ঢাকা, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

বিয়েবাড়িতে বরের বর্বরতা, বৃদ্ধকে পিটিয়ে হত্যা

‘চোখের সামনে বাবাকে মরতে দেখেছি বাঁচাতে পারিনি’

‘চোখের সামনে বাবাকে মরতে দেখেছি বাঁচাতে পারিনি’
নাজিমুল হক

ওরা আমার ভাইকে নিচে ডেকেছিল। ভাইয়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হবে ভেবে বাবা, আমি আর ভাবীও নিচে নেমে আসি। আমরা লিফট থেকে নামার পরপরই তারা বলতে থাকে ‘নিবিড় কে, নিবিড় কে। তুই নাকি অনেক ইংরেজি জানিস। সবসময় নাকি ইংরেজিতে কথা বলিস। আয় তোকে বাংলা শিখিয়ে দেই। এরকম কথা বলেই তারা আমার ভাইকে মারধর শুরু করে। তখন আমরা তাদের আটকানোর চেষ্টা করি। কিন্তু তারা আমাদের সবাইকে মারধর শুরু করে। চড়-থাপ্পড়, ঘুষি দিয়ে আমার বাবাকে নিচে ফেলে দেয়। বাবা হার্টের রোগী, দম নিতে পারছিলেন না। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়েন। আমি তাকে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তারা আমাকে বাবার কাছে যেতে দেয়নি। চোখের সামনে আমি আমার বাবাকে মরতে দেখেছি। কিছুই করতে পারিনি। আমি ওদের হাত থেকে বাবাকে বাঁচাতে পারেনি। কাঁদতে কাঁদতে এসব বলছিলেন নিহত নাজিমুল হকের মেয়ে নাফিসা আক্তার নিশি। নিশি বলেন, আমার বাবা তো অন্যায় কিছু করেননি। কোনো অপরাধ করেননি কেন তাকে ওরা মারলো। একজন অসুস্থ মানুষকে তারা হত্যা করেছে।

উচ্চস্বরে গান বাজানোর প্রতিবাদ করায় শুক্রবার রাজধানীর ওয়ারী থানার গোপীবাগের দ্বিতীয় লেনের লা-ক্যাসেন্ডায় নাজিমুল হক নামের ৬৫ বছরের এক বৃদ্ধকে পিটিয়ে হত্যা করে ওই বাসার ছয় তলার বাসিন্দারা। এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক নাজিমুল ভূমি মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। এই ঘটনায় নিহতের ছেলে নাসিমুল হক বাদী হয়ে সাতজনের বিরুদ্ধে অজ্ঞাতনামা আরো ২/৩ জনের বিরুদ্ধে ওয়ারী থানায় মামলা করেছেন।

ওয়ারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, নিহতের ছেলে কয়েকজন আসামির নাম উল্লেখ করে মামলা করেছেন। আমরা সেই মোতাবেক মো. আলতাফ হোসেন, তার ছেলে মো. সাজ্জাদ হোসেন, মেয়ে রায়হান হাসনিন ও জামাতা মির্জা জাহিদ হাসানকে আটক করেছি। তাদেরকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়েছি। কিন্তু আদালত একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা ওই দিনের ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছে। শনিবার ওই এলাকার সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ শোকাহত পরিবারের সদস্যদের বলেছেন, এ ধরনের ঘটনায় আসামিরা কখনই ছাড় পাবে না। তারা যতই শক্তিশালী হোক না কেন কয়েকদিনের ভেতরেই তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হবে।

মামলার এজাহার ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাত আনুমানিক ১২টা। লা-ক্যাসেন্ডার ১১ তলার ছাদে ভাগ্নে হৃদয়ের গায়ে হলুদের পার্টি করছিলেন একই ভবনের ছয় তলার বাসিন্দা আলতাফ হোসেন। গায়ে হলুদের পার্টিতে উচ্চস্বরে হিন্দি-ইংরেজি গান বাজছিল। অনুষ্ঠানে আগত অনেকেই কোমলপানীয় খেয়ে গানের তালে তালে নাচানাচি করতে থাকেন। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত উচ্চস্বরে সাউন্ড ও নাচানাচিতে আশেপাশের অনেকের ঘুমের সমস্যা হয়। ওই ভবনেরই ৮ তলার বাসিন্দা নাজিমুল হক। হার্ট ও কিডনির রোগী। উচ্চ শব্দের কারণে ঘুমাতে পারছিলেন না তার স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও। উপায়ান্তর না পেয়ে নাজিমুল হকের ছেলে নাসিমুল হক নিচে গিয়ে বাসার কেয়ারটেকার বশিরকে বিষয়টি অবগত করেন। একইসঙ্গে ওই অনুষ্ঠানটি কে করছে জিজ্ঞেস করলে বশির জানায়, আলতাফ হোসেনের কথা। পাশে বসিয়ে আলতাফ হোসেনকে সাউন্ড কমিয়ে গান বাজানোর অনুরোধ করলে উভয়ের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। পরে দুজনই নিজ বাসায় চলে যান।

পরের দিন সকাল সাড়ে ১১টায় আলতাফ হোসেন ও তার পরিবার ও আত্মীয়স্বজনসহ ১০/১২ জন সদস্য নিচে এসে নাসিমুল হককে ডেকে পাঠান। তখন নাসিমুল হক, তার বাবা নাজিমুল হক, বোন নাফিসা আক্তার নিশি ও স্ত্রী সাদিয়া নাসরিন নিচে আসেন। সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন আলতাফ হোসেনের পরিবারের সদস্যরা। পরে নাসিমুল ও তার পরিবারের সদস্যরা নিচে আসার পরপরই কিছু বুঝে ওঠার আগেই মামলার ১ নং আসামি আলতাফ হোসেনের নির্দেশে তার ভাগ্নে ৩ নং আসামি হৃদয় নাসিমুলকে কিল- ঘুষি, চড়-থাপ্পড় দিতে শুরু করে। তখন ২ নং আসামি সাজ্জাদ হোসেনও মারধর শুরু করে। একই সঙ্গে আমার বোন ও বাবা তাদেরকে আটকানোর চেষ্টা করলে ৪ নং আসামি রাইয়ান হাসনিন, ৫ নং আসামি জিনাত আরা, ৬ নং আসামি হোসনে আরা ও ৭ নং আসামি মির্জা জাহিদ তাদের ওপর চড়াও হয়। একপর্যায়ে নাজিমুল হক গুরুতর আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।

নিহতের পুত্রবধূ সাদিয়া নাসরিন বলেন, আমার শ্বশুর যখন অসুস্থ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন তখন তারা সামনের প্রধান গেটটি বন্ধ করে দেয়। যাতে করে আমরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে না পারি। আমরা গেট খোলার চেষ্টা করলে তারা আমাদের ওপর আবার ধেয়ে আসে। পরে আমার স্বামীই তাকে গাড়ি দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যান। সাদিয়া বলেন, আমরা কল্পনাও করতে পারিনি এরকমটা হবে।

ওই বাড়ির কেয়ারটেকার মো. বশির উদ্দিন বলেন, ওই রাতে নাসিমুল হক এসে আমাকে কার অনুষ্ঠান চলছে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনি তখন ছাদেও যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি তাকে আলতাফ হোসেনের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেই। পরে তাদের মধ্যে ইংরেজিতে তর্ক চলে। এক পর্যায়ে আমি ও আলতাফ হোসেন উপরে গিয়ে অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেই। পরের দিন আলতাফ হোসেনের পরিবারের কয়েকজন নিচে এসে নাসিমুলের ফ্ল্যাটে যেতে চাইলে আমি বাধা দেই। খবর দিয়ে তাদেরকে নিচে নিয়ে আসি। তারপর এই ঘটনা ঘটে।

নিহত নাজিমুল হকের সামনের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা কাজল কুমার রায় বলেন, আমি তখন নাস্তা করতে বসেছিলাম। হঠাৎ আন্টি এসে বললেন নিচে যাওয়ার জন্য। আমি নিচে গিয়ে দেখি এর আগেই সবকিছু হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, নিহত নাজিমুল হক আমাকে নিজের ছেলের মতো দেখতেন। তিনি অনেক ভালো ছিলেন।

প্রতিবেশী রাজ্জাকুল হায়দার বলেন, তিনি অনেক ভালো ও মিশুক প্রকৃতির লোক ছিলেন। তাকে আমরা এলাকার অনেকেই দুলাভাই হিসেবে ডাকতাম। কিন্তু এ ধরনের একটা ঘটনার জন্য এই যুগের ডিজে পার্টিই দায়ী। এই ডিজে পার্টির কারণেই আরো অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটবে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ওয়ারী জোনের সহকারী কমিশনার সোহেল রানা বলেন, ঘটনাটা অনাকাঙ্ক্ষিত। একটি শব্দ দূষণকে কেন্দ্র করে এমনটা হয়ে গেল। আমরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত চারজনকে আটক করেছি। বাকি আসামিদেরকে আটক করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ভিডিও ফুটেজ দেখে আসামিদের শনাক্ত করেছি। তাদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করেছি। আমাদের দুটি স্পেশাল টিম বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।

তিনি আরো বলেন, আমরা ধারণা করছি ও আসামিদের সঙ্গে কথা বলে এটুকু বুঝেছি রাতে নাসিমুল হকের সঙ্গে কথা কাটাকাটির বিষয়টি আলতাফ হোসেন তার ছেলেমেয়েদেরকে বলেছেন। হয়তো বিষয়টি তিনি অপমানজনক মনে করেছেন। আর তাই হয়তো আলতাফ হোসেনের ছেলেমেয়েরা বাবাকে অপমান করার প্রতিশোধ নিতে পরের দিনের ঘটনাটি ঘটিয়েছে।

/এসকে/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত