ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

যে কারণে ১১তম গ্রেডই চান প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা

  মাহফিজুর রহমান মামুন

প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০১৯, ১৫:২১  
আপডেট :
 ১৯ মার্চ ২০১৯, ১৫:৩৩

যে কারণে ১১তম গ্রেডই চান প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষার মাধ্যমে একটি দেশ ও জাতি উন্নতির চরম শিখায় পৌঁছায়। পৃথিবীতে যতগুলো উন্নত মর্যাদার দেশ আছে, সে সবকয়টি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক উন্নত। একটা কথা প্রচলিত রয়েছে যে আপনি যদি কোন জাতিকে ধ্বংস করতে চান তবে সেই জাতির শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেন, তাহলে সেই জাতি এমনিতেই ধ্বংস হয়ে যাবে। শিক্ষা ব্যবস্থার প্রথম ধাপ হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষাকে সকল শিক্ষার ভিত্তি বলা হয়। একটা ঘরের ভিত্তির উপর যেমন সেই ঘরটির স্থায়ীত্ব নির্ভর করে ঠিক তেমনি প্রাথমিক শিক্ষার উপর অন্য সকল বিভাগের শিক্ষা নির্ভর করে। তাইতো জাপান,সুইডেনের মত দেশগুলো তাদের প্রাথমিক শিক্ষার উপর সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়।

প্রাথমিক শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষকদের গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাইতো যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি সদ্য স্বাধীন দেশের রাজকোষ ফাঁকা থাকা সত্বেও তিনি প্রাথমিক শিক্ষকদের জাতীয়করণ করে সরকারী কর্মচারীর মর্যাদা দিয়েছিলেন। তাছাড়া তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে বেতনের কোন পার্থক্য রাখেননি। ১৯৭৩ সালের পে-স্কেলে একজন প্রধান শিক্ষক ও একজন সহকারী শিক্ষক উভয়ই ২২০ টাকা স্কেলে বেতন পেতেন। ১৯৭৭ সালের পে-স্কেলে সর্বপ্রথম প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের বেতন স্কেলের মধ্যে ১ ধাপ পার্থক্য সৃষ্টি করা হয় যা সকল সহকারী শিক্ষক স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নিয়েছিলেন। তখন একজন প্রধান শিক্ষক বেতন পেতেন ৩২৫ টাকা স্কেলে ও একজন সহকারী শিক্ষক বেতন পেতেন ৩০০টাকা স্কেলে। ১৯৭৭ সালের পে-স্কেলে প্রথম প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের বেতন স্কেলের মধ্যে যে ১ ধাপ পার্থক্য সৃষ্টি করা হয়েছিল তা যথাক্রমে ১৯৮৫, ১৯৯১ ও ১৯৯৭ ও ২০০৫ সালের পে-স্কেলেও বহাল ছিল,অর্থাৎ ১৯৭৭ থেকে ২০০৫সাল পর্যন্ত যেসব পে-স্কেল দেয়া হয়েছিল তার সবগুলোতে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের বেতনের মধ্যে বেতনের মাত্র ১ ধাপ পার্থক্যই ছিল। প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে বেতন বৈষম্য প্রথম সৃষ্টি করা হয় ২৯শে আগস্ট ২০০৬ সালে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষককে প্রদত্ত আপগ্রেড স্কেলে।

সেই সময় প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের মধ্য বেতনের ২ ধাপ পার্থক্য সৃষ্টি করা হয়। প্রধান শিক্ষককে বেতন দেয়া হয় ১৩তম ধাপে (৩৫০০টাকা স্কেলে) ও সহকারী শিক্ষককে বেতন দেয়া হয় ১৫তম ধাপে (৩১০০টাকা স্কেলে)। ২০০৯ সালের ৭ম পে-স্কেলেও প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের মধ্যে ২ধাপ বেতনস্কেলের পার্থক্য ছিল। কিন্তু ২০০৯ সালের আপগ্রেড স্কেলে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে ৩ ধাপ পার্থক্য তৈরী করে সবচেয়ে বড় ও নির্মম বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়। তখন প্রধান শিক্ষককে বেতন দেয়া হয় ১১তম ধাপে ও সহকারী শিক্ষককে দেয়া হয় ১৪তম ধাপে। ২০১৫ সালের ৮ম পে-স্কেলেও প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের মধ্যে ৩ধাপ পার্থক্যই চলমান থাকে।

একটি ছকের সাহায্যে বিভিন্ন সময়ে প্রধান শিক্ষক সহকারী শিক্ষকদের বেতনের ধাপ উল্লেখ করা হল।

বর্তমানে সহকারী শিক্ষকরা প্রধান শিক্ষকের ৩ ধাপ নিচে বেতন পাচ্ছেন। প্রধান শিক্ষকরা ১১তম গ্রেডে ও সহকারী শিক্ষকরা ১৪তম গ্রেডে বেতন পান।

৩ ধাপ নিচে বেতন পাওয়ার কারণে বর্তমানে সহকারী শিক্ষকরা যেভাবে একটি বিশাল বৈষম্যের শিকার হচ্ছে নিচে তা একটি ছকে দেখানো হল।

সহকারী শিক্ষকরা প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের মধ্যে এই ৩ ধাপ চলমান বৈষম্য নিরসন করে প্রধান শিক্ষকের পরের ধাপে সহকারী শিক্ষকদের বেতন নির্ধারণ করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছিল। তারই ফলশ্রুতিতে ২০০৭সালের ২৩শে ডিসেম্বর প্রধান শিক্ষকের পরের গ্রেডে সহকারী শিক্ষকের গ্রেড নির্ধারণের দাবী জানিয়ে শহীদ মিনারে সহকারী শিক্ষকরা আমরণ অনশন শুরু করেছিল। তৎকালীন গণশিক্ষামন্ত্রী সহকারী শিক্ষকদের দাবী যৌক্তিক হলে তা পূরণ করার আশ্বাস দিয়ে ২৫শে ডিসেম্বর জুস পান করিয়ে অনশন ভাঙ্গান। পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষের সাথে সহকারী শিক্ষক নেতৃবৃন্দের দফায় দফায় আলোচনা হয় এবং কর্তৃপক্ষ সহকারী শিক্ষকদের দাবী অর্থাৎ প্রধান শিক্ষকের পরের ধাপে বেতন নির্ধারণের দাবী যৌক্তিক বলে স্বীকার করেন। কিন্তু বৈষম্য আর নিরসন করেননি। এ অবস্থায় নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে নায্যতার ভিত্তিতে সহকারী শিক্ষকদের বৈষম্য নিরসনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। সহকারী শিক্ষকরা আবার আশায় বুক বাধে। বর্তমানে প্রধান শিক্ষকরা বেতন পাচ্ছেন ১১তম গ্রেডে ও সহকারী শিক্ষকরা বেতন পাচ্ছেন ১৪তম গ্রেডে(১০২০০টাকা স্কেলে)। পার্থক্য ৩ধাপ। কি্ছুদিন আগে মাননীয় হাইকোর্ট প্রধান শিক্ষকদের ২০১৪ সালের ৩মার্চ থেকে ১০ম গ্রেডে(১৬০০০টাকা স্কেলে)বেতন দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন এবং কর্তৃপক্ষও প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেডে বেতন দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছন। ১৯৭৭ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত যেখানে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে বেতনের পার্থক্য ছিল একধাপ,সেখানে বর্তমানে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে বেতনের পার্থক্য ৪ধাপ। এ অবস্থায় সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে দেয়া প্রতিশ্রতি অনুযায়ী সহকারী শিক্ষকরা এই বৈষম্য নিরসনের জন্য সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডে বেতন দেয়ার দাবী জানাচ্ছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কিছুদিন আগে সহকারী শিক্ষকদের ১২তম গ্রেড দেয়ার প্রস্তাব করেন যা বাস্তবায়িত হলে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের মধ্যকার বেতন বৈষম্য আরো দ্বিগুণ হবে। কারণ পূর্বে প্রধান শিক্ষকরা ১১তম গ্রেডে(১২৫০০টাকা স্কেলে) ও সহকারী শিক্ষকরা ১৪তম গ্রেডে(১০২০০টাকা স্কেলে) বেতন পান। পার্থক্য হচ্ছে টাকার অঙ্কে ১২৫০০-১০২০০=২৩০০ টাকা। এই বৈষম্য নিরসন করার জন্য যেখানে সহকারী শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন এবং কর্তৃপক্ষও সহকারী শিক্ষকদের দাবী যৌক্তিক বলে স্বীকার করেছেন সেখানে সহকারী শিক্ষকদের ১২তম গ্রেডে বেতন দেয়া হলে প্রধান শিক্ষকদের সাথে সহকারী শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য আরো অনেক বৃদ্ধি পাবে। কারণ প্রধান শিক্ষকরা ১০ম গ্রেডে(১৬০০০টাকা স্কেলে) এবং সহকারী শিক্ষকরা ১২তম গ্রেডে(১১৩০০টাকা স্কেলে) বেতন পেলে শুধু বর্তমানেই প্রধান ও সহকারী শিক্ষকদের বেসিক বেতনের মধ্যে পার্থক্য হবে ১৬০০০-১১৩০০=৪৭০০ টাকা। ১৬ বছর পরে ২টি উচ্চতর গ্রেড পেয়ে প্রধান শিক্ষকরা যখন ৮ম গ্রেডে(২৩০০০টাকা স্কেলে) যাবেন তখন সহকারী শিক্ষকরা ১৬বছরে ২টি উচ্চতর গ্রেড পেয়ে ১০ম গ্রেডে(১৬০০০টাকা স্কেলে) যাবেন। তাহলে ১৬বছর পরে প্রধান ও সহকারী শিক্ষকের মধ্যে শুধু বেসিক বেতনের পার্থক্য হবে ২৩০০০-১৬০০০=৭০০০টাকা যা আরো বিশাল বৈষম্য সৃষ্টি করবে।

নতুন প্রস্তাবি গ্রেড বাস্তবায়িত হলে সহকারী শিক্ষকরা যেভাবে আরো বড় বৈষম্যের শিকার বে, নিচে তা একটি ছকে দেখানো হল।

একমাত্র সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেড দেয়া হলে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে বেতন বৈষম্য দূর হবে। সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেড দেয়া হলে ১৬বছর পরে সহকারী শিক্ষকরা ২টি উচ্চতর গ্রেড পেয়ে ৯ম গ্রেডে(২২০০০টাকা স্কেলে) যাবেন এবং প্রধান শিক্ষকরা ২টি উচ্চতর গ্রেড পেয়ে ৮ম গ্রেডে(২৩০০০টাকা স্কেলে)যাবেন। তাহলে পার্থক্য হবে ২৩০০০-২২০০০=১০০০টাকা মাত্র,যা খুবই স্বাভাবিক। তাই সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সহকারী শিক্ষকদের একমাত্র ১১তম গ্রেড দেয়া হলে প্রধান ও সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য নিরসন হবে। সেইসাথে বৃদ্ধি পাবে শিক্ষকদের মর্যাদা,সেজন্য শিক্ষকরা মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করে দেশ ও জাতিকে উন্নত করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে সহায়তা করবে।

  • সর্বশেষ
  • পঠিত