ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২ মিনিট আগে
শিরোনাম

যে গল্পের ভাষা নেই

  রাজীব কুমার দাশ

প্রকাশ : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২২:৫৯

যে গল্পের ভাষা নেই

জিনগত পর্যায়ে হোক, টিকে থাকার লড়াই হোক; এমনিতেই হোক, প্রাণী স্বার্থপর হবেন এমনটা স্বাভাবিক। আবাল বৃদ্ধ সবাই স্বার্থপর। এমনকী মৃত্যুপথযাত্রী আদম হাওয়া সন্তানকে যদি বলা হয়, এখানে লোহা পিতল সোনা হীরার কফিন আছে 'তুমি কোনটা চাও?' হাতে দা কিরিচ হকিস্টিক যদি থাকে- নির্ঘাত খুনোখুনি হয়ে যাবে। তবে, সত্য এটা যে- স্বার্থপরতা মানুষকে পিছিয়ে দেয়। পারস্পরিক সহযোগিতা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে, বেঁচে থাকতে সাহসী করে তোলে।

এই বদ্বীপে স্বার্থান্ধ আদিখ্যেতার শিকড় অনেক গভীরে। অবিরত সে শিকড় শিখরে বসে সবাই হাসাহাসি করে। হোক সেটা রাষ্ট্রযন্ত্র, হোক গৃহতন্ত্র, হোক না সেটা হৃদয়তন্ত্র। এই দেশে পিতা-মাতা ভাই-বোন প্রেমিক প্রেমিকা বহুরূপী বহুমাত্রিক স্বার্থপর হতে হবে, এটাই শেষ সময়ের বাক্য বিশ্লেষণ।

বিয়ের রীতি-নীতি মানব প্রাণীটি পালন করেন। যৌনতার সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে প্রাণীটি গতানুগতিক বংশগতি রক্ষা করে চলেন। কেউ কেউ সামরিক বেসামরিক বাণিজ্যিক মনে সন্তান উৎপাদন চালিয়ে যেতে থাকেন। সন্তানগুলো লড়াই করে কাড়াকাড়ি মারামারি লুটপাট করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে মাঝে মাঝে দানবীর সেজে যান।

'চৌকিদার তুমি যতই বাড়ো, মাইনে তোমার একশ বারো।' নীতিতে বদ্বীপের মা-বাবা তাদের ছেলে-মেয়ে সামলে নেন। মাঝে মাঝে সন্তানের উপরে তাঁদের একচ্ছত্র অধিকার কর্তৃত্ব তা সবার সাথে গল্প করেন। কী প্রকারে সন্তান পয়দা করে লালন-পালন করেছেন, তার বিশদ বিবরণ সাংবাদিক সাহেবদের হেসে হেসে গল্প বলেন। মানে উনি যৌবনে সন্তান পয়দা করে এক মহৎ মহান দৃষ্টান্ত স্হাপন করেছেন।

হোক- সন্তান লুটেরা দস্যু, হোক সরকারি চরম ঘুসখোর হোক না সে কালোবাজারী। তাতে কার কী? উনার কাজ গল্প বলা, সাংবাদিক সাহেবদের কাজ লিখে দেয়া। আমজনতার কাজ অক্ষম আক্রোশে থুথু গেলা।

লস্কর বাড়িতে আজ কাম কম। মোবাইল কানে খবর এলো, তাদের একমাত্র শিক্ষিত সরকারি চাকুরে মেয়েটার সংসার ভেঙে যাবার উপক্রম। মেয়ের জামাই ডালিম মাস্টার চরম কৌশলী। এক সময়ে একটি নামকরা স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। চরম দুর্নীতির কারণে চাকরি চলে যায়। সহজ সরল মেয়েটাকে উচ্ছ্বাস আবেগের ঘূর্ণিঝড়ে ফেলে ডালিম মাস্টার কৌশলে বিয়েটা সেরে নেন। মেয়েটা কিছুদিন পরে হাড়ে হাড়ে টের পায়, এই মাস্টারবেশী কথিত ভদ্রলোক একজন চরম ভণ্ড ও ইরেক্টাইল ডিসফাংশন রোগী। এই দেশের সচ্ছল বাবা মা সচ্ছল ছেলে সন্তানের চেয়ে সচ্ছল মেয়ের দিকে দাবির মাত্রা ছন্দ দাড়ি কমা যতি চিহ্ন ছায়াছন্দ লিখেন- অনেক বেশি। মেয়েটা কী করবে না করবে, কী খাবে দাবে, স্বামী অক্ষম হলেও কী ভাবে দাঁতে দাঁত চেপে সন্মান সম্ভ্রম বাঁচিয়ে সংসার করবে; নাতি নাতনি হলে তো ব্যস!

ওদের দিকে তাকিয়ে হলেও তাপিত যৌবনে টুঁ শব্দ পর্যন্ত না করে সংসার করতে হবে কিন্তু সংসার ছাড়া যাবে না। অদম্য সধবা 'ইস্ট্রোজন হরমোন' বিধবাদের মতো তিলে তিলে কথিত পবিত্রতার ছাই ভষ্ম মেখে জ্যান্ত কৈ মাগুর শিং মাছের মতো মেরে ফেলতে হবে। এই নিয়ে মাঝে মাঝে এই দেশে পত্রিকার কাটতি বেড়ে যায়। পত্রিকার শিরোনাম হয়, 'বিধবার পুত্র সন্তান হাসে, কিংবা সুবোধের বউ অবোধের সাথে এক কাপড়ে পালিয়ে গেছে।' পত্রিকার শিরোনাম পড়ে পাঠক আমোদিত কামোদিত মনে চা দোকানে বসে হাসাহাসি করেন, কেউবা নিজেকে নিজে কল্পনার জগতে কিছু সময় অবোধ হয়ে হোটেল কটেজ লঞ্চের কেবিনে সংসার করেন। চা দোকানির- ও মিয়া দাম দেন চিৎকারে পাঠক সম্বিত ফিরে পান।

স্বার্থের ধারাবাহিকতায়- যথারীতি যতীন লস্কর তাঁর সুচতুর স্ত্রী মাধুরীবালা সরকারের প্রথম শ্রেণির চাকুরে মেয়ে সংযুক্তার বাসা পৌঁছে এটা সেটা আদেশ উপদেশ দিতে লাগলেন। অসাধ্যকে সাধন অবাধ্যকে বাঁধন কবিরাজের দেয়া তাবিজ কবজ পানি পড়া সংযুক্তার অগোচরে কিছু খাইয়ে ছিটিয়ে দিলেন। অবশ্য এর আগেও যতীন মাধুরী জুটি হার্টের চিকিৎসা পারিবারিক পুলিশি দীর্ঘ ঝামেলা তীর্থ খরচে সংযুক্তার জমানো সব টাকা শেষ করে বলেছিলেন, 'সংযুক্তা তুমি হলে আমাদের বংশের একমাত্র কুলদ্বীপ। তোমার ভাই রঘুকেও নিজের খরচে পড়িয়ে মানুষ করেছো। তুমি আগের জনমে ছিলে- আমাদের সীতা। এই জনমে পবিত্র গীতা। '

ইদানীং দার্শনিক ডায়োজিনিস দ্য সিনিক কবি নীটসে পড়ে সংযুক্তা নিজেকে নিজে কিছুটা চিনতে পেরেছে। আপন পরের ভেলায় সে চড়তে শিখেছে। তাঁর প্রতারিত জীবনের গল্পে সে নিজেকে নিজে ধিক্কার দিতে শিখেছে। ভণ্ড প্রতারক স্বামী ডালিম মাষ্টার, তাঁর বাবা মা যতীন মাধুরী লস্কর জুটির শকুনি দুর্যোধন দাবার বন্দী চালে ঠেলে দেয়া দুঃসহ জীবনের গভীর খাদ হতে সে নিজেকে কিছুটা সামলে নিতে শিখেছে। তাদের সম্মিলিত একাট্টা মনোদাবী-'স্বামী খোড়া বেঁটে দাবিয়ে হাঁটে বদমাশ প্রতারক দুর্নীতিবাজ তাতে কী? নপুংশক তাতেও ক্ষতি কী?'

একটা সন্তান তো হয়ে গেছে। স্বামীর ঢাকা শহরে একটি ফ্ল্যাট তো আছেই। তা ছাড়া বিয়েত হিন্দুদের একটাই হয়। বিচ্ছেদ নেই। সংযুক্তা সেপারেশন টাইপের কিছু করে বসলে- যতীন মাধুরী পরিবারের মান-সন্মান সবটাই যাবে। নপুংশক ডালিম মাস্টার সংযুক্তাকে বাগে রাখতে কথাও কাজে দোষ, টিপ্পনি, সংযুক্তার অফিসে পরকীয়া অপবাদ ছড়িয়ে আত্মীয় স্বজনদের অডিও ভিডিও ঝগড়া ক্লিপ পাঠিয়ে সব সময় তটস্হ রাখে।

এই নিয়ে আত্মীয় স্বজন যতীন লস্কর মাধুরীবালা জুটির ছেলে রঘু তাদের ছেলে বউও কম কথা শোনায় না।

'হিন্দু মেয়েদের বিয়েত একবারই হয়।' হোক- কানা খোড়া বোবা পাগল। বাবার বাড়ি মেয়ে ফিরে আসা, সেপারেশন মানে- পারিবারিক সামাজিক অমঙ্গল। আপনারা মেয়ের বাসায় চলে যান। ওখানে গিয়ে প্রয়োজনে সকাল বিকাল মেয়েকে বোঝান। না বুঝলে গালমন্দ দেন। ইরেক্টাইল ডিসফাংশন শারীরিক প্রতিবন্ধী স্বামীর বিছানায় পাঠাতে প্রয়োজনে- সংযুক্তাকে যাবজ্জীবন কানা খোড়া বোবা চির অসুখি হতে অভিশাপ দেন। তারপরেও যদি কাজ না হয়, আপনারা দরজা বন্ধ করে খাবার স্পর্শ না করে দিন গুজরান করেন। কথাবার্তা বলা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিন। সে মতে সংযুক্তার উপরে চলছে সবকিছু। এই দিকে সুচতুর মাস্টার ডালিম থেমে নেই। প্রতিদিন নিয়ম করে সংযুক্তার মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয়। কথায় কথায় বাসা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বলে। সংযুক্তার বাবা মা'কে সংযুক্তাকে সাথে করে নিয়ে যেতে কৌশলী চাপ দেন। অফিস কলিগদের নিয়ম করে প্রতিদিন খবর নেয়, 'সংযুক্তা ক'টায় অফিসে আসে যায়।'

নারীত্বের পরিপূর্ণতা বাঁচার বাতিঘরে সংযুক্তার বাতিগুলো চারিদিকে ক্রমশ নিভে আসছে। ভাসমান সংসার নামের অতল নীল দরিরায় প্রতিদিন শত শত সংযুক্তা শুন্য জীবনে ভাসছে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কবি, পুলিশ পরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ

বাংলাদেশ জার্নাল/এমপি

  • সর্বশেষ
  • পঠিত