ঢাকা, রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৭ মিনিট আগে
শিরোনাম

সতর্কতার শপথ ভয়াবহ আগস্টেই

  প্রণব সাহা

প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০১৯, ১৩:৩০  
আপডেট :
 ১৮ আগস্ট ২০১৯, ১৮:৪০

সতর্কতার শপথ ভয়াবহ আগস্টেই

বর্ষপঞ্জির কালো পৃষ্টার নাম আগস্ট মাস। আগস্ট এলেই বাঙালি শোকে মুহ্যমান হয়, আতঙ্কও ঘিরে ধরে আমাদের। আর এখন আগস্ট মানেই কয়েকটি ভয়াবহ ঘটনার বার্ষিকী পালন।

৩০ দিনের এক মাসে তিন-তিনটি ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল পুরো দেশকে। ১৫, ১৭ আর ২১ আগস্ট। এই তিনটি ভয়াবহ ঘটনায় বিশ্বের গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক পরিসরেও আলোচনায় এসেছিল বাংলাদেশ।

১৫ আগস্ট আমরা হারিয়েছি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বাংলাদেশের স্রষ্টা তখনকার রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করেছিল সেনাবাহিনীর কয়েকজন বিপথগামী কর্মকর্তা এবং তাদের দোসররা। দেশী-বিদেশী চক্রান্তের অংশ ছিল এই হত্যাকান্ড। তাই তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিরোধ আসেনি কোথাও থেকে। যদিও ব্যাক্তিগতভাবে কেউ কেউ উদ্যোগী হয়েছিল,তাতে আত্মহুতির ঘটনাও ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্ট বাংলাদেশের আদর্শকে ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টার শুরু তখন থেকেই। তারপরই মুছে গেছে মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শ। দেশের স্বাধীনতাবিরোধীরা পুনর্বাসিত হয়েছে, এমনকি তারা পেয়েছে জাতীয় পতাকাও।

পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টের পর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসন শেষে ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেও ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট ঘটে যায় আরেক ভয়াবহ ঘটনা। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল ২১শে আগস্ট। গ্রেনেড হামলায় কেঁপে উঠেছিল সারাদেশ, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ভেসেছিল রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের রক্তে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন এখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু নারীনেত্রী আইভি রহমানসহ প্রাণ গিয়েছিল ২৪ জনের। আর ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচারের রায়ে ফাঁসির আদেশ হয়েছে বিএনপির সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ ১৯ জনের। মোট ৫২ আসামির মধ্যে আছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানও। দেশের রাজনীতির এক বড় ক্ষত এই ২১শে আগস্ট।

আর ২০০৫ সালের ১৭ই আগস্ট একই সাথে ৬৩ জেলায় সিরিজ বোমা হামলা চালিয়েছিল জঙ্গি সংগঠন জেএমবি। ‘আল্লাহর আইন কায়েম ও প্রচলিত বিচার পদ্ধতি বাতিলের’ দাবিতে ৬৩ জেলায় প্রায় পাঁচশ (৪৩৪) স্পটে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেদের শক্তি জানান দিয়েছিল জেএমবি। নিহত হয়েছিলেন দুজন।

আর এই তিনটি ঘটনার কারণেই আমাদের কাছে এখন আগস্ট মাস মানেই এক ভয়াবহ আগস্ট। এই তিনটি ভয়াবহ ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এবং বাঙালিত্ব। ১৯৭৫ সালের পর ৩৯ বছর এবং ২০০৪ সালের ১৫ বছর পর এখনও আগস্টকে নিয়ে অনেক বেশি পর্যালোচনার সুযোগ আছে বৈকি। ১৫ই আগস্ট এবং ২১শে আগস্ট ইতিহাসের দুই নৃশংসতার বিচার হয়েছে। ফাঁসিতে ঝুলেছে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া খুনিরা। কিন্তু এখন আমরা বলি যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর ২১ আগস্ট যে নারকীয় হামলা চালানো হয়েছিল তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ওপর, তা একই সূত্রে গাঁথা। কারণ হামলা দুটির মূল লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে নিশ্চিহ্ন করাই। আর সেজন্যই আমরা বলছি যে, স্বাধীনতার পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি যে চক্রান্ত শুরু করেছিল, তার সফলতা পেয়েছিল ১৫ই আগস্টে।

কিন্তু এর ২১ বছর পর নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ আবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিল। আর ২০০১ সালে আওয়ামী লীগই প্রথমবারের মত শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় সরকারের মেয়াদ শেষে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে সংযুক্ত হয়েছিল আওয়ামী লীগের আন্দোলনের কারণেই। আর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার করার উদ্যোগী হয়েছিলেন তার কন্যা শেখ হাসিনা। যদিও খুব সহজ ছিল না, সেই কাজ। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়েছিল। কিন্তু যারা জয়ী হযেছিলেন তারা ততদিনে জেনে গেছেন, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার রাষ্ট্র পরিচালনার দক্ষতার কথা। তাই আবারো ষড়যন্ত্র। ২১শে আগস্টের হামলায় তাই প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্র। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি ছিলেন, দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা তাকে সপরিবারে হত্যার পর জেলখানায় খুন করেছিল তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারীদের। আর ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা আর দলের নেতাদের একসঙ্গে নিশ্চিহ্ন করার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশেই চালানো হয়েছিল গ্রেনেড হামলা। কিন্তু শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে না পেরে হামলার চিহ্ন যেমন সরিয়ে ফেলা হয়েছিল, তেমনি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্তরা সঠিক তদন্ত পর্যন্ত করতে চাননি। বরং সাজানো হয়েছিল “জজমিয়া নাটক”। এরপর ২০০৫ সালের ৬৩ জেলার প্রায় ৫০০ স্পটে সিরিজ বোমা হামলা চালানো হয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষনে বলাই যায়- তিনটি ঘটনার আইনি বিচার হয়েছে কিন্তু ঘটনার পেছনের চক্রান্ত সম্পূর্ণভাবে উদঘাটিত হয়নি। আজও তাই ১৫ ও ২১শে আগস্টের ঘটনা নিয়ে পর্যালোচনা, গবেষণা বা একটু বাড়িয়ে বললে নতুন করে অনুসন্ধানের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় কিংবা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির নব-উত্থানের কারণে এখন অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে আর ছোটো করার সাহস দেখান না। বরং অনেকেই এখন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধা জানান। এমনকি তাকে যখন জাতির জনক হিসেবে উল্লেখ করা হয় তখন অনেকেই চুপ করে থাকেন।

কিন্তু এটা বলতে বাধা নেই যে, এইসব রাজনৈতিক শক্তির অনেকেই যদি কখনো আবারো রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পান, তারা কি সরকারি অফিস-আদালত থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি সরিয়ে ফেলতে সবার আগে উদ্যোগী হবেন না? কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনের সময় আমাদের সকল আনুষ্ঠানিকতার বাইরে প্রত্যয়ী হতে হবে যে, বাংলাদেশের অস্তিত্ব যতদিন থাকবে ততদিন জাতির জনকের স্থায়ী সম্মানকে কেউ যেন সামান্য ক্ষুন্ন হতে না দেন । এমনকি বঙ্গবন্ধু শুধুমাত্র একটি একক রাজনৈতিক দলের নেতা নন, তাও সবাইকে মানতে হবে।

ভয়াবহ আগস্টেই জাতিকে শপথ নিতে হবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সেই চেতনার পরিপন্থী কোনো রাজনৈতিক শক্তিকেই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেবে না বাংলাদেশ । এমনকি বঙ্গবন্ধুর আর্দশ থেকে বিচ্যুত কোনো রাজনৈতিক সংগঠনকেও ছাড় দেবে না স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাগরিকরা। আর তাই আমরা দাবি করতেই পারি, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক সমাজ ও গবেষকরাও ১৫ ও ২১শে আগস্টের পেছনের চক্রান্ত উন্মোচন করতে সব সময়ই তাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখবে। আগামী মুজিববর্ষে সেই কাজে ব্রতী হওয়াই হবে শতবর্ষ পালনের প্রধান দ্যোতনা।

বিচারক কাজী গোলাম রসুলের আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রতিদিনের কার্যক্রম কাভার করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, মামলার রায়ে প্রত্যক্ষ খুনিদের বিচার হয়েছে কিন্তু দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র উদঘাটিত হয়নি। মামলা চলার সময় ব্রিটিশ সাংবাদিক লরেন্স লিফসুজ ঢাকায় এসেছিলেন। আমার মাধ্যমে তিনি জানতে চেয়েছিলেন, কেন ১৯৭৫ এ ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোস্টার আসামি নন। মামলার প্রধান কৌঁসুলি আইনজ্ঞ সিরাজুল হকের কাছে এই প্রশ্ন তোলা হলে, তিনি বলেছিলেন- ‘আমাকে আইনি যুদ্ধে জিততে হবে’।

২১শে আগস্টের মামলার রায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি যখন একটি রাজনৈতিক দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন, তখন কি আর এগুনো যায় জাতীয় সমঝোতার রাজনীতির জটিল তত্ত্ব নিয়ে? এখনো সেই রাজনৈতিক দলের নেতারা দাবি করেন: ২১শে আগস্টের মামলার পুনঃতদন্ত এবং মামলার রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাহলে তো একটা আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠন করে আমাদের খুঁজে বের করতে হবে ১৫ ও ২১শে আগস্টের ঘটনার মধ্যকার যোগসূত্র কি? কেন বারবার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক দলটিকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করার চক্রান্ত করা হয়। কেন একই দিনে মা-বাবাসহ সব স্বজন হারানো শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যার চেষ্টা হয়। এর মধ্যে তিনটি ঘটনা কাভার করার দুর্ভাগ্য হয়েছিল। তাই আশঙ্কা থাকে, এখনো কি কোথাও কোনো চক্রান্তের ছকে দাবার গুটি খেলা চলছে ?

ষড়যন্ত্রের কথা বলাটা কি বাড়াবাড়ি? এ প্রশ্নের জবাবে আজকের বক্তব্য শেষ করতে চাই বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধৃত করেই। ১৯৭২ সালের ৩১শে জানুয়ারি স্টেডিয়ামের ভাষণে তিনি বলেছিলেন- ‘ষড়যন্ত্র চলছে, কিন্তু তারা জানে না বাংলাদেশের মানুষদের। তারা জানে না আমার গণবাহিনীর লোকদের, তারা জানে না আমার মুজিব বাহিনীর লোকদের, তারা জানে না আমার এই বাংলার জনসাধারণদের। কি করবে? আমার স্বাধীনতা হরণ করার চেষ্টা করবে, ষড়যন্ত্র করবে? ভুলে যাও। বাংলার সাত কোটি মানুষ গুণে গুণে জান দিবে, কিন্তু বাংলার মানুষের স্বাধীনতা কেউই নেবার পারবে না।’

১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি সংসদে শেখ মুজিব আবারো বলেছিলেন “কোনো দেশের ইতিহাসে নেই, বিপ্লবের পর বিপ্লবকে বাধা দিয়েছে যারা, শত্রুর সঙ্গে সহযোগিতা করেছে যারা, যারা দেশের মানুষকে হত্যা করেছে তাদের কোনো দেশ কোনো যুগে ক্ষমা করা হয়েছে” বঙ্গবন্ধু আরো বলেছিলেন ‘.... বলেছিলাম দেশকে ভালোবাসুন, দেশের জন্য কাজ করুন, দেশের স্বাধীনতাকে গ্রহণ করে নিন। কিন্তু অনেকের পরিবর্তন হয় নাই। তারা এখনো গোপনে বিদেশিদের কাছ থেকে পয়সা এনে বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তাদের শাস্তি পেতে হবে।’ অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথেই এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। হয়তো এজন্যই আর বেশি দিন সময় নেয়নি চক্রান্তকারীরা। কিন্তু দেশের মানুষের প্রতি যে বিশ্বাস ছিল জাতির জনকের তার সেই আস্থার প্রতিদান দিতে ব্যর্থ হয়েছিল পুরো জাতি। তাই সতর্কতার শপথ নিতেই হবে এই ভয়াবহ আগস্টেই।

  • সর্বশেষ
  • পঠিত