ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২৮ মিনিট আগে
শিরোনাম

ভুয়া নাম-পরিচয়ে প্রেম-পরকীয়ায় কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন তিনি!

  নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ : ১৩ জানুয়ারি ২০২৩, ১৮:৫২

ভুয়া নাম-পরিচয়ে প্রেম-পরকীয়ায় কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন তিনি!
গ্রেপ্তার হওয়া প্রতারক। ছবি: প্রতিনিধি

ভুয়া নাম-পরিচয় ব্যবহার করে বহুমাত্রিক প্রতারণার মাধ্যমে একের পর এক নারীর সঙ্গে প্রেম ও পরকীয়ার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া এক প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তার নাম- এমডি বিল্লাল ফারদিন ওরফে মাসুম বিল্লাহ ফারদিন ওরফে রাজু ওরফে রাজুউল্যা রাজু (৩৭)।

রাজধানীর কলাবাগান থানায় দায়ের করা একটি মামলায় তাকে গত বুধবার গুলশান এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ (উত্তর)। এরপরই তার আসল পরিচয়সহ প্রতারণার নানান তথ্য বেরিয়ে আসে।

ডিবি বলছে, ভুয়া নাম-পরিচয় দিয়ে এই যুবক কমপক্ষে ৪০ নারীর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তার আসল নাম রাজুউল্যা রাজু (৩৭)। নারীদের প্রেম-পরকীয়ার ফাঁদে ফেলে প্রতারণার মাধ্যমে নারীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।

গ্রেপ্তার যুবককে জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরে গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, এমডি বিল্লাল ফারদিনের আসল নাম রাজুউল্যা রাজু। তবে ভিন্ন ভিন্ন নাম-পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করতেন তিনি। কারও কারও কাছে তিনি মাসুম বিল্লাহ ফারদিন ওরফে রাজু নামেও পরিচিত। প্রতারণা করতে তিনি কখনো নিজেকে গাজীপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রহমত আলীর ছেলে, আবার কখনো মন্ত্রী ও পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তার আত্মীয় হিসেবেও পরিচয় দিতেন। ২০১৩ সালে সর্বপ্রথম নওগাঁ সদর থানার একটি প্রতারণা মামলায় গ্রেপ্তার হন রাজু। এরপর বিভিন্ন পরিচয়ে নারীদের সঙ্গে প্রেম-পরকীয়ার সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে প্রতারণা করতে থাকেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বিভিন্ন প্রতারণায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর হাজারীবাগে এক নিঃসন্তান দম্পতি আড়াই বছর বয়স থেকে রাজুকে লালন-পালন করেন। কিশোর বয়সে নানা অপরাধে জড়ানোর পর বাসা থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যান তিনি। ২০১৩ সালের পর প্রতারণা মামলায় একাধিকবার গ্রেপ্তার হন রাজু। তবে জামিনে বের হয়ে আবার প্রতারণা শুরু করেন।

পুলিশ জানায়, ২০১৩ সালে সরকারি কর্মকর্তা পরিচয়ে নওগাঁয় অর্থ আত্মসাৎ করতে গিয়ে ধরা পড়েন রাজু। পড়াশোনা খুব বেশি না করলেও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও আমেরিকা থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন বলে প্রচার করতেন। পরিবারের ইতিহাস ও নাম বদলে মাসুম বিল্লাহ ফারদিন বলে পরিচয় দিতেন। নিজের আগের পরিচয় লুকাতে অন্য এক ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্রে রাজু তার ছবি বসিয়েছিলেন। হোটেলে হোটেলে ছিল তার বসবাস। এরই মধ্যে একাধিক তরুণী প্রতারণার শিকার হয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন। এরপরই রাজুকে গ্রেপ্তার করে দুই দিনের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।

ডিবি জানায়, রাজু প্রথমে দাবি করেন, কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন। এরপর দাবি করেন, টেনেটুনে এসএসসি পাস করেছেন। নিজের গ্রামের বাড়ি ও মা-বাবার আসল পরিচয় সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারেননি। এরপর রাজুকে যে দম্পতি লালন-পালন করেছেন, তাদের খোঁজে নামেন গোয়েন্দারা। ডিবি কার্যালয়ে ওই দম্পতিকে ডেকে আনা হয়। তারা জানিয়েছেন, কৈশোর থেকে নানা অপরাধে জড়িয়ে যাওয়ায় রাজুকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন ভুয়া পরিচয়ে ফেসবুক আইডি অলঙ্কৃত করে সুন্দরী নারীদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতেন রাজু। মেয়েদের আকৃষ্ট করতে ফেসবুকে চার লাখ ফলোয়ার বানান। কেউ ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টে সাড়া দিলেই হাই/হ্যালো শুরু করে নিজেকে সাবেক এমপি রহমত আলীর দ্বিতীয় ঘরের সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতেন। এছাড়াও প্রেমের ফাঁদে ফেলতে নারীদের দামি গিফট পাঠাতেন। কেউ প্রেমের ফাঁদে পা দিলে নিয়মিত পাঁচতারকা হোটেলে লাঞ্চ ও ডিনারের জন্য নিয়ে যেতেন। শপিং করে দিতেন নামিদামি শপিংমল থেকে। ধনাঢ্য নারীদের পরকীয়ার ফাঁদে ফেলে নিয়মিত সিসা বার ও স্পা সেন্টারে গিয়ে যেতেন। এরপরই সুকৌশলে প্রতারণা শুরু করতেন তিনি।

এছাড়াও বিদেশে পাঠানো, সরকারি চাকরি দেয়া ও বদলির প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতেন। এজন্য তিনি বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কাগজপত্র ফেসবুক থেকে ডাউনলোড করে সফটওয়্যারের মাধ্যমে এডিট করে নিজের নামের সঙ্গে পছন্দের পদবী বসিয়ে ভিকটিমদের মেসেঞ্জার ও ওয়াটসআপে পাঠাতেন।

ডিবি জানায়, শুধু এমপির ছেলে হিসেবে নয়, ফারদিন নিজেকে মন্ত্রীর ভাই, কণ্ঠশিল্পী, পুলিশের স্বামী, সেনা কর্মকর্তার স্বামী, ট্যুরিজম বোর্ডের এক্সিকিউটিভ, বিপিএলের ফ্রাঞ্চাইজি ফরচুন বরিশালের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদের যুগ্ম মহাসচিবসহ বিভিন্ন পরিচয় ব্যবহার করে প্রতারণা করেছেন। তিনি নীলক্ষেত থেকে গ্রিন কার্ডসহ ২১টি প্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র বানিয়েছিলেন।

রাজুর বিরুদ্ধে গত ৫ জানুয়ারি রাজধানীর কলাবাগান থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া মামলায় (নম্বর-২) এক ভুক্তভোগী নারী উল্লেখ করেন, ফেসবুকে পরিচয়ের সূত্র ধরে রাজু তাকে বড় বোন বানিয়ে পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। একপর্যায়ে রাজু নিজেকে এমপির ছেলে পরিচয় দিয়ে জাইকা প্রজেক্টের আওতায় জাপান পাঠানোর কথা বলে ১৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন।

ডিবি জানায়, রাজু ২০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রতারণা করে আসছিলেন। তিনি বিভিন্ন পরিচয় ব্যবহার করতেন। টাকাপয়সা আছে এমন নারীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতেন। গ্রেপ্তারের পর তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তিনি প্রতারণার মাধ্যমে প্রায় অর্ধশত নারীর কাছ থেকে ৫০ কোটি টাকা হাতিয়েছেন।

রাজুর প্রতারণার বিষয়ে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের ওয়েব বেইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের ইনচার্জ এডিসি আশরাফুল্লাহ বলেন, আড়াই বছর বয়স থেকে হাজারীবাগের এক নিঃসন্তান পরিবারে বেড়ে ওঠা ফারদিন মাত্র ১২ বছর বয়সেই অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ২০১৩ সালে সর্বপ্রথম নওগাঁ সদর থানার একটি প্রতারণা মামলায় গ্রেপ্তার হন তিনি। এরপর বিভিন্ন পরিচয়ে নারীদের সঙ্গে প্রেম-পরকীয়ার সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে প্রতারণা করতে থাকেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বিভিন্ন প্রতারণায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। বিষয়টি আরও গভীরভাবে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি প্রধান) মোহাম্মদ হারুন অর-রশীদ বলেন, রাজু ভুয়া পরিচয় দিতেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলতেন। পরে এসব ছবি দেখিয়ে প্রতারণা করতেন।

বাংলাদেশ জার্নাল/সুজন/এমপি

  • সর্বশেষ
  • পঠিত