ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৮ মিনিট আগে
শিরোনাম

ধানমন্ডি লেকের পার্কিং নিয়ে জমজমাট বাণিজ্য

  মো. ফরহাদ উজজামান

প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১৫:৪৩  
আপডেট :
 ২৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১৭:২৮

ধানমন্ডি লেকের পার্কিং নিয়ে জমজমাট বাণিজ্য
দর্শনার্থীদের গাড়ি পার্কিংয়ের স্থানে দিনভর অ্যাম্বুলেন্সের সারি দেখা যায়

প্রকৃতির ছোঁয়া পেতে কার না ভালো লাগে। কিন্তু ইট-পাথরের এই শহরে সেই সুযোগ আর কতটুকু! সে কথা মাথায় রেখেই রাজধানীর বাসিন্দাদের মানুষের প্রশান্তির জন্য তৈরী ধানমন্ডি লেক। সবুজে ঘেরা এই লেকের পরিবেশে মুগ্ধ হয়ে প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এখানে ভিড় করেন। এছাড়া বিভিন্ন দিবসে এখানে থাকে নানা আয়োজন। তবে লেকটি এখন বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

ধানমন্ডি লেকের ৭টি সেক্টরের পার্কিং ইজারা দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এরপর থেকেই লেকে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের প্রাইভেটকার, মোটরবাইক গাড়ি ও নিজ প্রতিষ্ঠানের নামে টোকেন দিয়ে পার্কিংয়ে চাঁদা আদায় করছেন।

উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, ১৯৫৬ সালে লেকসহ ২৪০ দশমিক ৭৪ হেক্টর জমিতে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়। সমগ্র ধানমন্ডি এলাকার প্রায় ১৬ শতাংশ জুড়ে রয়েছে এই লেক। ১৯৯৮-২০০১ সালে ধানমন্ডি লেক এলাকাটি সংস্কার করে বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়।

ধানমন্ডি লেকের পুরো অংশ জুড়ে রয়েছে ওয়াক ওয়ে, যেখানে প্রতিদিন সকাল থেকেই বিভিন্ন বয়সী মানুষদের জগিং করতে দেখা যায়। এছাড়া বিকেলে,সন্ধ্যা ও রাতেও এখানে ব্যায়াম করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন সব বয়সী মানুষ। লেকের নির্দিষ্ট অংশ জুড়ে রয়েছে প্লাস্টিকের প্যাডেল বোট চালানোর সুবিধা। শিশু-কিশোরসহ তরুণ তরুণীদের আকর্ষণের মধ্যে এটা অন্যতম। এছাড়াও তিনটি ছোট ছোট দ্বীপসহ পাঁচটি ব্র্রিজ রয়েছে, যেখানে ঘুরতে আসে তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সের মানুষ। যাদের অনেকের সঙ্গেই থাকে প্রাইভেটকার, মোটরবাইক। লেকে আগত মানুষদের এসব যানবাহন বিনা খরচে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা ছিল সব সময়ই। কিন্তু কয়েক মাস আগে সিটি কর্পোরেশন থেকে পার্কিং এরিয়া ইজারা দেয়ায় গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য দিতে হচ্ছে চাঁদা।

ধানমন্ডি লেকে আসা বিভিন্ন দর্শনার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এমন বাণিজ্যকরণের কারণে দিনে দিনে লেকের সৌন্দর্য বিনষ্ট হচ্ছে। কারণ টাকার বিনিময়ে লোকজন তাদের গাড়ি এখানে দিনভর পার্কিং করে রাখেন। ফলে লেকে আসা লোকজন তাদের গাড়ি রাখার জায়গা পান না। এতে দুর্ভোগের অন্ত থাকে না। ফলে নিয়মিত লেকে প্রাতভ্রমণ বা সন্ধ্যায় যানবাহন নিয়ে আসা মানুষদের বিড়ম্বনার শেষ নেই।

ধানমন্ডি লেকে প্রায় প্রতিদিন মোহাম্মপুর থেকে হাঁটতে আসেন আশরাফুজ্জামান বাবু। তিনি বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, আমি অফিস শেষ করে শরীর ঠিক রাখার জন্য মোহাম্মদপুর থেকে লেকে হাঁটতে আসি। মাঝে মাঝে গাড়ি নিয়েও আসা হয়। এখানে আসার কারণ পরিবেশটা সুন্দর। তবে এখন গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য টাকা দিতে হয়। এটা তো হবার কথা নয়। তাহলে তো লেক ও একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের মতো হয়ে যাবে।

স্থানীয় একজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ জার্নালকে জানান, ছোট থেকেই এখানে বড় হয়েছি। অবসর সময়গুলো এখানেই কাটানো হয়। বিভিন্ন সময় আমার অনেক বন্ধু ও আসে ঘুরতে। তবে দিনে দিনে ব্যাবসা কেন্দ্রিক হয়ে উঠছে লেক। পার্কিংয়ের টাকা খুব বেশি না। তারপরও লেকের মধ্যে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের মনে এটা প্রভাব ফেলবে।

বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবে দেখছেন নগর পরিকল্পনাবিদ এবং স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা জানান, সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধানমন্ডি লেক তার সৌন্দর্য হারিয়েছে। আগের ঠিকাদাররা লেকের সৌন্দর্যের চেয়ে নিজেদের ব্যবসার দিকে বেশি মনোযোগী ছিলেন। এবার যারা ইজারা নিচ্ছেন, তারাও আগের ঠিকাদারদের মতোই বাণিজ্যকে বেশি প্রাধান্য দিলে লেক তার সৌন্দর্য-জৌলুস হারিয়ে ফেলবে।

এ বছরের জুনে ধানমন্ডি লেকের ৭টি সেক্টর ইজারায় সর্বোচ্চ দরদাতাদের তালিকা করেছে ডিএসসিসি। ৭ জন ঠিকাদার সর্বোচ্চ দরদাতা নির্বাচিত হয়েছেন। এদের দাবি তারা নিয়ম মেনেই সিডিউল কিনে ইজারা পেয়েছে।

ধানমন্ডি লেকের ইজারার কাজটি সম্পন্ন করছে ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগ। এই বিভাগ সূত্র জানায়, যারা লেকের ইজারা পেয়েছেন তারাই নিজ নিজ সেক্টর সীমানা এলাকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত এবং অবকাঠামো ও স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। কার্যাদেশে এমন শর্তই উল্লেখ আছে।

ধানমণ্ডি লেকের ৭টি সেক্টরের পার্কিং

ধানমন্ডি ২৭ নম্বর (নতুন ১৬) সড়ক থেকে ধানমন্ডি ৩২ (নতুন ১১) নম্বর সড়কের সেতু পর্যন্ত এলাকাটি ১ নম্বর সেক্টর। এই সেক্টরে ৮টি গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা রয়েছে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর (নতুন ১১) সেতু থেকে মিরপুর রোডের শেখ রাসেল স্কোয়ার হয়ে শেখ রাসেল শিশু পার্কসহ কলাবাগান মাঠের উত্তর সীমানা পর্যন্ত এলাকাটি ২ নম্বর সেক্টর। এখানে ৩০টি পার্কিংয়ের জায়গা রয়েছে।

ধানমন্ডি ৩২ নম্বর (নতুন ১১) সেতু থেকে ধানমন্ডি ১৬ (নতুন ১২ এ) নম্বর সড়কের সেতু পর্যন্ত ৩ নম্বর সেক্টর। এই সেক্টরে রয়েছে ২০টি ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা। ধানমন্ডি ১৬ নম্বর সড়কের (নতুন ১২ এ) লেকের পশ্চিম দিকের সংযুক্ত সড়ক থেকে ধানমন্ডি ৮ নম্বর সড়কের সেতু পর্যন্ত ৪ নম্বর সেক্টর। এই সেক্টরে ৬টি পার্কিংয়ের জায়গা রয়েছে। ধানমন্ডি ৮ নম্বর সেতু থেকে কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডের পেছনের প্রকল্প এলাকা পর্যন্ত ৫ নম্বর সেক্টর, এই সেক্টরে ২০টি পার্কিংয়ের জায়গা রয়েছে। ধানমন্ডি ৮ নম্বর সেতু থেকে ধানমন্ডি ৬ নম্বর সড়কের লেকের পূর্ব অংশ পর্যন্ত লেকের ৬ নম্বর সেক্টর। এই সেক্টরে ১২টি গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা রয়েছে। ধানমন্ডি ৮ নম্বর সড়কের সেতু থেকে সাত মসজিদ সড়কের দুইটি অংশ তথা সুগন্ধা কমিউনিটি সেন্টারের বিপরীত পাশ পর্যন্ত এবং বিজিবি ফটক থেকে বিপরীত পাশ পর্যন্ত এলাকাটি ৭ নম্বর সেক্টর। এই সেক্টরের আয়তন অন্যান্য সেক্টর থেকে অনেক বড়। এখানে ৩২টি পার্কিংয়ের জায়গা রয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ধানমন্ডি লেকের বিভিন্ন জায়গাগুলোতে ইজারাদারদের নিযুক্ত কর্মচারীরা গাড়ির পার্কিং চাঁদা আদায় করছে। প্রাইভেটকার/জিপ/মাইক্রোবাস থেকে দুই ঘণ্টায় ৩০ টাকা নেয়া হচ্ছে, প্রতিটি মোটরসাইকেলের জন্য ২০ টাকা পার্কিং চাঁদা নেয়া হচ্ছে। এরপর পরবর্তী প্রতি ঘণ্টায় ১০ টাকা করে নেয়া হয়। এছাড়াও লেকের তিন নম্বর সেক্টরে পার্কিংয়ে স্থায়ীভাবে অ্যাম্বুল্যান্স রাখার কথাও জানা যায়।

লেকের তিন নম্বর সেক্টরের গাড়ি পার্কিংয়ের দায়িত্বে থাকা জাকারিয়া জানান, স্কুল কলেজগুলো খোলা থাকলে সকালে গাড়ি পার্কিং বেশি হয়। সন্ধ্যায়ও কিছু পার্কিং হয়। তবে দুপুরে গাড়ি পার্কিং একদম থাকে না। অ্যাম্বুল্যান্সের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা ইজারাদারের সঙ্গে মাসিক চুক্তিতে রাখে।

লেকের বাণিজ্যকরণের বিষয়ে জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ঘনবসতিপূর্ণ এই নগরে মানুষের নিঃশ্বাস নেয়ার জায়গা কম। বেড়ানোর জায়গা নেই বললেই চলে। তাদের কথা মাথায় রেখেই ধানমন্ডি লেক তৈরি করা হয়েছিল। এখন এই লেকটি বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। লেকটি রক্ষায় নগর প্রশাসনকে আরও তৎপর হতে হবে।

এবিষয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর শিরিন গাফ্ফার বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, আমাকে তো সিটি কর্পোরেশন থেকে ইজারা দিয়েছে। ৪ নম্বর সেক্টরের গাড়ি পার্কিংয়ের দুইটা জায়গা আছে। সামনে একটা এবং পেছনে একটা। লেকে আসা দর্শনার্থীদের জন্য এই পার্কিং সুবিধা থাকারা কথা তাহলে ইজারা নিয়ে বাণিজ্যকরণ করা ঠিক হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি এসব জানি না। সিটি কর্পোরেশন থেকে ইজারা দিয়েছে। সিডিউল বিক্রি করেছে, আমরা সিডিউল কিনে ইজারা পেয়েছি।

জানা যায়, ধানমণ্ডি লেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের জায়গা। এর আগে এ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার জানান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং গণপূর্ত মন্ত্রণালয় দুটোই সরকারের। তবে ধানমণ্ডি লেক গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের জায়গা।

লেকের পার্কিংয়ে ইজারার বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা রেজাউল করিম সিদ্দিকী বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, লেক কখনো ইজারা দেয়া যায় না। তবে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন থেকে লেকের পার্কিং ইজারা দিয়েছে কিনা এবিষয় আমাদের জানা নেই। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।

লেকের সাতটি সেক্টর ইজারায় দরপত্র ঘিরে নানা আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিনের সঙ্গে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

এবিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, সাতটি সেক্টরের বিভিন্ন ফুড কোর্ট, রেস্টুরেন্টের ইজারার বিষয়ে জানি। তবে পার্কিং ইজারা দেয়া হয়েছে কিনা জানা নেই।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ এ বিষয়ে বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, লেক এরিয়ায় শৃঙ্খলা ফেরাতেই পার্কিং ইজারা দেয়া হয়। জনগণের স্বার্থেই এটি করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, যারা গাড়ি নিয়ে যাবেন তারা যেন নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি রাখেন। যেখানে সেখানে গাড়ি রেখে যেন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি না করা হয় সে কারণেই পার্কিং ইজারা। পুলিশের সহযোগিতায় বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ জার্নাল/আরকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত