ঢাকা, শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

চিকিৎসকের একটি ভুলে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে নাসরিন

  দিনাজপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ : ২৪ জুলাই ২০২০, ১৫:৩৩

চিকিৎসকের একটি ভুলে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে নাসরিন

নাসরিন বেগম। বয়স তার সবেমাত্র ২৫। পারিবারিকভাবে তৌহিদুল ইসলামর বিয়ে সম্পন্ন হয় গত ৬/৭ বছর আগে। এই সময় পরিবার স্বামী-শ্বশুর-শ্বাশুড়ি নিয়ে ভালোভাবে জীবন কাটানোর কথা। কিন্তু ৪ বছর পূর্বে পুত্র সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে ডাক্তারের একটি ভুলের কারণে আজ তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছেছেন।

এই বয়সে পরিবার সামলানোর কথা থাকলেও আজ স্বামী, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি মিলে নাসরিনকে সামলাতে হচ্ছে। ডাক্তারের একটি ভুলের কারণে তিনি ভবিষ্যতে সন্তানের মা হওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার পথে। চিকিৎসকের খামখেয়ালির কারণে তৌহিদুলের পরিবারের কান্নায় গোটা গ্রাম কাঁদছে।

তৌহিদুল ইসলাম ভ্যানে করে বিস্কুট, পাউরুটি দোকানে দোকানে বিক্রি করে সংসারের খরচ চালায়। একমাত্র চার বছর বয়সি শিশুর জননী নাসরিনকে চিকিৎসার খরচ যোগাতে পারছেন না।

নাসরিন বেগমে দিনাজপুর জেলার খানসামা উপজেলার আঙ্গারপাড়ার (কসাইপাড়া) মোঃ তহিদুল ইসলামের স্ত্রী।

স্বামী তহিদুল ইসলাম কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, ৬ থেকে ৭ বছর আগে নাসরিন বেগমের সাথে তার পারিবারিকভাবে বিয়ে সম্পন্ন হয়। ২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি গর্ভবর্তী নাসরিনকে খানসামা উপজেলার পাকেরহাটে 'লাইফ কেয়ার' ক্লিনিকে সিজার করানোর জন্য নিয়ে যান। সেখানে খানাসামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী সার্জন ডা. শামসুদ্দোহা মুকুল সিজার করেন। সিজার করার ৬ দিন পর্যন্ত সেই ক্লিনিকে চলে নাসরিনের চিকিৎসা। চিকিৎসা শেষে তাকে বাড়ি নিয়ে গেলে অবস্থার অবনতি হতে থাকে।

তিনি জানান, শিশু জন্মের ৮ম দিন আবারও সেই ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয় নাসরিনকে। সেখানে আবারও করা হয় তার অস্ত্রপচার। সেখানকার কর্তব্যরত নার্সরা তাকে (তহিদুল ইসলাম) জানান, সিজার করার সময় চিকিৎসক ভুলবশত রোগীর পেটের ভেতর তুলা ও গজ রেখে দিয়েছিলেন। সেগুলো অপারেশনের মাধ্যমে বের করা হয়। কিন্তু সেই অপারেশনের পর থেকে রোগী আর সুস্থ হতে পারেনি।

রংপুর, দিনাজপুর, চিরিরবন্দর উপজেলার রানীরবন্দরে অসংখ্য গাইনী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হলেও তিনি আর সুস্থ হতে পারেননি। সর্বশেষ চলতি মাসে দিনাজপুর ইসলামী ব্যাংক কমিউনিটি হাসপাতালের গাইনী বিশেষজ্ঞ ডা. মেহেবুন নাহার মিনুর কাছে নিয়ে যাওয়া হয় নাসরিনকে। তিনি আগামী ৩ মাসের জন্য ওষুধ দিয়েছেন।

তিনি আরও জানান, মানুষের কাছে সুদের ওপর ১৫ হাজার টাকা নিয়ে গৃহবধূর সিজার করেছিলাম। সেই সুদের টাকা প্রতিদিন হাজারে ১০ টাকা করে ১৫০ টাকা দিতে হয়েছে। সেই টাকা পরিশোধ করতে না পারায় আজ সেই টাকা লাভসহ দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার টাকায়। এছাড়াও স্ত্রীর চিকিৎসা করতে গিয়ে গ্রামে আমার অনেক ধার নিতে হয়েছে। এখন মানুষ আমাকে ধারও দিতে চায় না। ভ্যানে করে গ্রামের বিভিন্ন দোকানে ও চায়ের হোটেলে বিস্কুট-পাউরুটি বিক্রি করে কোনমতে সংসার চালাচ্ছি। এর মধ্যে স্ত্রীর চিকিৎসাও করতে হচ্ছে।

অপরদিকে, সাংবাদিকদের সাথে কথা বলা ও সাক্ষাৎকার দেয়ায় তহিদুল ইসলামকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেকে পাঠান ডা. শামসুদ্দোহা মুকুল।

তহিদুল ইসলাম বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ডা. মুকুল লোক পাঠিয়ে আমাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসতে বলে। আমি সেখানে গেলে হাসপাতালের দোতালায় নিয়ে ডা. মুকুল অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। আমাকে বলেন, 'তোর বেটা এত বড় সাহস হইছে যে, তুই সাংবাদিকদের সাথে আমার বিরুদ্ধে কথা বলবি।' ডা. মুকুল আমাকে থানা পুলিশের ভয় দেখাচ্ছে। আমি তো এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।

গৃহবধূ নাসরিন বেগমের মা তহমিনা বেগম বলেন, দিনাজপুরে ইসলামী হাসপাতালের চিকিৎসক বলেছেন ৩ মাসের মধ্যে ওষুধ খেয়ে যদি রোগী সুস্থ না হয় তাহলে রোগীর জরায়ু কেটে ফলতে হবে। নইলে জরায়ুতে ক্যান্সার হবে। ভবিষ্যতে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। চিকিৎসক আমাকে জানিয়েছে যে, প্রথমে রোগীর সিজার করার জন্য ইনফেকশন হয়েছে। সেই ইনফেকশন তার জরায়ু পর্যন্ত চলে গেছে। এখন তো আমরা রোগীকে নিয়ে চরম বেকায়দায় পড়ে গেছি।

নাসরিন বেগমের শাশুড়ি জিন্নাহ বেগম জানান, ছেলেকে বিয়ে দিয়েছি যাতে করে সংসারের হাল ছেলের বউয়ের ওপর ছেড়ে দিতে পারি। আমার বয়স হয়ে গেছে। আমার বিশ্রামের প্রয়োজন। কিন্তু আমি কি বিশ্রাম নিব, উল্টো এখন সংসারের সাথে ছেলের বউকে সামলাতে হচ্ছে। ছেলের বউ একা চলতে পারে না, সার্বক্ষণিক তার কাছে একজনকে থাকতে হয়। আমি তাকে সামলাবো না সংসার সামলাবো।

তিনি বলেন, খুব কষ্ট লাগে ছেলের বউটাকে দেখে। এই বয়সে ৪ বছর ধরে বিছানায় শুয়ে কষ্ট সহ্য করছে। ডাক্তারের ছোট একটা ভুলের কারণে আজ মেয়েটার এই অবস্থা। ডাক্তার যদি এই ভুল না করতো তাহলে আজ আমি বিশ্রাম করতাম আর ছেলের বউ সংসারের হাল ধরতো।

খানসামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক কয়েকজন চিকিৎসক জানান, ২০১৬ সালে যোগদান করা সহকারী সার্জন ডাঃ শামসুদ্দোহা মুকুলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। তিনি সহকারী সার্জন হয়েও পাকেরহাটে অবস্থিত লাইফ কেয়ার ক্লিনিকে নিয়মিত গাইনী চিকিৎসা দিচ্ছেন। এছাড়াও ঠাকুরগাঁও জেলার স্বদেশ ক্লিনিকে তিনি প্রতি বৃহস্পতিবার রোগী দেখেন।

তারা জানান, করোনা চলাকালীন সময়ে তিনি ঠাকুরগাঁওয়ে রোগী দেখছেন না। তিনি এই হাসপাতালে আগত রোগীদের লাইফ কেয়ার ক্লিনিকে বিভিন্ন পরীক্ষা করতে বলেন। এছাড়াও রোগীদের সাথে বিভিন্ন সময় খারাপ আচরণ করছেন। রোগীরা প্রতিবাদ করলে থানা পুলিশেও ভয় দেখায়। সম্প্রতি মারামারির ঘটনায় ১ রোগীর সাথে সার্টিফিকেট তৈরির জন্য ডাঃ মুকুল ২০ হাজার টাকা উৎকোচ চায়। রোগীর স্বজনেরা ডাঃ মুকুলকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট গ্রহণ করে।

ডাক্তার শামসুদ্দোহা মুকুলের কাছে কয়েকজন সংবাদকর্মী সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য যায়। সংবাদকর্মীদের ভিজিটিং নেয়ার পর অন্য কক্ষে বসিয়ে রেখে স্থানীয় সাংবাদিক ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ফোন করে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেন শামসুদ্দোহা মুকুল। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা উপস্থিত হয়ে যায় তার পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য। পরে বসিয়ে রাখা সংবাদকর্মীদের নিকট অন দ্যা ক্যামরার সামনে কোন কথা বলবে না শর্তে তিনি উপস্থিত হন। পরে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের কথা জিজ্ঞেস করার পর তিনি বলেন, 'সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমার দাদু হয়। তিনি আমাকে এই হাসপাতালে বসিয়েছেন।' নাসরিনের সিজার করিয়েছেন স্বীকার করেন তিনি।

পার্শবর্তী ক্লিনিক থেকে কমিশনের আশায় রোগীদের বাধ্য করে বিভিন্ন টেষ্ট করা, রোগীদের সাথে খারাপ আচারণ, ভুল চিকিৎসার, ক্ষমতার দাপট ইত্যাদি জানার জন্য কথা বলায় তিনি উত্তেজিত হয়ে যান। তিনি বলেন, 'আমি মানুষ হিসাবে এত বেশি খারাপ না। আপনার যত অভিযোগ বলছেন তার আংশিক সত্য আছে।'

স্থানীয় ও ঢাকার সাংবাদিকদের ফোন করে নিউজ না করার জন্য দিনাজপুরের সাংবাদিকদের অনুরোধ করেছেন।

দিনাজপুরের সিভিল সার্জন ডা. আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ডাক্তার শামসুদ্দোহা মুকুরের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ের লোক দিয়ে ফোন করানোর অভ্যাস রয়েছে তার। আইনে সবার জন্যই। এই করোনা পরিস্থিতে কোন চিকিৎক চিকিৎসায় অবহেলা করলে সহ্য করা হবে না। তদন্ত করে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক মাহমুদুল আলম বলেন, চিকিৎসাসেবা নিয়ে কেউ ছিনিমিনি করলে বা বাণিজ্য করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত