ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩৭ মিনিট আগে
শিরোনাম

গাছকে ভালোবেসে বিশ্বজুড়ে সমাদৃত যে বৃদ্ধা

গাছকে ভালোবেসে বিশ্বজুড়ে সমাদৃত যে বৃদ্ধা

গাছকে ভালোবাসেন আশেপাশে এমন অনেক মানুষই চোখে পড়ে। কিন্তু গাছকে নিজের সন্তানের মায়া-মমতা দিয়ে বড় করে তুলছেন এমন কারও দেখা সচারচর পাওয়া যায় না। এমনই একজন হলেন থিম্মাক্কা। তার নিজের সন্তানাদি নেই। কিন্তু এ নিয়ে এখন আর এ নিয়ে তার কোনও আক্ষেপ নাই। কেননা নিজের হাতে লাগানো গাছপালাকেই যে তিনি নিজের সন্তান মনে করেন।

ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের বাসিন্দা থিম্মাক্কার বিয়ে হয়েছিল ওই রাজ্যের গুব্বি তালুকের বাসিন্দা বেকাল চিক্কাইয়ার সঙ্গে। কিন্তু বিবাহিত জীবনের ২৫ বছরেও কোনও ছেলেমেয়ে না হওয়ায় তার জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। সন্তান না হওয়ায় এই দম্পতিকে একঘরে করে দিয়েছিল প্রতিবেশীরা। তখনই স্বামীর সঙ্গে মিলে অসাধারণ ও ব্যতিক্রমী এক সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ঠিক করেন গাছ লাগাবেন। ওই গাছগুলেতে সন্তান-সন্ততির মতো স্নেহ মমতায় বড় করে তুলবেন। এসব গাছেরাই হবে তাদের সন্তান।

থিম্মাক্কার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই, নেই কোনো বড় ডিগ্রি। গ্রামের আর ৫ জন দরিদ্র ভারতীয় নারীর মতোই শ্রমিক হিসেবে কাজ করে জীবন চালানো এক নারী। কথা বলার সমস্যা থাকায় চিক্কাইয়াকে তার পড়শীরা বলতো তোতলা চিক্কাইয়া। সমাজ বিচ্ছিন্ন লাজুক চিক্কান্না আর থিম্মাক্কার দিনগুলো ছিল বেশ একলা ও বিষণ্ণতায় পূর্ণ। সমাজের বঞ্চনা আর নিঃসঙ্গতা কাটাতেই বৃক্ষদের কাছে আশ্রয় নেন ওই দম্পতি।

প্রথম বছরে ১০টি, দ্বিতীয় বছরে ১৫টি, তৃতীয় বছরে ২০টি বটগাছের চারা লাগালেন। এক সময় এই সন্তানদের দেখাশোনার জন্য দিনমজুরের কাজও ছেড়ে দেন চিক্কাইয়া। থিম্মাক্কা রোজগার করতেন, আর বাড়ি ফিরে স্বামীর সঙ্গে সন্তানসুলভ গাছদের দেখভাল করতেন।

প্রতিদিন প্রায় ৪ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে তারা এই গাছগুলোতে পানি দেওয়ার কাজ করতেন। গবাদি পশুর হাত থেকে চারাগাছগুলোকে বাঁচাতে কাঁটাতারের বেড়াও বানিয়ে দেন। তাদের গ্রাম হুলিকাল থেকে কুদুর অবধি ২৮৪টি বটগাছের চারা লাগিয়ে বড় করেছেন তিনি। প্রায় ৪ কিলোমিটার পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াময় সুবিশাল গাছগুলো থিম্মাক্কার ভালোবাসারই নিদর্শন, বলেন পথচারিরাও।

১৯৯১ সালে স্বামী হারানোর পরও থেমে যাননি থিম্মাক্কা। একাই লড়াই করে যাচ্ছেন সন্তানদের পরিচর্যা ও বড় করতে। আর এইসব বৃক্ষ সন্তানই বদলে দিয়েছে থিম্মাক্কার জীবনযাত্রা। একদিন যারা তাকে একঘরে করেছিলো তাদের কাছেই সমাদৃত এই বৃদ্ধা। থিম্মাক্কার কাজের প্রতি সম্মান দেখিয়ে গ্রামবাসীরা তার নাম দিয়েছে ‘সালুমারাদা’, বাংলায় যার অর্থ ‘গাছদের সারি।’

তবুও সালুমারাদা থিম্মাক্কা লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে যেতেন। স্থানীয়দের মাধ্যমেই তার কথা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৯৯৬ সালে ‘জাতীয় নাগরিক সম্মান’-এ ভূষিত হওয়ার পর তার কথা জানতে পারে গোটা দেশ। বেশকিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা এগিয়ে আসে তাকে সাহায্য করতে।

বর্তমানে থিম্মাক্কার গাছগুলোকে দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে কর্ণাটক সরকার। তবে এতে খুশি নন ওই নারী। কারণ, নিজের সন্তানদের নিজ হাতে যত্নআত্তি করতে পারলেই তিনি বেশি খুশি হতেন।

২০১৬ সালে বিবিসির বিচারে বিশ্বের ১০০ জন প্রভাবশালী নারীদের তালিকায় রয়েছে সালুমারাদা থিম্মাক্কার নামও। আন্তর্জাতিক স্তরের উদ্যোগে থিম্মাক্কা ফাউন্ডেশনও তৈরি হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়।

বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, গত ৮০ বছরে প্রায় ৮ হাজার গাছ লাগিয়ে তাদের বড় করে তুলেছেন ১০৬ বছর বয়সী এই বৃক্ষমাতা। এই অবদানের জন্য এবার ভারতের সম্মানজনক পদ্মশ্রী উপাধি পেয়েছেন। পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে এতবড় অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসাবে আন্তর্জাতিক স্তরেও পেয়েছেন বহু পুরস্কার। থিম্মাক্কাকে ভারতের সবাই এখন এখন একনামে চেনে। তিনি যে সকলের বৃক্ষমাতা।

সন্তানসম গাছেদের সঙ্গে বৃক্ষমাতা থিম্মাক্কা

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত