত হয়েছিলেন মন্ত্রীদের প্রতি।

আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করেই তাকে অগ্রসর হতে হবে এ বুদ্ধিটাও মন্ত্রীরা দেন। মোশতাক ১৯৭৫ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী থেকে একদলীয় (বাকশাল) পদ্ধতি রহিত করেন। রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা এম এ জি ওসমানীই প্রথম বাকশাল ব্যবস্থা রহিত করার পরামর্শটি দেন। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়া নৌ ও জাহাজ চলাচল মন্ত্রী জেনারেল ওসমানী ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি একদলীয় (বাকশাল) ব্যবস্থার বিরোধিতা করে সংসদ সদস্য পদ হারান। কিন্তু যারা বঙ্গবন্ধুর বাকশালকে উত্তম পন্থা বলে মুখে ফেনা তুলেছিলেন, দেখা গেলো সেই তারাও বাকশাল রহিত করে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার পক্ষে সাফাই গাইলেন। এরা বঙ্গবন্ধুর বাকশাল মন্ত্রিসভারই সদস্য ছিলেন। বাকশালের কোথাও ছিলেন না দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান মোশতাকের অবাধ্য হওয়ায় হত্যা করা হয়।

আব্দুস সামাদ আজাদ, কোরবান আলী ছাড়া বঙ্গবন্ধুর বাকশাল মন্ত্রিসভার সকলেই মোশতাকের মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন। পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন এমন মন্ত্রীদের মধ্যে শেখ আবদুল আজিজ, মোল্লা জালাল উদ্দীন, মিজানুর রহমান চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, ডঃ মফিজউদ্দিনকে মোশতাকের মন্ত্রিসভায় দেখা যায়নি।

যাহোক রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক পহেলা সেপ্টেম্বর বাকশাল রহিত করে ৩ সেপ্টেম্বর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। ১৯৭৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। রাষ্ট্রপতি মোশতাক ১৯৭৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভবনে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের অধিবেশন ডাকেন।

নিয়মানুযায়ী জাতীয় সংসদের স্পিকার আব্দুল মালেক উকিলের সভাপতিত্বেই বৈঠক শুরু হয়। বৈঠক উত্তপ্ত হয়ে ওঠে গাজীপুরের ময়েজউদ্দিন আহমদ, কুমিল্লার অ্যাড, সিরাজুল হক ও ঢাকার শামসুল হক বঙ্গবন্ধু হত্যার তীব্র প্রতিবাদ করলে। কিন্তু ওই বৈঠকেও একজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী খুঁজে পাওয়া যায়নি তাদের কণ্ঠে কণ্ঠে মেলানোর জন্য। ১৯৭৫ সালের ২৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধু মর্মে 'ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ' জারি করা হয় মন্ত্রিসভার সর্বসম্মতিক্রমে। মোশতাকের আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করে বৈঠকে বাহবা কুড়ান। তিনি বঙ্গবন্ধুরও আইনমন্ত্রী ছিলেন।

মোশতাকের মোসাহেবি এমনভাবে শুরু হয় যে, দেশে জাতীয় পাখি আছে, জাতীয় ফুল আছে, জাতীয় ফল আছে, একটা জাতীয় টুপি থাকা দরকার। অতএব একটা জাতীয় টুপির পক্ষে মন্ত্রিসভার অনুমোদন মিললো। গাঢ় ছাই রঙের কিস্তি টুপি যে টুপিটা খন্দকার মোশতাক পরিধান করেন। ২৬ আগস্টের ওই বৈঠকের সিদ্ধান্তক্রমেই সংসদ ভবনসহ সমস্ত সরকারি দপ্তর থেকে বঙ্গবন্ধু ছবি নামিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়।

মন্ত্রিসভা গঠনের ৮ দিনের ব্যবধানে (২৩ আগস্ট) গ্রেপ্তার করা হয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান, আব্দুস সামাদ আজাদকে। ২ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করা হয় জিল্লুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও গাজী গোলাম মোস্তফাকে। পরে গ্রেপ্তার করা হয় আমির হোসেন আমু, মোজাফফর হোসেন পল্টুকে। এসব গ্রেপ্তার নিয়েও কী মন্ত্রিসভার কোন সদস্য মুখ খুলেছিলেন? রাষ্ট্রপতি মোশতাক কী গ্রেপ্তার আগে তার মন্ত্রীদের পরামর্শ নেননি?

বঙ্গবন্ধু সরকারের তথ্যমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী তার ‘রাজনীতির তিনকাল’ গ্রন্থে লিখেছেন, একদিন খন্দকার মোশতাক আমাকে ইফতারের দাওয়াত দিলেন। ইফতারের পর বললেন, তোমাকে আমার সঙ্গে কাজ করতে হবে। তুমিও যদি দেশের রাষ্ট্রপতি হও তাহলে তোমারও দেশ পরিচালনার জন্য ৫০ জন লোক লাগবে। জবাবে বললাম, মোশতাক ভাই আপনি তো বলেছেন আওয়ামী লীগ করবেন। তাই আমাকে দলের জন্যই রাখেন। সরকারে টানার দরকার নেই।

'৬৬-৭২ আওয়ামী লীগে সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রতি ইঙ্গিত করে বঙ্গভবনের সভায় বলেছিলেন, যেভাবে নেতাকর্মীদের নির্যাতন, গ্রেপ্তার ও হয়রানি করা হচ্ছে, তাতে দল করবেন কাদের নিয়ে? বাস্তবতা ছিল মোশতাকের ৮৩ দিনের রাজত্বে একজন মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগের ঘটনা ঘটেনি।

যদিও খন্দকার মোশতাকের আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনের সুযোগ আর হয়নি। তিনি ডেমোক্রেটিক লীগ নামে একটি দল গঠন করেছিলেন। '৭৬ সালে বায়তুল মোকাররম মসজিদ প্রাঙ্গণে তার জনসভায় কে বা কারা অতর্কিত সাপ ছেড়ে দেয় এবং ঘটে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা। ৯ জন এতে মারা যায়। ১৯৯৬ সালের ৫ মার্চ মোশতাক মারা যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মোশতাকের নাম থাকলেও কোন মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীর নাম ছিল না, বরং তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন।

১৯৭৬ সালের ৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনের পর সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন নেতৃত্বলাভ করেন। পরে স্পিকার আবদুল মালেক উকিলের হাতে চলে যায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। আব্দুর রাজ্জাক কারাগারে বসে সাধারণ সম্পাদক হন। মালেক উকিল আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান শেষে লন্ডনে যাত্রা বিরতিকালে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ ফেরাউনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচারণ।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

  • সর্বশেষ
  • পঠিত