ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১১ মিনিট আগে
শিরোনাম

ওসির যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চায় রাজনগরবাসী!

  এম এ কাইয়ুম, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি

প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২২, ১৭:৫৯  
আপডেট :
 ২১ জানুয়ারি ২০২২, ১৮:০৪

ওসির যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চায় রাজনগরবাসী!
রাজনগর থানার ওসি নজরুল ইসলাম

মৌলভীবাজারের রাজনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম। গত বছরের ১০ জুন রাজনগর থানায় ওসি হিসেবে যোগ দেন নজরুল। এরপরেই বদলে যেতে থাকে রাজনগরের চিত্র। জিডি থেকে শুরু করে পারিবারিক সালিশ, সবকিছুতেই উপস্থিত ওসি নজরুল ইসলাম। গ্রেপ্তার বাণিজ্যসহ সবকিছু থেকেই তার ঘুষ নেয়া এখন ওপেন সিক্রেট। ভয়ে এলাকায় মানুষ বিপদে পড়লেও থানায় যেতে চাইছে না।

এসব বিষয়ে একের পর এক অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না এলাকাবাসী। সর্বশেষ অভিযোগ গেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এর আগে এসপি, ডিআইজিসহ বিভিন্ন পর্যায়ে অভিযোগ গেলেও কোনো পরিবর্তন আসেনি। সরশেষ ইউনিয়ন নির্বাচনে তার ঘুষের বাজার আরও জমজমাট হয়ে ওঠে বলে অভিযোগ।

রাজনগর উপজেলার বিভিন্ন জনের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, টাকা ছাড়া রাজনগর থানায় কিছুই হয় না। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় গরু, ছাগল, মোরগ পর্যন্ত ঘুষ দেয়ার কথা জানান অনেকে। তবে হয়রানীর ভয়ে অন দ্যা রেকোর্ডে কেউ কিছু বলতে চান না। স্থানীয়দের মুখে মুখে রাজনগর থানার ওসির ঘুষ বাণিজ্য।

রাজনগর উপজেলা ছাত্রলীগ ও জেলা শ্রমিক লীগের দুই নেতা হয়রানির ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের কাছে একটা গরু দাবি করেন ওসি নজরুল। গরু দেয়ার জন্য বিভিন্ন অফিসারদের পাঠিয়ে বারবার চাপ দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে ওসি জানান, ৬০ হাজার টাকা দিয়ে গরু কিনে ফেলছি, আপনাদের গরু দিতে হবে না, নগদ টাকা দিয়ে দেন। পরে হয়রানির ভয়ে আমরা টাকা দিয়ে দেই। এভাবে ওসি অনেকের কাছ থেকেই টাকা নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন। থানার নানা উন্নয়নের কথা বলে, কখনো থানায় এসি স্থাপনের কথা বলে টাকা নেন। সুযোগ পেলে ওসি চান নিজের হাতে পকেট থেকে টাকা নিয়ে নিতে। মানুষ এতটা ভয়ে থাকে যে, বিপদে পড়লেও থানায় যেতে চায় না। পুলিশ বিভাগে এমন অফিসার দেশের কোথাও আছে কিনা আমাদের জানা নেই।’

ছাত্রদলের সাবেক এক নেতা ওসির রোষানলে পড়ে নিঃস্ব হয়ে এলাকা ছেড়েছেন বলে দাবি করেছেন। বর্তমানে তিনি কোনো রাজনৈতিক ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত না থাকার বিষয়টিও নিশ্চিত করেছেন।

এছাড়া বাদ যাচ্ছে না গরীব দিনমজুররাও। রাজনগর উপজেলার পাচগাও ইউনিয়নের একটি ব্রিক ফিল্ডের শ্রমিক বকুল মিয়া। প্রতিবেশীর সাথে তার রাস্তা নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে প্রতিকার চেয়ে থানায় যান। ওসি প্রথমে মামলা করতে বলেন। বকুল মিয়া তাতে রাজি না হলে ওসি ধমক দিয়ে বকুল মিয়াসহ তার সাথে যারা ছিল সবার স্বাক্ষর রাখেন। দুইদিন পর বাড়িতে পুলিশ হাজির হয়ে বুকুলের ভাইকে আটক করে। পুলিশ তখন ১ লাখ টাকা দাবি করে। পরে বকুল মিয়া জানতে পারেন পুলিশ উল্টো তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। তখন বকুল মিয়া বুঝতে পারেন যে, তার স্বাক্ষর রেখে ওসি মামলা সাজিয়েছেন। যদিও পরে বাধ্য হয়ে ঋণ করে একবার ৫ হাজার, আরেকবার সাড়ে ৪ হাজার টাকা নিয়েছেন পুলিশকে। সেইসাথে মামলার কারণে নিয়মিত আদালতে দৌড়াচ্ছেন বকুল মিয়া।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তরুণ জানান, বিদেশের জন্য পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের প্রয়োজন হয়, এজন্য ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন ওসি। তিনি বলেন, আমি বাধ্য হয়ে টাকা দিয়েছি, কারণ পুলিশ ক্লিয়ারেন্সটা আমার খুব প্রয়োজন ছিলো। সাধারণ মানুষ ভয়ে এখন থানায় যায় না। থানায় গেলেই টাকা দিতে হয়। বাদী-বিবাদী সবাইকেই টাকা দিতে হয়।

উপজেলার মনসুরনগর ইউনিয়নের আশ্রাকাপন গ্রামের ফয়েজ চৌধুরী বাচ্চুর বাড়ির রাস্তা নিয়ে প্রতিবেশীর সাথে ঝামেলা হয়। পরে ওসি ৩২ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে দেন। যদিও এমন অভিযোগ নতুন নয় এই ওসির বিরুদ্ধে।

গত ৩১ আগস্ট পুলিশ সুপার বরাবর ওসির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন কামারচাক ইউনিয়নের হরিপাশা গ্রামের প্রবাসী শায়েস্তা মিয়া। তিনি তার নিজ বাড়িতে গাড়ির গ্যারেজ বানাতে গিয়ে প্রতিবেশীর সাথে ঝামেলায় পড়েন। এ নিয়ে সালিশ হলে সেখানে যান ওসি। জায়গা ছেড়ে দিতে প্রবাসীকে চাপ দিতে থাকেন।

এছাড়া সম্প্রতি শেষ হওয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ব্যাপক ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে ওসি নজরুলের বিরুদ্ধে।

রাজগনর উপজেলার একটি ইউনিয়ন পরিষদের নবনির্বাচিত এক চেয়ারম্যান নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, নির্বাচনে ওসিকে পক্ষে রাখতে সবাই চেষ্টা করবে। আমিও যতটুকু করার করেছি। তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে, সাধারণ মানুষ বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে। সালিশযোগ্য ঘটনায় কেউ থানায় গেলে ওসি দুই পক্ষকে দিয়ে দুইটি ডায়রি করান। পরে উভয় পক্ষকে ডেকে মামলা থেকে বাঁচিয়ে দেয়ার নাম করে টাকা নেন। এই উপজেলার প্রতিটি এলাকার মানুষ ও ইউপি চেয়ারম্যানরা ওসির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ।

টেংরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান টিপু খান বলেন, সম্প্রতি শেষ হওয়া নির্বাচনের সময় ওসি নজরুল এমন কোনো প্রার্থী নেই যার থেকে টাকা নেননি। সব চেয়ারম্যান ও মেম্বার প্রার্থীদের থেকে চাপ দিয়ে টাকা নিয়েছেন। এই ওসি থাকলে রাজনগরের আইনশৃঙ্খলার অবস্থা আরও অবনতি হবে। তাই আমরা জনপ্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওসির থেকে দূরুত্ব বজায় রাখবো।

চেয়ারম্যান টিপু খান আরও বলেন, আমার বাসায় হামলার ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনায় আমি মামলা করি। কিন্তু মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার না করে ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার শুরু করেন ওসি। ৮ জন ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে বাণিজ্য করেন। পরে আমি এই বিষয়ে প্রতিবাদ জানাই। আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে এসে ওসিকে এই বিষয়ে সরাসরি প্রশ্ন করি। তখন তিনি সব চেয়ারম্যান এবং উপজেলার চেয়ারম্যানের সামনে উল্টো আমাকে ১০টি মামলায় জড়ানোর হুমকি দেন। আমার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৪টি মামলা হয়েছে বলে শুনেছি। আমার অপরাধ ছিল গ্রেপ্তার বাণিজ্যের প্রতিবাদ করা।

গত ১৩ জানুয়ারি রাজনগর উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় আলোচনা করে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানসহ ৮টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যানরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ওসির অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে। সেদিন আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় একের পর এক প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় ওসিকে।

রাজনগর উপজেলার চেয়ারম্যান শাহাজান খান বলেন, ওসির বিরুদ্ধে এইসব অভিযোগ মানুষের মুখে মুখে রটে আছে। ওসি বিজয় দিবসেও যথাযথ সম্মান জানাননি। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে ইউনিফর্মধারী হিসেবে স্যালুটরত অবস্থায় থাকার বিধান থাকলেও এসি জাতীয় পতাকাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন না করে দাঁড়িয়ে থাকেন।

সম্প্রতি দেশে আসেন ফ্রান্স আওয়ামী লীগের পর্যটন বিষয় সম্পাদক বাদল মিয়া। তিনি জানান, মোটা অঙ্কের ঘুষ দেয়ার পরেও তার বিরুদ্ধে ৩টি মামলা দেন ওসি। বাদীকে ম্যানেজ করে হয়রানি করেন ওসি। তিনি বিষয়টি জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের নজরে আনেন। নেতৃবৃন্দ ওসিকে ফোনে বলে দেন বিষয়টি দেখার জন্য। তখন বিষয়টি দেখবেন বললেও রাতেই বাদলকে ফোন দিয়ে ওসি বলেন, এইগুলা করে লাভ নেই। সাইনতো (স্বাক্ষর) আমি করবো।

এরপর বাদল মিয়া বন পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাবউদ্দিনের সাথে দেখা করে ঘটনার বিস্তারিত অবগত করেন। তখন মন্ত্রী ওসিকে ফোন দিয়ে বিষয়টি মীমাংসার জন্য এবং প্রবাসী নেতাকে হয়রানি না করার জন্য বলে দেন। সেইদিন গভীর রাতে বাদল মিয়াকে মোবাইল ফোনে কল দিয়ে ওসি বলেন, ‘মামলার কাগজ আমার হাতে, মন্ত্রী আপনাকে বাঁচাতে পারবে না।’ পরে এই প্রবাসী হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে গোপনে ফ্রান্স চলে যান। সেখান থেকে ফেসবুক লাইভে এসে এই অভিযোগগুলো করেন।

রাজনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিলন বখত বলেন, রাজনগরের ইতিহাসে এমন ওসি আগে আসেননি। ওসি যখন প্রথম এখানে আসেন আমি নিজেও উনাকে বলেছিলাম যে, নতুন ওসি হয়েছেন সুযোগ আছে ভালো কিছু করার। কিন্তু সার্বিক দিক মিলিয়ে অবস্থা ভালো না।

এসব বিষয়ে অভিযুক্ত ওসি নজরুল ইসলাম জানান, আমার কারণে যাদের স্বার্থ হাসিল হয়নি তারা হয়তো অভিযোগ দিচ্ছে। বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রতিটি মামলাতে এক পক্ষ খুশি হয়, অন্য পক্ষ মনঃক্ষুণ্ণ হয়- তারাই এসব রটায়।

মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, কিছু অভিযোগের তদন্ত চলছে। যেসব অভিযোগ এসেছে, তা তদন্ত করে আমরা ব্যবস্থা নেবো। সব বিষয় আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখবো।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত