ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩৯ মিনিট আগে
শিরোনাম

সততা ও দারিদ্র্য মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ

  রাজীব কুমার দাশ

প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২০, ১৯:২৬

সততা ও দারিদ্র্য মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ

আশ্চর্য হবার কিছু নেই! যাঁরা সৎ হবেন, শতভাগ নিশ্চিত আপনি দরিদ্র। সততা আপেক্ষিক বিষয়! প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, আপনি কতোটা সৎ হবেন? সময়ের বিপরীতে বয়ে চলা দশ নম্বর প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ ঘূর্ণিঝড় সহ্য করে কতোটা পথ একাকি এগিয়ে যেতে পারবেন? আপনি আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো আপেক্ষিকতা তত্ত্বে বিশ্বাস করে সততার কতোটা চাপ নিতে পারবেন? আপনাকে দিগম্বর করে খাড়া পুংলিঙ্গ দেখার বাসনা নিয়ে আপনার পাশে থাকা সক্রেটিস, নবাব সিরাজউদ্দৌলার অক্ষম আক্রোশে থাকা অসৎ হায়েনা উত্তরসুরীদের কী করে চিনবেন?

এতো চাপ আপনি সহ্য করতে পারবেন তো? চালাক সাহেব, আপনার চোখ দুটো কেমন জানি;কক্সবাজার লাইট হাউসের সিগন্যাল বাতির ঝিলিক ছড়ালো? আমি বুঝে নিয়েছি, আপনি চালাক সৎ! বোকা সৎ নন? আপনি ভালো করে জানেন-আপনার আপন আপনিই! বিপদে পড়লে কেউ পাশে নেই। তাইতো বলি-কেন আপনি অতি লিখার সময় হাত কাঁপে? অতি সৎ, অতি সুন্দর, অতি ভালো, অতি সোজা, অতি ভদ্র লিখতে চাননি? অতি এড়িয়ে আপনি ক্রোড়পতি! আপনার দিগম্বর হবার কোনোই সম্ভাবনা দেখছিনা, পুংলিঙ্গ সুরক্ষার জন্যে আপনি দেশ সেরা সতীপতি।

Honesty is the best policy "থিসিস"করে বোকা 'ইডিয়ট' 'জীবন'বাসি তেলে ডোবা সিঙ্গারা-সামুচা, হোটেল ছালাদিয়া, বুয়ার মোটা চালের জবরদস্তি মোটা ভাত, ভেসে থাকা লাল ঝোল তরকারি খেয়ে এখন গ্যাস্ট্রিক রোগী। বউটা অতি সৎ স্বামীর কারণে যারপরনাই ত্যক্তবিরক্ত। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা, জরায়ু কেটে ফেলা, উন্নত খাবারের অভাব আরো কতো কি! বউটা বোকাচোদা 'জীবনকে কতো বুঝিয়েছে। দেখো জীবন, তোমার বস কতো তোমায় বুঝিয়েছে! কেউ সৎ নেই কেউ নিজে, কেউ পরে, কেউ কমিশন, কেউ উপহার, কেউ বাজার, মাছ-মাংস সমানে খাচ্ছে। ওদের দেখো! আমাদের দেখো। ওরা কতো নাদুসনুদুস! ওদের বৌ-শালি, শালির মামাতো বোন রুপালী নিয়ে কতো আনন্দ। শ্বশুর-শাশুড়ি কতো গল্প করে।

'জীবন'প্লিজ! ওরা তোমার জুনিয়র, আজ তোমার ছেলেটা বাসার সামনে পার্কে খেলতে গিয়ে ওদের মতো খাবার চাচ্ছে, গাড়িতে বসতে চাচ্ছে। তোমার সততার জন্যে দেশ-সমাজ বিশেষ কিছু দিয়েছে? তোমার প্রভিডেন্ট ফান্ড, বাবা বাড়ির গহনা সব শেষ। নতুন বস এসে তোমায় বদলি করে বলেছে সততার কেন্দ্রবিন্দু হলো, রাঙ্গামাটির জুরাছড়ি উপজেলা। ওখানে ফুল-ফল পাখি ঝর্ণা, ঝিরি রাতে লেক দেখার অনেক সুযোগ। আমার কাজিন বিশেষজ্ঞ ডা. মমতার কারণে পিজিতে তোমার অম্ল ঢেঁকুর চিকিৎসা চলে। এখন আমাদের কী হবে জীবন? অন্ধের যষ্ঠি আমাদের সন্তান সৌভিকের পড়াশোনা! তোমার বেঁচে থাকা?

অনেক কষ্ট করে 'জীবন' বুকটা ফুলিয়ে গ্যাস্ট্রিক ব্যাথা-কোমর দুলিয়ে তালি দেয়া অমর মুচির সেলাই বাইপাস জুতো নিয়ে পুরনো চিপা, ঢোলা পোশাকে অভ্যর্থনা রুমে সকাল ১০টা হতে বসে আছে। পরিচয় পেয়ে রিসিপশন রুমে গাঢ় মেককাপে বসা তরুণী নাম,পদবি, কারণ লিখে হাতে স্লিপ ধরিয়ে দেন। 'জীবন' স্লিপ টা নিয়ে পরম যত্নে আজ সততা পরীক্ষা দিতে কোমর বেঁধে নেমে বেশ আমোদিত। বুকটা ধক-ধক করছে। এসির মধ্যে ও কপালে চিকন ঘাম। এতো বড়ো সৎ অফিসার!

নাম শুনেছে, সরাসরি দেখা হয়নি। বাহ্ আজ সততার পরীক্ষা হবে! বিএসআর, আইন, সংবিধান, মানবাধিকার 'ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স' সব জানা। তবে জীবনের মনে কেমন খটকা হলো?একি!যারা চরম দুর্নীতিবাজ, মাগীবাজ, চরম ঘুষখোর, যাদের অনেক দন্ড, তারাই এখানে এসে কাজ করিয়ে চলে যাচ্ছে? অথচ আমার ডাক পড়ছে না।

মনে মনে জীবন ভাবছে-'স্যার মনে হয় ওদের বকা-সকা দিয়ে দুষ্ট বলে বের করে দিচ্ছে'। ধ্যাৎ! একি ভাবছি? স্যারের মতো মানুষ হয় না। এমন দেবদূত পৃথিবীতে আসতে চান না, ঈশ্বরের কাছে ঝগড়াফসাদ করেই শেষ-মেস আমাদের মতো সৎ জীবনদের জন্যেই আসেন। আহা! কি সুন্দর, শরীরে চম্পা ফুলের ঘ্রাণ, হাসিতে দাঁতে বিজলি মারে। ঘ্রাণ-বিজলি-র কারণে কতো কী হয়েছে! পাপ হবে! আমার মনটা আসলেই ছোট? কী খারাপ চিন্তা মনে উঁকি দেয়! এইতো সেদিন জেলা বসের রুমে ঢুকে কি যেনো দেখেছি! ছি! লজ্জা আসে বলবো না। সপ্তাহ শেষ হতেই বস বলেন, তুমি তো মাইয়া না, পোন্দাপুন্দি করবো ইডিয়ট! কোথাকার। ড্রেস আপ নেই, কথা জানে না, পার্টি ডিল জানে না, মন বোঝ না, তোমারে বাল ফালাইতে রাখুম। ছি! এতো নষ্ট কথা! শুনতে কেমন জানি গা ঘিন-ঘিন করে।

চরম আদর্শবান বস! যাকে সারাটাজীবন মনের পবিত্র আসনে বসিয়ে নিজেরে ধন্য করেছে আদর্শ মেনেছে! যার সাহসে প্রতিদিন হাজার-লাখ টাকাগুলো কালো কচুপাতা মনে করেছে, দালালি করতে আসা ভদ্রবেশি মাগীদের টেপাটেপি করেনি, কাজের আগে সঙ্গম করে ভিডিও ধারন করেনি! এমন কি-চা-টা ও না। ভদ্রবেশি মাগীরা জীবনকে ‘বৃহন্নলা’ বলে খেপাত। জীবন আজ সব মনের কথা বসকে বলবে। 'দৈব'বস তো জীবনের মনের কথা জানেন-বোঝেন। তাইতো আজ গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা নেই। বস লাঞ্চ সেরে ঘণ্টাখানেক পরে কাজ শুরু করেছেন। জীবনের ডাক আসে না। পিয়ন (আর্দালি) বিরক্তি নিয়ে হুংকার দিয়ে বলেন, বেশি চিল্লাচিল্লি করিয়েন না,সাব (সাহেব) ব্যস্ত! আমনে অফিসার হইছেন ক্যামনে? সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে বডিগার্ড, রিসিপশনে থাকা স্বালোক কথিত সুন্দরীকে হাসতে দেখে জীবন বেশ আহত হন। মনের জোর আস্তে-আস্তে কমে গ্যাস্ট্রিকের ব্যাথা বেশ বেড়েছে। জারের ফ্রি পানিতে ব্যাথা কমার কোনো লক্ষণ নেই। হাত-পা কাঁপছে! ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে 'জীবন' একাকি স্বপ্নের দেবদূত বসের রুমে ঢুকে পড়েছে।

জীবন স্বপ্নের দেবদূতকে কাছে পেয়েছে প্রথম। চাকরিতে ঢুকে যার দীর্ঘ মোটিভেশনাল স্পিক সততার সবক বুকে একাকি লালন করে চলা -'জীবন' তার ব্যাচের মাঝে একাই। অন্তরে কেঁদে কেঁদে বলেন, 'হে দেবদূত' মনের সব গোপন কথা জেলা বস খাঁই খাঁই মাস্তান বাবা না জানুক, না বুঝুক, না শুনুক আপনি তো জানেন! হে কৃপাসিন্ধু অন্তর্যামী! এতোটা বছর আপনার আদেশ ঐশীবানীর মতো অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। নতুন, পুরাতন বসের ধমক-চমক খেয়ে দেখে নিজেরে মনে করেছি কখনো চিড়িয়াখানার মদনটাক, নখদন্তহীন বাঘ।

পুষ্টির অভাবে জোয়ান বয়সে নিজেরে করেছি বুড়া-লুলা। বেতন বাড়ানোর অজুহাত দিয়ে বাড়িভাড়া দিয়ে যা পাই, আপনার ভাষণে সব ভুলে নিজেরে ধন্য মনে করেছি। সরকারি সেবা, চিকিৎসা নিয়ে সবারই তর্জন-গর্জন অবহেলা নিয়ে বউয়ের জরায়ু হারিয়েছি। হে মানুষরূপী দেবদূত! আজ সব মনের কথা শুনতে হবে। আপনার হৃদয় ভরা সব দয়া। আমার সন্তান আপনার গল্প শুনে ঘুমোতে যায়। আপনার মুখের কথাগুলো আমি বাণী করে মুকস্হ করি। হে গুণাবতার! হে রুপাবতার! আপনার আরো কিছু গুণ দেন, রূপ নেবো না, অফিসে কাজ ভাগাতে আসা নারীরা বিরক্ত করবে। দু'চোখের কোন বেয়ে আবেগের কান্নাগুলো এক সময়ে ফোঁটা হয়ে বইছে। বস দেবদূত খোলস ছেড়ে হঠাৎ মানুষ! প্রশ্ন-

নাম কি? জীবন

কোন ব্যাচ -১৯৯৭, কেন এসেছো? স্যার আমি সব আপনাকে খুলে বলেছি, আপনি আমার আদর্শ, সবকিছুই আপনি জানেন। হুংকার-ড্রেস, বডি ল্যাংগুয়েজ, মুচির মতো গোঁফ, আচরণ, কিছুই তোমার ঠিক নেই! বসের চোখগুলো লাল! পাতি শেয়ালের মতো, চম্পা ফুলের ঘ্রাণ নেই, এ কি অবস্থা। জীবনের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। ঠোঁট- জিহবা শুকিয়ে একাকার। কলিং বেল, চাপরাশি হাজির। এ ধরনের লোক কী করে আমার অফিসে আসে'? পিএ-স্টাফ অফিসারকে ডাকো।

জীবন ভাবে-'এতোদিন ডালভাত খেয়েছি'মনে দুঃখ ছিলো না! এবার কী হবে? বউ-পোলা কী খাবে? সুরে-স্বরে কিছু একটা হতে যাচ্ছে! আজ বউটার কথা বেশ মনে পড়ছে। অজান্তে জীবনের কয়েক ফোঁটা প্রশ্রাব বাম রান দিয়ে বেয়ে পড়ছে। ভাগ্যিস! আজ খালি পেট, ভরা পেট নিয়ে কী যে হতো, তা দয়াল জানেন। কম দামের জাঙ্গিয়া পড়ায় লিঙ্গ বাম দিকে সরে গেছে। কল্পনার মহামানব আজ জীবনরা যাতে বেশি বিরক্ত করতে না পারেন, নতুন করে অর্ডারস জারি হবে। দেবদূত চিন্তা করেন জীবন যদি মারা যায়, এখন কী হবে? কৌশলে বলেন, আচ্ছা জীবন তুমি যাও, আমি দেখছি। জীবন হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। যাক, বাবা ভিক্ষার দরকার নেই, কুত্তা সামলানো দরকার।

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। রাস্তার পাশে বনরুটি চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট-লাঞ্চ দুটোই সেরে বাসায় গিয়ে চুপচাপ। বউকে লজ্জা-অপমান চরম সততার কথা না বলে বেমালুম চেপে যায়। জামাই বলে কথা! পঙ্গু স্বামীও হিরো। স্বামীর সেবার সময়েও পিটুনি খেতে হয়।

সকালের প্রথম প্রহরে জেলা বসের ফোন, জীবনে কোনো বালতো ছিঁড়তে পারোনি আমার বিরুদ্ধে বাল ছিঁড়তে গেছিলা তো? তাড়াতাড়ি অফিসে এসে তলবি জবাব দিয়ে যাও। আমিও একটা দিবো-শালা! এ একটা আকামা হিজড়া নিয়ে আমি টেনশনে থাকি। সব কিছুই জীবন শুনতে পাচ্ছে। জীবন তলবি কাগজ হাতে নিয়ে বেশ খুশি। সবকিছুই পরিস্কার হয়ে গেছে। জীবন এখন মৃত। নতুন জীবনের হাতে খড়ি ফ্রিডরিখ নিৎসের হাত ধরে সামনের দিকে ছুটে চলা। সততা এখন বিলুপ্তপ্রায় সংস্কার! সৎ থেকো, সৎ হও উপদেশ প্রতারণা-ভণ্ডামি ছাড়া জীবনদের কাছে কিছুই না।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক পুলিশ পরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত